আন্তর্জাতিক ডেস্ক
পঞ্চমবারের মতো জাতিসংঘ সদর দপ্তরে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও আন্তর্জাতিক আবহে উদযাপন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। নিউ ইয়র্কের স্থানীয় সময় সোমবার বাংলাদেশ, ব্রাজিল, কানাডা, মিশর, জর্ডান, লিথুনিয়া ও নিউজিল্যান্ড, জাতিসংঘ সচিবালয় ও ইউনেস্কোর অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে। কভিড-১৯ এর বিধি-নিষেধ এর কারণে ইভেন্টটি ভার্চুয়ালভাবে অনুষ্ঠিত হয়। পুরো আয়োজনটি জাতিসংঘ ওয়েভ টেলিভিশন সরাসরি সম্প্রচার করা হয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সভাপতি ভলকান বজকির অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। সহ আয়োজক দেশগুলোর স্থায়ী প্রতিনিধিরা ছাড়াও অনুষ্ঠানটিতে আরো বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘের বহুভাষিক সমন্বয়কারী ও জেনারেল অ্যাসেম্বলি ও কনফারেন্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এবং জাতিসংঘের বৈশ্বিক যোগাযোগ বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল।
এছাড়া ইউনেস্কো মহাপরিচালকের ভিডিও বার্তা এবং নিউ ইয়র্ক সিটি মেয়রের বার্তা উপস্থাপন করা হয় ভার্চুয়াল এই ইভেন্টটিতে। স্প্যানিস ভাষাভাষি বন্ধু-দেশগুলোর পক্ষে এ সভায় বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে নিযুক্ত পর্তুগালের স্থায়ী প্রতিনিধি।
অনুষ্ঠানটিতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবং সঞ্চালন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা। স্বাগত বক্তব্যের শুরুতেই তিনি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রাণ উৎসর্গকারী ভাষা শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেন।
বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, “ভাষা শহীদদের এই আত্মত্যাগের ফলেই ‘বাংলা’ রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করেছে”। রাষ্ট্রদূত ফাতিমা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, জাতির পিতা ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আর এই ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই ১৯৭১ সালে আমরা অর্জন করেছি মহান স্বাধীনতা”।
যে সকল প্রবাসী বাংলাদেশি বাংলা ভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা করার জন্য প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানান স্থায়ী প্রতিনিধি। প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সে সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনোস্কোর সঙ্গে সরকারিভাবে যোগাযোগ করে বিষয়টি এগিয়ে নিতে যে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন তিনি।
পৃথিবীর বিলুপ্তপ্রায় ভাষাসমূহের সংরক্ষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজধানী ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন বলেও উল্লেখ করেন রাষ্ট্রদূত ফাতিমা। বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে যে প্রস্তাব রেখেছেন তা আবারো উল্লেখ করেছেন তিনি।
সাধারণ পরিষদের সভাপতি ভলকান বজকির জাতিসংঘে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনকে ধন্যবাদ জানান। সাধারণ পরিষদের সভাপতিসহ অন্যান্য বক্তা জাতিসংঘ কর্তৃক আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি আদায়ে অনন্য ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। এছাড়া মাতৃভাষা ও বিশ্বব্যাপী বহুভাষিকতা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে নেতৃত্বশীল ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেন বক্তারা।
ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের সংরক্ষণ এবং শিক্ষা ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তা ব্যবহার এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি হয়ে উঠেছে মর্মে উল্লেখ করেন তাঁরা। টেকসই উন্নয়ন ও এজেন্ডা ২০৩০ অর্জনের অনুঘটক হিসেবে মাতৃভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে অনুধাবন, সহিষ্ণুতা, সংলাপ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণ এগিয়ে নেওয়ার জন্য মত প্রকাশ করেন তাঁরা।
অনুষ্ঠানে বহুভাষিক উপাদানের সমন্বয়ে অনুষ্ঠানটিতে বর্ণাঢ্য এক সাংস্কৃতিক পর্ব পরিবেশিত হয়। ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উজ্জীবিত রাখার লক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের বহুভাষিক উপাদানের সমন্বয়ে তিনটি ভিন্নমাত্রার সঙ্গীত পরিবেশন করে ইউএন চেম্বার মিউজিক সোসাইটি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিলুপ্তপ্রায় ভাষা ‘খোসা-এর একটি অপেরা সঙ্গীত, ফ্রেঞ্চ ভাষার একটি যন্ত্রসঙ্গীত, এবং জাপানী শিল্পী পরিবেশিত একটি রবীন্দ্র সঙ্গীত।
অনুষ্ঠানটিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের থিমসং ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ -এর ভিন্ন মাত্রার পরিবেশনা সকলেরই নজর কাড়ে। বাংলাদেশের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইমেন-এর শিক্ষার্থীরা বহুভাষার সমন্বয়ে গানটি পরিবেশন করেন। জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় ৩৮টি ভাষায় ক্ষুদে ভিডিও বার্তা অনুষ্ঠানটিতে আলাদা মাত্রা এনে দেয়।
ভার্চুয়াল এই অনুষ্ঠানটিতে জাতিসংঘ সদস্য দেশসমূহের উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতিক, জাতিসংঘের কর্মকর্তা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।
মন্তব্য