দোং চুনলিং
মার্কিন-আসিয়ান বিশেষ শীর্ষ সম্মেলনের এক সপ্তাহ পর এশিয়া সফর শুরু করেন জো বাইডেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এই প্রথম তাঁর এশিয়ায় আসা। ২০ থেকে ২৪ মে পর্যন্ত তাঁর এই ভ্রমণসূচির মধ্যে ছিল দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান যাত্রা, ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) আলোচনার সূচনা এবং সশরীরে দ্বিতীয় কোয়াড শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণ। এই সফরে তাঁর বক্তব্য এবং এর প্রভাব বিচার করে বলা যায়, প্রথম এশিয়া সফরে বাইডেনের তিনটি কৌশলগত অভিপ্রায় উন্মোচিত হয়েছে।
প্রথমত, বাইডেনের লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় জোটব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও আঞ্চলিক বিষয়গুলোতে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করা। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার বেলায় দেখা গেল, বাইডেন প্রশাসন আমেরিকা-দক্ষিণ কোরিয়া মৈত্রী শক্তিশালী করার জন্য দেশটির সদ্যঃসমাপ্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে। একই সঙ্গে বৃহৎ শক্তির সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার যে কূটনীতি দক্ষিণ কোরিয়ার ছিল, সেখান থেকে সিউলকে সরাতে প্রলুব্ধও করা হয়।
জাপানে গিয়ে বাইডেন প্রশাসন টোকিওকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হওয়ার জন্য সমর্থন প্রদান এবং দেশটির প্রতি মার্কিন নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি পুনরুল্লেখ করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, দুই দেশের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক আরো জোরদার করা। দুটি দেশই অকাস ও কোয়াডের মতো উদ্যোগগুলোর কৌশলগত গুরুত্বের ওপর জোর দেয়।
এর মধ্য দিয়ে এই ইঙ্গিত মিলছে যে যুক্তরাষ্ট্র তার ‘সীমিত বহুপক্ষীয়’ সহযোগিতা কাঠামোগুলো সংযুক্ত করছে। ওয়াশিংটন মিত্রদের এবং সামগ্রিক পরিস্থিতিকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তার জোটব্যবস্থার অক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
দ্বিতীয়ত, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের কৌশলগত চাপটি চীনের দিকে ঠেলার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং এটি তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার সংঘাত পশ্চিমাদের জন্য সবচেয়ে জরুরি নিরাপত্তা ইস্যু হওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে যে বাইডেন প্রশাসন এখনো চীনকে তার সবচেয়ে বড় কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। এতে বোঝা যায়, রাশিয়ার কারণে ওয়াশিংটন তার ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল বাস্তবায়নের গতি কমাচ্ছে না এবং চীনকে প্রতিরোধ ও দমন করার কাজটিকেও শিথিল করছে না। বরং এশিয়াকে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ভূ-কৌশলগত দুশ্চিন্তা হিসেবেই দেখছে ওয়াশিংটন।
তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক শিল্প সরবরাহ চেইনকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য প্রধান প্রযুক্তিগুলোর ওপর একাধিপত্য বজায় রাখার নীতিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ জন্য সে আইপিইএফের মাধ্যমে এশিয়ায় ‘ছোট প্রাঙ্গণ, উঁচু বেড়া’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাইতো দেখা যায়, বাইডেন দক্ষিণ কোরিয়ায় পৌঁছেই আগে স্যামসাংয়ের চিপ প্লান্ট পরিদর্শনে যান। এ সময় তিনি চিপ এবং অন্যান্য সাপ্লাই চেইনের বিষয়ে একটি জোট গড়ে তোলার পাশাপাশি এ অঞ্চলে ডিজিটাল সাপ্লাই চেইনগুলোকে কুক্ষিগত ও একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশ করেন।
