জাহিদুল ইসলাম জন
এক বছর আগে সেনা অভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক ঘণ্টায় মিয়ানমারের মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল খুবই সামান্য। মনে হচ্ছিলো কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে তা কেউই জানে না। তার আগের তিন দশকের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া অং সান সু চিকে গ্রেফতার করা হয়।
‘সেদিন সকালে ইন্টারনেট এবং ফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়’, বলছিলেন ইয়াঙ্গুনের শিল্প জেলা হ্লাইং থারিয়ার প্রখ্যাত ইউনিয়ন নেতা মোয়ে সান্ডার মিয়ান্ট। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমে খবরটি বিশ্বাস করিনি, কিন্তু যখন রেডিও কিনতে গিয়ে পারলাম না তখন জানলাম সত্যিই অভ্যুত্থান ঘটেছে। আমরা বিধ্বস্ত হয়ে পড়ি। এটা আমাদের জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন। মিয়ানমার কেবল বেড়ে উঠতে শুরু করেছিল। স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ খোঁজাই আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।’
ওই দিনের শেষে সু চির একটি বার্তা প্রকাশ হয়। অভ্যুত্থান ঘটতে পারে এমন ধারণা থেকে লেখা চিঠিতে গণতন্ত্রপন্থী এই নেতা মানুষকে এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। একই সময়ে তার অন্যতম বিশ্বস্ত উপদেষ্টা উইন হেটেইন আরও একটি বার্তা দেন। এতে তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের কথা উল্লেখ করে সু চির দীর্ঘদিনের অহিংস প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেন।
এভাবেই তৈরি হয় সিডিএম বা নাগরিক অসহযোগ প্রচারণা। প্রাথমিকভাবে স্বাস্থ্যকর্মী এবং শিক্ষকেরা কাজে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এতে যোগ দেন। দ্রুতই এতে যুক্ত হতে শুরু করে ট্রেড ইউনিয়ন, সরকারি চাকুরে, এবং সংবেদনশীল সঙ্গীত ও সিনেমার তারকা, মানবাধিকার গ্রুপ এবং নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী।
তারা কেবল অং সান সু চির অহিংস বিশ্বাসই আঁকড়ে ধরলো না- সব বিক্ষোভের পোস্টারেই দেখা গেলো তার মুখ। বিক্ষোভকারীরা অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার পুনর্বহালের দাবি তুললো।
অভ্যুত্থানের চার দিন পর প্রথম বিক্ষোভ আয়োজন করেন মোয়ে সান্ডার মিয়ান্ট। শ্রমিকদের এই বিক্ষোভ ছিল দেশ জুড়ে চলা সামরিক শাসন বিরোধী বিক্ষোভের অংশ। বিক্ষোভের প্রথম মাসগুলোতে সড়কগুলো উৎসবের মতো মিছিলে পূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি বলেন, ‘আমি ভয়ে ছিলাম যে আমার শ্রমিকেরা গুলি খেতে পারে। কিন্তু মিছিলের সময় বিপুল মানুষের অংশ গ্রহণে আমার ভয় দূর হলো।’
বর্তমানে স্বামী এবং তিন সন্তান নিয়ে থাইল্যান্ডে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন মোয়ে সান্ডার মিয়ান্ট। ইয়াঙ্গুন থেকে প্রথমে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত সীমান্ত এলাকায় পাড়ি দেন তিনি। পরে সেখান থেকে রাতের বেলায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে থাইল্যান্ডে পৌঁছান তারা।
আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট ছিল মার্চ মাস। ওই সময়ে অভ্যুত্থানের নেতারা সেনা সদস্যদের বিক্ষোভ আন্দোলন দমনের নির্দেশ দেন। মোয়ে সান্ডার সহিংসতার শিকার হন ১৪ মার্চ। ওই সময়ে তিনি গ্রেফতার এড়াতে বাড়ির বাইরে থাকতে শুরু করেন।
অভিবাসী শ্রমিকের ঘনবসতি রয়েছে হ্লাইং থারিয়া এলাকায়। ইয়াঙ্গুনের কঠোর এলাকা বলে পরিচিত এটি। ওই এলাকায় সেনাবাহিনীর প্রবেশ ঠেকাতে রাস্তায় বসানো হয় ব্যারিকেড।
