আন্তর্জাতিক ডেস্ক
টেক্সাসের একটি প্রাথমিক স্কুলে নির্বিচার গুলিবর্ষণের ঘটনায় আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ‘গান লবি’র প্রতি মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে। ডেমোক্র্যাটিক নেতারা অস্ত্র আইন সংস্কার আটকে দেওয়ার জন্য রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের অস্ত্রের পক্ষে ওকালতি করা প্রভাবশালীদের স্বার্থে কাজ করাকে দায়ী করছেন।
মঙ্গলবারের বন্দুক হামলার পর দেওয়া বক্তব্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশ্ন তুলেছেন, ‘ঈশ্বরের নামে, কখন আমরা গান লবির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবো?’
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন ক্ষমতায় থাকাকালে ২০১২ সালে স্যান্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে বন্দুকধারীর গুলিতে ২০ শিশু ও ৬ প্রাপ্ত বয়স্ক নিহত হয়। মঙ্গলবারের হামলাতেও ১৯ শিশুসহ ২১ জন নিহত হয়েছেন। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ওবামা বলেছেন, ভয়ে নয়, একটি গান লবি ও এমন দুঃখজনক ঘটনা এড়ানোর কাজ আগ্রহ না থাকা একটি রাজনৈতিক দল যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারালাইজড করেছে।
হাউজ ইন্টেলিজেন্স কমিটির ডেমোক্র্যাটি চেয়ারম্যান অ্যাডাম শিফ টুইটারে লিখেছেন, শিশুরা মরছে। এই বিষয়ে আমরা কিছু একটা করতে পারি। কিন্তু রিপাবলিকানরা গান লবির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে রাজি না।
‘গান লবি’ কী
যুক্তরাষ্ট্রে তথাকথিত গান লবি একটি বিস্তৃত শব্দ। এতে অস্ত্র নীতি ইস্যুতে অঙ্গরাজ্য ও ফেডারেল পর্যায়ে প্রভাব বিস্তার অন্তর্ভুক্ত। সাধারণ এই প্রভাব বিস্তার করা হয় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্ট পদক্ষেপের বিরোধিতাকারী প্রার্থীদের সমর্থনের মাধ্যমে।
এতে রয়েছে আইনপ্রণেতাদের সরাসরি তহবিল প্রদান, নির্বাচিত কর্মকর্তাদের স্বতন্ত্রভাবে সহযোগিতা এবং আগ্নেয়াস্ত্র সংশ্লিষ্ট জনমত নিজেদের পক্ষে নিতে প্রচারণা। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনি অর্থ আইন এড়াতে প্রায়ই এমন লবিং খুব সতর্কতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা হয়।
বেশ কয়েকটি অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ বিরোধী বড় লবিং গোষ্ঠীগুলো – সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) – এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শত কোটি ডলারের অস্ত্র শিল্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
এনআরএ ও একই ধরনের গোষ্ঠীগুলো নিজেদের নাগরিক অধিকার রক্ষাকারী হিসেবে দাবি করে। এক্ষেত্রে তারা মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর কথা তুলে ধরে। যাতে নাগরিকদের ‘অস্ত্র রাখা ও বহনের অধিকার’ দেওয়া হয়েছে।
অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ পক্ষের গোষ্ঠীগুলোর একটি গিফর্ড অর্গানাইজেশন। সাবেক মার্কিন কংগ্রেসউইম্যান ও বন্দুক সহিংসতার শিকার গ্যাবি গিফর্ড এটি গড়ে তুলেছেন। সংস্থাটির অভিযোগ, এনআরএ লবিস্টরা শুধু বেশি সংখ্যক অস্ত্র বিক্রিতে আগ্রহী এবং গান লবি কর্মকর্তাদের এটিই চূড়ান্ত কথা।
বন্দুক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা মানুষেরা ফেডারেল অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ পাস না হওয়ার জন্য লবিটির ক্ষমতাকে দীর্ঘদিন ধরে দায়ী করে আসছেন। তারা দেশজুড়ে রিপাবলিকান প্রভাবিত অঙ্গরাজ্য গুলোর অস্ত্র নিয়ে শিথিল বিধিনিষেধকেও দায়ী করছেন।
টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবট ও রিপাবলিকান টেক্সাস সিনেটর টেড ক্রুজ, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সপ্তাহে এনআরএ-এর ইন্সটিটিউট ফর লেজিসলেটিভ অ্যাকশন শীর্ষক একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেবেন।
‘গন লবি’ কতটা প্রভাবশালী?
