রাজি সৌরানি
ফিলিস্তিন পরিস্থিতি নিয়ে প্রাথমিক পরীক্ষার পর একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান কৌঁসুলি ফাতাও বেনসৌদার পাঁচ বছর সময় লেগেছে। যার ফলে এটা বিশ্বাস করার একটা ‘যুক্তিসঙ্গত ভিত্তি’ তৈরি হয়েছে যে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের সঙ্গে পূর্ব জেরুজালেম এবং গাজা উপত্যকায় যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। যার অধিকতর তদন্ত প্রয়োজন। প্রাথমিক তদন্ত শেষ করে তিনি বিবৃতিও দিয়েছেন। ২০১৯ সালের ২০ ডিসেম্বর তার বিবৃতির পর এই তদন্তের উপর ঘটনার শিকার মানুষ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়।
সেখানে যে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে এর গ্রহণযোগ্য প্রমাণ কমিশনের সামনেই এই নারী প্রসিকিউটরই তুলে ধরেছেন। যার ফলে ন্যায়বিচারের আশায় বিষয়টি তদন্তেরও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তথাপি আরও সামনে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে তিনি নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন আইসিসির আঞ্চলিক এখতিয়ারের সুযোগে বিচারের পূর্বে প্রাথমিক তদন্তের।
গাজায় একজন আইনজীবী হিসেবে আমি ৩০ বছর ধরে ফিলিস্তিন অধিভুক্ত অঞ্চলে যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার মানুষদের বিষয়টি তুলে ধরছি। ২০০৯ সাল হতে আইসিসির আগেই আমি গাজায় ইসরায়েলের নৃশংসতার শিকার মানুষের বিষয়টি উপস্থাপন করে আসছি। আমাদের শেষ অবলম্বন এটা নিশ্চিত করা যে সবচেয়ে গুরুতর ও উদ্বেগজনক অপরাধগুলো যেন সাজার আওতার বাইরে চলে না যায় সে ব্যাপারগুলো বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা।
তবে আদালতের বেদনাদায়ক ধীরগতির কারণে ইদানিং আমি ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছি। এটা সত্য যে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচার কার্যক্রম অন্যান্য ঘরোয়া মামলার তুলনায় সাধারণত দীর্ঘ হয়। কিন্তু এটা বুঝতে কষ্ট হয়, ফিলিস্তিনে যে অপরাধ সংঘঠিত হয়েছে তার অধিকতর তদন্ত কেন শুরু হচ্ছে না! যদিও প্রসিকিউটরের প্রাথমিক তদন্তে তা প্রমাণিত হয়েছে।
প্রসিকিউটরের সিদ্ধান্ত বিচারপূর্ব তদন্ত যা ফিলিস্তিনের আঞ্চলিক অধিকারের আওতায় পড়ে। যার ফলে বিলম্বে মামলার কার্যকারিতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।
সবচেয়ে লক্ষ্যণীয়, ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে নিজেদের অবস্থান নিয়ে একটি পজিশন পেপার (সাফাই দলিল) প্রকাশ করেছে। যা অপরাধের গভীরতা থেকে মানুষের মনোযোগকে ভিন্ন দিকে ধাবিত করে। সেই পুরনো প্রশ্ন ফিলিস্তিন কী আদৌ কোনো রাষ্ট্র? এই বিতর্ক আইনি এবং নৈতিক অযোগ্যতাকে উসকে দেয়। ফিলিস্তিন যদি কোনো রাষ্ট্রই না হয় তাহলে সেখানে কেউ যুদ্ধাপরাধের শিকারও হবে না!