বাইডেন প্রশাসন চীনের ওপর একটি প্রযুক্তি অবরোধ আরোপের জন্য ‘ছোট প্রাঙ্গণ, উঁচু বেড়া’কে ব্যবহার করতে চায়। এ জন্য বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন জোট গড়ে তোলার জন্য তারা কোনো প্রচেষ্টাকেই বাদ দিচ্ছে না। জোটপ্রক্রিয়াটিকে কঠোর করে এবং আইপিইএফ চালু করার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সাপ্লাই চেইন জোট নির্মাণের গতি ত্বরান্বিত করবে। সে চীন ছাড়া এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশে শিল্প চেইন স্থানান্তরের পথ দেখাবে বলে আশা করছে, যাতে ডিজিটাল অর্থনীতিতে আঞ্চলিক প্রযুক্তি ও বাণিজ্যে আধিপত্য অর্জন করা যায়।
এই তৎপরতায় এটি স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলো শুধু এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তার আধিপত্য বজায় ও সংহত করার লক্ষ্যেই কাজ করছে, বরং প্রকৃতপক্ষে এ অঞ্চলের জন্য একটি ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ ফাঁদও স্থাপন করছে। যেহেতু মার্কিন নীতিগুলো প্রধান শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা, তাই দেশটি স্বাভাবিকভাবেই অঞ্চলভিত্তিক কিছু দেশকে তার ‘পক্ষে নিতে’ বাধ্য করে, যা আঞ্চলিক সহযোগিতার মধ্যে ফাটল ধরায়। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন জোট আসলে একটি ‘শীতল যুদ্ধেরই রেশ’ এবং এ অঞ্চলে শীতল যুদ্ধ যুগের রেখে যাওয়া ধারাবাহিক নিরাপত্তা সমস্যা এখন প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে নতুন করে সংঘর্ষের প্ররোচনা হিসেবে কাজ করছে। ‘চীনা হুমকি’র কথা বলে বলে এবং জোটকে শক্তিশালী করে যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত একটি নতুন শীতল যুদ্ধ শুরু করতে সক্ষম হতে পারে এবং এই অঞ্চলটিকে জোটভিত্তিক সংঘাতে নিমজ্জিত করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে কৌশলগত দিক থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের সঙ্গে আবদ্ধ করে নিয়েছে এবং শীতল যুদ্ধের একটি লৌহ পর্দা ইউরেশিয়ায় এসে পড়েছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরো নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ায় জোট সংঘাতকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে, যা সন্দেহাতীতভাবে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য একটি বিপজ্জনক সংকেত। আঞ্চলিক ‘স্বাধীনতা এবং মুক্ত পরিবেশ’ প্রচারের নামে আইপিইএফের লক্ষ্য হচ্ছে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত আধিপত্যে অংশগ্রহণ করতে মিত্রদের টেনে আনা এবং এশিয়ায় আমেরিকাকেন্দ্রিক একটি একচেটিয়া অর্থনৈতিক সমান্তরাল ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সম্ভবত এই প্রক্রিয়াটিই এশিয়াকে একটি নতুন শীতল যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেবে।
প্রায় সময়ই বলা হয় যে একবিংশ শতাব্দী হচ্ছে এশিয়ার শতাব্দী। যা হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা অতি সন্তর্পণে স্থাপন করা একটি নতুন ঠাণ্ডা যুদ্ধের ফাঁদ এশিয়াকে একটি নতুন কৌশলগত ক্রস রোডে নিয়ে আসছে। একবার এই ফাঁদে পড়ে গেলে এশিয়া একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে গড়ে ওঠা দীর্ঘমেয়াদি সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা হারাবে এবং প্রধান শক্তিগুলোর প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হবে।
অতীতের শীতল যুদ্ধের রেখে যাওয়া এশিয়ার নিরাপত্তা সমস্যাগুলো যুদ্ধের নতুন গানপাউডারে পরিণত হবে। কিভাবে এই ফাঁদ থেকে দূরে সরে যাওয়া যায় এবং ‘এশিয়ার শতাব্দী’কে কিভাবে ‘এশিয়ার ট্র্যাজেডি’তে পরিণত হওয়া থেকে আটকানো যায়? শীতল যুদ্ধের ধারণার বাইরে নিরাপত্তার একটি নতুন ধারণা এবং ‘হয় মারো না হয় মরো’ জাতীয় খেলার বাইরে একটি নতুন নিরাপত্তা চর্চার প্রয়োজন। এটিই এখন এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের সব দেশের জন্য একটি পরীক্ষা।
লেখক : চীনের ইনস্টিটিউট অব আমেরিকা স্টাডিজের অ্যাসিস্ট্যান্ট রিসার্চ ফেলো
সূত্র : গ্লোবাল টাইমস
ভাষান্তর : আফছার আহমেদ
Discussion about this post