গান লবির প্রভাব পরিমাপ করা কঠিন। এই গোষ্ঠীটি দেশজুড়ে রাজনৈতিক ও প্রার্থীদের সমর্থনে লাখো ডলার ব্যয় করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছুটা আর্থিক সংকটে পড়া এনআরএ দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতিকদের গ্রেডিং ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছে এবং নিজেদের স্বার্থে বিজ্ঞাপনী প্রচারণা বাস্তবায়ন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতির ব্যয় নিয়ে কাজ করা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ওপেনসিক্রেটস-এর মতে, ১৯৯৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বন্দুকপন্থী গোষ্ঠীগুলো লবিংয়ের পেছনে ব্যয় করেছে ১৭১.৯ মিলিয়ন ডলার। আইনপ্রণয়ন প্রভাবিত করতে এই অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। এনআরএ একাই এই খাতে ব্যয় করেছে ৬ কোটি ৩৮ লাখ ৫৭ হাজার ৫৬৪ ডলার।
ওপেনসিক্রেটস-এর মতে, ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তথাকথিত বাইরের খরচ হিসেবে ব্যয় করেছে ১৫৫.১ মিলিয়ন ডলার। ২০০০ সাল থেকে এনআরএ-এর এমন ব্যয় ছিল ১৪০ মিলিয়ন ডলার। এগুলোর মধ্যে সেই ব্যয় রয়েছে যা সরাসরি প্রার্থীদের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যয় করা হয়নি।
প্রার্থীদের সরাসরি তহবিল প্রদানের সীমা থাকলেও বাইরের খরচে কোনও সীমা রেখো নেই।
২০১৬ সালে এনআরএ ট্রাম্প ও ৬ রিপাবলিকান সিনেট প্রার্থীর সমর্থনে ব্যয় করেছে ৫০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশীল দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য পেনসিলভানিয়াতে টিভিতে সম্প্রচারিত প্রতি ২০টির মধ্যে একটি বিজ্ঞাপন ছিল এনআরএ-এর সৌজন্যে। সেন্টার ফর পাবলিক ইন্টিগ্রেটি-এর এক পর্যালোচনায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। নর্থ ক্যারোলাইনাতে ওই মাসে প্রতি ৯টি বিজ্ঞাপনের একটির পৃষ্ঠপোষক ছিল এনআরএ। ওহাইয়োতে এই অনুপাত ছিল ৮:১।
ওপেনসিক্রেটস জানিয়েছে, ২০১৬ সালে এনআরএ’র সামগ্রিক ব্যয় দাঁড়ায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। সবচেয়ে সুবিধাভোগ করেছেন ট্রাম্প।
২০১৭ সালে ট্রাম্প বন্দুকের অধিকারের সমর্থন জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন খবর প্রকাশিত হয়েছে। এনআরএ-কে তিনি বলেছিলেন, আমি কখনও আপনাদের ব্যর্থ হতে দেব না।
১৯৯০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বন্দুকপন্থী সংস্থাগুলো নির্বাচনি প্রচারণায় সরাসরি ৫৪.৪ মিলিয়ন ডলার তহবিল প্রদান করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অর্থের বেশিরভাগ গেছে রিপাবলিকানদের পকেটে।
২০২২ সাল পর্যন্ত এমন তহবিল পাওয়াদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছেন মার্কিন কংগ্রেসের রিপাবলিকান সিনেটর র্যান্ড পল ও জন কেনেডি। বন্দুকপন্থীদের কাছ থেকে তারা ৩৮ হাজার ডলারের বেশি তহবিল পেয়েছেন। এই সময়ে প্রতিনিধি পরিষদের মাইনরিটি হুইপ স্টিভ স্ক্যালিজ পেয়েছেন বন্দুকপন্থীদের কাছ থেকে ২৫ হাজার ৬১০ ডলার।
২০১৮ সালে পুনরায় নির্বাচনের সময় টেক্সাসের সিনেটর ক্রুজ বন্দুক সমর্থকদের কাছ থেকে সরাসরি ৩ লাখ ১১ হাজার ১৫১ ডলার পেয়েছেন।
২০২০ সালে রিপাবলিকান সিনেটর মার্থা ম্যাকস্যালি, ডেভিড পারডিউ ও কেলি লোয়েফলার সরাসরি বন্দুকপন্থীদের কাছ থেকে যথাক্রমে ৫ লাখ ১৬ হাজার, ৩ লাখ ৭ হাজার ও ২ লাখ ৯৮ হাজার ডলার পেয়েছেন।
সূত্র: আল জাজিরা
Discussion about this post