বেশির ভাগ উপস্থাপনা নিজেদের আঞ্চলিক এখতিয়ার বিষয়ক কৌশলি প্রশ্নে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি, যেভাবে তাদের অনুরোধ করা হয়েছিল। তবে তারা এই মুহূর্তে ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে, ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রসত্তা নিয়ে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার এটাই সুবর্ণ সুযোগ। আদালত যদিও সময়মতো রায় দিতে পারেননি।
এই রাজনীতি আইসিসি’র বিচার শুরুর গোড়ার দিক থেকেই চলছে। পূর্বের প্রচেষ্টাগুলোর ভাগ্যই বারবার প্রতিধ্বনিত হয়, যা প্রতিকার চায় ফিলিস্তিনে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের বৈধ প্রক্রিয়া ও ফোরামের। আদালতের বিরুদ্ধে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক প্রচারণা চলেছে। রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সেমিটিক বিরোধী অবস্থান গ্রহণের অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে।
ইসরায়েলের প্রতি নিজের অকুণ্ঠ সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রও অনেক জলঘোলা করছে। তাদের চেষ্টা আইসিসি কর্তৃপক্ষ এবং নিজেদের গণ্ডির মধ্যে থাকা নাগরিক যারা বিচারসংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত তাদের প্রত্যাখ্যান করা। আইসিসি কর্মী এবং তাদের পরিবারের ভিসা স্থগিত করা, ফিলিস্তিনের পক্ষে যায় এমন তদন্তের নিন্দা জানানো এবং ইসরায়েলের জন্য যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে তারা পিছপা হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের নাগরিক যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের রক্ষায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশ পর্যন্ত জারি করেছেন। তিনি আইসিসির প্রসিকিউটর এবং তদন্তকারীদের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। এমনকি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আন্তর্জাতিকভাবে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা এবং শত্রুতার এই অধ্যায় শেষ করার ইচ্ছা থাকলেও তিনি পূর্বের ধারার বিপরীতমুখী অবস্থানে গিয়ে কাজ করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছেন।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগের বিপরীতমুখি স্রোতে আইসিসি নিজেই ডুবে যাবে এমন কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। বিচার প্রক্রিয়া সচল রাখার জন্য এর প্রতিষ্ঠাকালীন চুক্তি ও রোমান আইনের বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক অপরাধ করে কেউ যেন পার পেতে না পারে সে ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকতে হবে।
এই সমস্ত সংশয় মোকাবিলায় আদালতের একমাত্র পন্থা হচ্ছে কঠোরভাবে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই অর্থে প্রাথমিক তদন্তে সন্তোষজনক সমাপ্তির মাধ্যমে প্রসিকিউটর সরাসরি তদন্তের পথ উন্মুক্ত করেছেন। এর ফলে আদালতের ঘরোয়া বিচারের প্রক্রিয়াকে স্পষ্ট করার জন্য কোনো আবেদন দাখিলের প্রয়োজন নেই।
বিচার শুরু করতে ফাতাও বেনসৌদার করা অনুরোধ আদালত কক্ষে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক এনেছে। বিচারের প্রাথমিক স্তরেই এর অবসান প্রয়োজন। এর ফলে অনিশ্চয়তা দূর হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ‘অসহ্য দেরি’ এড়িয়ে চলা সম্ভব হবে।
এমন কড়া বিচারিক পদক্ষেপ মূল বাস্তবতা থেকে বিষয়কে বিচ্ছিন্ন করবে না। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে ইসরায়েলি বর্বরতার শিকার মানুষদের জন্য আদালত যে একমাত্র এবং শেষ অবলম্বন একথা স্বীকার করতেই হবে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পরিত্যাগ, যেকোনো ইসরায়েলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহা, বিদেশি বা আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিষ্ঠুরতার শিকার ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আইসিসির সঙ্গে বাঁধা।
আদালত এখন এমন এক চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে যা মার্কিন-ইসরায়েলি চাপের কাছে নতিও স্বীকার করতে পারে। অথবা ফিলিস্তিনে সংঘটিত কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ যেন সাজার আওতার বাইরে চলে না যায় সেজন্য দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ করে যেতে পারে।
আল-জাজিরা থেকে অনূদিত
লেখক: গাজাভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থার ফিলিস্তিন সেন্টারের পরিচালক।
অনুবাদ : সাখাওয়াত হোসেন সুজন
Discussion about this post