আন্তর্জাতিক ডেস্ক
এ বছরের আগস্টে ৭৫ বছরে পা দেবে পাকিস্তান। ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দেশটির কোনো প্রধানমন্ত্রীই পাঁচ বছর মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। খেলার মাঠ থেকে রাজনীতির মাঠে নামা ইমরান খান দেশটির ১৫তম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করে ২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল মধ্যরাতে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হলেন। এর মাধ্যমে দেশটির প্রায় ৭৫ বছরের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রীই পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না।
সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা বিরোধীদের অনাস্থার মুখে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রীদের। পাকিস্তানের জিও টিভি সেই ইতিহাসই তুলে ধরেছে:
লিয়াকত আলি খান (চার বছর)
পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট স্বাধীনতার দিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।
খাজা নাজিমুদ্দিন (দুই বছরেরও কম সময়)
লিয়াকত আলি খানের পর প্রধানমন্ত্রী হন খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল ছিলেন। তার সময়ে বাংলাভাষা আন্দোলন নিয়ে লাহোরে একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে তাকে গদি ছাড়ার নির্দেশ দেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মালিক গোলাম। কিন্তু তিনি এই নির্দেশ না মানায় বিশেষ ক্ষমতাবলে নাজিমুদ্দিনকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেন মালিক।
মোহম্মদ আলি বোগরা (দুই বছর)
এরপর প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ আলী বোগরা। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে মোট দুই বছর ১১৭ দিন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। নিয়োগের পরপরই, আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ইসকান্দার মির্জার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বোগরার সমস্যা শুরু হয়। তাকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন ইসকান্দার। ১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট তিনি ক্ষমতা ছাড়েন।
চৌধুরী মোহাম্মদ আলী (এক বছর)
পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু করে মোট এক বছরের কিছু বেশি সময় পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় ছিলেন তিনি।দলবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে পাকিস্তানের সংবিধানের পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয়।
এরপর প্রধানমন্ত্রী হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি ১৯৫৬ থেকে শুরু করে এক বছর ৩৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে গভর্নর জেনারেল ইসকান্দারের চাপের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দিরগার (দুই মাস)
পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হন ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দিরগার। মাত্র দুই মাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চুন্দিরগার। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলার পর তাকেও অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়।
ফিরোজ খান নুন (এক বছরেরও কম সময়)
এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন ফিরোজ খান নুন। তার শাসনকাল ছিল ২৯৫ দিন। খুব কম সময়ে ফিরোজের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছায়। জনপ্রিয়তা দেখে ভীত হয়ে তাকেও ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন ইসকান্দার। এরপর জেনারেল আইয়ুব খান শামরিক শাসন জারি করেন।
নুরুল আমিন (১৩ দিন)
১৩ বছরের সামরিক শাসনের অবসানের পর দেশটির অষ্টম প্রধানমন্ত্রী হন নুরুল আমিন। তিনিই পাকিস্তানের ইতিহাসে সব থেকে স্বল্পমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী। মাত্র ১৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। যদিও রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে তিনি পদত্যাগ করেন। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ ভাইস প্রেসিডেন্ট। নুরুল আমিন পাকিস্তানের শেষ বাঙালি নেতা হিসেবেও পরিচিত।
জুলফিকার আলি ভুট্টো (পৌনে চার বছর)
নুরুল আমিনের পর ক্ষমতায় আসেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো। ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে তিনি তিন বছর ৩২৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই জেনারেল মোহাম্মদ জিয়াউল হকের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তাকে এক মাসের জন্য আটকও করা হয়। এক ব্যক্তিকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৭৯ সালে সামরিক আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
মোহাম্মদ খান জুনেজো (তিন বছর)
এরপর ক্ষমতায় আসেন মোহাম্মদ খান জুনেজো। তিনি তিন বছরের কিছু বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন। তবে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য দায়ী করে পদ থেকে সরান রাষ্ট্রপতি জিয়া। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুনের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ তুলে ১৯৭৮ সালের ১৮ মার্চ তার ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়।
বেনজির ভুট্টো (২ বছর)
পাকিস্তানের একাদশ এবং প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি দাবি করেন, রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনীসহ রক্ষণশীল ও ইসলামপন্থি শক্তি তার নতুন চিন্তাভাবনার প্রচেষ্টা রোধ করছে। বেনজিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে ১৯৯০ সালে ইসহাক তাকে বরখাস্ত করেন।
নওয়াজ শরিফ (তিন বছরের কম সময়)
১৯৯০ সালে পাকিস্তানের দ্বাদশ প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রপতি ইসহাক পাক সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর তিনি গদিচ্যুত হন এবং বিরোধী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ত্রয়োদশ ও চর্তুদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তান শাসনের ভার পান বেনজির ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ। এর মধ্যে বেনজির ভুট্টো তিন বছর এবং নওয়াজ শরিফ ক্ষমতাসীন ছিলেন দুই বছরেরও বেশি সময়। ১৯৯৬ সাল থেকে বেনজির তিন বছর ১৭ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বারও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যার চক্রান্তসহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়। রাষ্ট্রপতি ফারুক লেগহারি তার সরকার ভেঙে দেন। নওয়াজের দ্বিতীয়বারের শাসনকাল ছিল দুই বছর ২৩৭ দিন। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের ফলে তার শাসনকালের অবসান ঘটে।
এরপর মীর জাফরুল্লাহ খান জামালি ১৯ মাস, চৌধুরী সুজাত দুই মাস ও শওকত আজিজ তিন বছর পাকিস্তানের ক্ষমতায় ছিলেন। তারপরে প্রধানমন্ত্রী হন ইউসুফ রাজা গিলানি। তিনি চার বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এরপর এক বছরেরও কম সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজা পারভেজ আশরাফ। এরপর ফের ক্ষমতাসীন হন নওয়াজ শরিফ। এ দফায় চার বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি।
ইমরান খান (তিন বছর সাত মাস)
২০১৮ সালের ১৮ আগস্ট নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন ইমরান খান। নির্বাচনে তার জোটসঙ্গী ছিল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম)। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ধারা বজায় রেখে পূর্বসূরিদের মতো ইমরানও মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না। ২০২২ সালের ১০ এপ্রিল মধ্যরাতে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারালেন ইমরান খান। অনেক চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রিত্ব ধরে রাখতে পারলেন না ২২ গজের ক্রিকেট পিচ দাঁপিয়ে বেড়ানো ইমরান। তার ক্ষমতাচ্যুতির মধ্যদিয়ে দেশটির নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না।
Discussion about this post