মোয়ে সান্ডার বলেন, ‘অন্য ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গে পরবর্তী করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা করছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম মিলিটারি আসছে, ফলে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। তারা হ্লাইং থারিয়ার সব সড়ক অবরোধ তুলে ফেলে আর আমাদের দিকে গুলি চালাতে থাকে। আমার কিছু শ্রমিকসহ বহু মানুষ মারা যায়।’
তার স্বামী কো অং বলেন, ‘প্রথমে তারা মাঝখান দিয়ে গুলি চালাতে শুরু করে। পরে পিছন এবং পাশ থেকেও গুলি আসতে থাকে। আমরা লুকানোর চেষ্টা করি কিন্তু গুলি থেকে বাঁচার মতো কিছুই ছিল না।’
স্যাটেলাইট ছবি এবং অন্যান্য ছবি বিশ্লেষণ করে মানবাধিকার হরণের ঘটনা যাচাইকারী সংস্থা মিয়ানমার উইটনেস বিশ্বাস করে হ্লাইং থারিয়ায় ৮০ জন নিহত হয়। সেখানে নিরাপত্তা বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালায় বলে মনে করে সংস্থাটি।
ওই দিনের এক ভিডিওতে দেখা যায়, হ্লাইং থারিয়ার একটি সেতুতে অবস্থান নিয়ে পুলিশ নিচের মানুষের ওপর নির্বিকার গুলি চালাচ্ছে। তারা মোয়ে সান্ডারের বাড়িতে অভিযান চালানো পর তিনি বুঝতে পারেন তাকে এবং তার পরিবারকে ইয়াঙ্গুন ছাড়তে হবে।
প্রথম মাসের বিক্ষোভে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে অংশ নেওয়া আরও অনেকেই পালিয়ে যান। অনেকে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অসম সশস্ত্র সংগ্রাম করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।
পিছু হটার উপায় নেই
অভ্যুত্থানের পর থেকেই মানুষের চোখের আড়ালে রাখা হয়েছে অং সান সু চিকে। গোপন বিচারের পর্দার আড়ালে রেখে তাকে আন্দোলনকারীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়েছে। তার দলের আইনপ্রণেতা এবং কর্মকর্তারা গড়ে তুলেছেন জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) নামে এক ছায়া সরকার। এই ছায়া সরকারের লক্ষ্য জান্তা সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া ঠেকানো এবং আরও বেশি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী যুক্ত করে বিরোধী নেতৃত্ব সম্প্রসারণ করা।
তবে এর সদস্যরা বিচ্ছিন্ন থাকায় এবং সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে বেড়ানোয় এনইউজি’র প্রভাব কমছে। এর বিপরীতে সশস্ত্র প্রতিরোধ গ্রুপের বিস্তার বাড়ছে মিয়ানমারে। স্থানীয় এসব মিলিশিয়া গ্রুপগুলো নিজেদের পিউপিল’স ডিফেন্স ফোর্স (পিডিএফ) নাকে অভিহিত করছে। তারা দখল করা বা বাড়িতে তৈরি বন্দুক, বিস্ফোরক দিয়ে সেনাবাহিনীর বহর এবং জান্তা সরকারের কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
তারা এখন আর শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ নিয়ে বেশি কিছু বলে না। কেউ কেউ আবার সু চির কর্তৃত্বপরায়ণ নেতৃত্ব এবং ক্ষমতাধর সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সহাবস্থানের সমালোচক। তারা বলছেন আগের অবস্থায় ফেরত যাওয়ার কোনও উপায় তাদের নেই।
ইয়াঙ্গুনে নিজেদের বাড়ির কাছে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন দুই তরুণ জর্জ এবং ফ্রাঙ্ক (যদিও এগুলো তাদের প্রকৃত নাম নয়)। জর্জ ছিলেন এক ব্যবসা নির্বাহী। আর ভিডিও গেমে আসক্ত ফ্রাঙ্ক এক ক্যাফেতে কাজ করতেন। তারা উভয়েই এখন বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পিডিএফ এর স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধা।
মার্চে নিজেদের ব্যারিকেডের মধ্যে মানুষকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখে, এবং আন্তর্জাতিক সাহায্য আসছে না বুঝতে পেরে তারা সিদ্ধান্ত নেন অহিংস কৌশল কাজে আসবে না। জর্জ বলেন, ‘সশস্ত্র সংগ্রাম কোন জায়গায় শুরু করতে হবে তা জানা কঠিন ছিল। আমরা ছিলাম সাধারণ মানুষ, সামরিক কোনও প্রশিক্ষণ ছিল না।’
ইয়াঙ্গুনের অ্যাক্টিভিস্টদের কাছে সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল প্রতিষ্ঠিত কোনও বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে যোগ দেওয়া। দেশটির পূর্বাঞ্চলে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কয়েক দশক ধরেই সংগ্রাম করছে এসব গ্রুপ।
এসব গ্রুপের কয়েকটি অভ্যুত্থানবিরোধী আন্দোলন থেকে দূরত্ব বজায় রাখে। তবে থাই সীমান্ত এলাকায় সক্রিয় তিনটি গ্রুপ আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দেয়। এগুলো হলো কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ), কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (কেএলএনএ) এবং কারেন্নি ন্যাশনালিটিজ ডিফেন্স ফোর্স (কেএনডিএফ)।
কেএলএনএ-তে যোগ দেওয়া জর্জ ও ফ্রাঙ্কের প্রথম সমস্যা ছিল তাদের বিশ্বাস অর্জন করা। গ্রুপটি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য অনুপ্রবেশ নিয়ে শঙ্কিত ছিল গ্রুপটি। এছাড়া দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কিছুদিন আগে পর্যন্ত মিয়ানমারের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীদের বিষয়ে খুব কমই সমবেদনা দেখিয়েছে।
দ্বিতীয় সমস্যা অস্ত্র। কালো বাজার থেকে নিজেদের অস্ত্র নিজেদেরই কিনতে হয়েছে তাদের। জর্জ প্রায় দুই হাজার মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দিয়ে একটি পিস্তল কিনেছেন। ফ্রাঙ্ক নিজের গাড়ি এবং এক টুকরো জমি বিক্রি করে সাড়ে তিন হাজার ডলার অর্থ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি এমফোর রাইফেল কিনেছেন। তবে গুলির সমস্যা থেকেই গেছে।
তাদের আশ্রয় দেওয়া কারেনরা আশা করে পিডিএফ স্বেচ্ছাসেবকেরা নিজস্ব অর্থায়নে চলবে কিন্তু কার্যক্রম চালাবে কেএনএলএ কর্মকর্তাদের অধীনে। এটা কঠিন সমন্বয়ের বিষয়।
ফ্রাঙ্ক বলেন, ‘এইসবের আগে আমার কেবল পড়াশোনা এবং খেলায় আগ্রহ ছিল। জঙ্গলে বসবাস, মাটিতে ঘুমানো, মাঝে মাঝে ছেড়ে দিতে ইচ্ছা হয়। যা পাই তাই খেতে হয়- আমরা মাংসের চেয়ে বেশি কলা সিদ্ধ খাই। টয়লেট পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে।’
ডিসেম্বরে সেনাবাহিনীর এক হামলায় জর্জ এবং ফ্রাঙ্ক দুইজনেই আহত হন। সেনাবাহিনীর ধারণা ছিল ওই এলাকায় পিডিএফ নেতা এবং এনইউজি সদস্যরা আশ্রয় নিয়ে আছেন। জর্জ এবং ফ্রাঙ্ক জানান, সেনাবাহিনীর ভারি অস্ত্রের মুখে তারা নাজেহাল হয়ে পড়েন। এছাড়াও তারা এনইউজি এর কাছ থেকে কোনও বস্তুগত সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ করেন। অং সান সু চির অহিংস নীতি চালিয়ে যাওয়া হবে কিনা এবং সশস্ত্র প্রতিরোধের সঙ্গে সমন্বয় কিভাবে হবে তা নিয়ে বিভক্ত এনইউজি।
সেপ্টেম্বরে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনী ব্যবহারের অধিকার সমর্থন করতে এনইউজি ‘পিউপিল’স ডিফেন্সিভ রেভ্যুলিউশন’ ঘোষণা করে। এই ছায়া সরকার প্রবাসী নাগরিকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ যোগাড় করেছে এবং একটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গঠন করেছে। এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে এখন একটি ছোট পিডিএফ ব্যাটেলিয়নের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জর্জ। তিনি জানান, এখন নিয়মিতভাবে এনইউজি’র সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হচ্ছে তবে তিনি তাদের কারেন আশ্রয়দাতাদের অগ্রাধিকার দিতে চান।
এক বছর পর, মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে শুরুর রঙ্গিণ ও উচ্ছ্বাসে ভরপুর আন্দোলন হিসেবে আর চেনা যাচ্ছে না। নিরাপত্তা বাহিনী অন্তত এক হাজার পাঁচশ’ মানুষকে হত্যা করেছে, ধ্বংস করেছে শত শত বাড়ি। জান্তা সরকারের দাবি, তাদের শত শত সেনাও বোমা, গুলির শিকার হয়েছে।
মিয়ানমারের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর প্রতিদিনই বাড়ছে নির্বাসিত মানুষের সংখ্যা।
বিবিসি অবলম্বনে
Discussion about this post