অনলাইন ডেস্ক
চলমান করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞায় সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ও অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং বৈশ্বিক সংহতির ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংকট ও মন্দা থেকে উত্তরণে ৬টি প্রস্তাবও দিয়েছেন তিনি।
গতকাল বুধবার (২১ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে খাদ্য, জ্বালানি ও অর্থবিষয়ক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গঠিত জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসের তৈরি প্ল্যাটফর্ম ‘চ্যাম্পিয়ন্স গ্রুপ অফ গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স’ (জিসিআরজি) আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে শেখ হাসিনা এ আহ্বান জানান।
জাতিসংঘের মহাসচিবের সভাপতিত্বে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, চলমান এ সংকট এককভাবে কোনো দেশের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এ মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং বৈশ্বিক সংহতি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইউক্রেনের যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট সংকটগুলো আমাদের সমাজ এবং অর্থনীতিতে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। করোনা পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনের পথে যোগ করেছে নতুন চ্যালেঞ্জ।
চলমান এ বিপর্যয়ের একটি গ্রহণযোগ্য সমাপ্তি টানতে উপায় খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞা গোটা বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বিশেষ করে যুদ্ধরত, উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মানুষের ভোগান্তি আরও বেড়েছে।
সংকট মোকাবিলায় সক্রিয় হওয়ায় জাতিসংঘ মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এ সংকট কাটিয়ে উঠতে সঠিক নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, এজন্য অন্য অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতেও আমরা প্রস্তুত।
অ্যান্তেনিও গুতেরেসের উদ্যোগে শিগগিরই একটি পারস্পরিক সমাধান নিয়ে আসবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সংকট সামলাতে বাংলাদেশের নেওয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশে সামষ্টিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশে আমরা সুনির্দিষ্ট আর্থিক ব্যবস্থা অনুসরণ করছি। আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বহুগুণে প্রসারিত করা হয়েছে। কৃষি, ক্ষুদ্র, কুঠির ও মাঝারি শিল্প এবং অন্যান্য দুর্বল খাতগুলো রক্ষায় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। জ্বালানিখাতে নবায়নযোগ্য অংশ বাড়াতেও নেওয়া হয়েছে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
এ সময় সংকট ও বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় ছয়টি প্রস্তাব পেশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রথম প্রস্তাবে তিনি বলেন, আমাদের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। জি-৭, জি-২০, ওইসিডি, আইএফআই ও এমডিবির মতো সংস্থাগুলোকে সংকট সমাধানে আরও উদ্যোগী হতে হবে।
সংকটগুলোর মধ্যে আছে- এসডিজিতে অর্থায়নের অভাব, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ও ওডিএ কমে আসা এবং ঋণ পরিষেবা।
‘ব্ল্যাক সি গ্রেইন’ উদ্যোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় মহাসচিবের প্রশংসা করে দ্বিতীয় প্রস্তাবে তিনি বলেন, যুদ্ধ-সংঘাতের সময় খাদ্য উৎপাদন এবং বিতরণ ব্যবস্থা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য ভবিষ্যতে এ ধরনের যেকোনো উদ্যোগ সমর্থনে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে পারি।
তৃতীয় প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, বৈশ্বিক বাণিজ্য পুনরুজ্জীবিত করতে সাহসী ও সম্মিলিত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। বিশ্ব বাণিজ্য ও রপ্তানি আয়ে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর ন্যায্য অংশীদারত্ব নিশ্চিত করাও অপরিহার্য।
চতুর্থ প্রস্তাবে উৎপাদনশীলতা এবং কার্যকর খাদ্য সংরক্ষণ ও বিতরণ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করে করে তিনি বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নতুন ব্যবসার সুযোগ তৈরি, প্রযুক্তি সহায়তা, ওডিএ উন্নত করা এবং রেয়াতি অর্থায়নে সরকার থেকে সরকার (জি টু জি) এবং বাণিজ্য থেকে বাণিজ্য (বি টু বি) খাতে সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
পঞ্চম প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু সহযোগিতায় বিশ্ব স্থাপত্যকে আরও কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত করতে হবে। আমাদের উচিত আসন্ন কপ-২৭-এর সুযোগটি কাজে লাগিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ক্ষতি মোকাবিলায় সহযোগিতা করা।
ষষ্ঠ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের রক্তাক্ত ও সর্বনাশা সংকটের (রাশিয়া-ইউক্রেন যুদধ) একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সমাপ্তির উপায় খুঁজে বের করার কথা বলেন। নিষেধাজ্ঞা এবং পাল্টা নিষেধাজ্ঞাগুলো সারা বিশ্বের মানুষকে গভীরভাবে আঘাত করছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সরাসরি সংঘাতে লিপ্ত দেশগুলো এবং উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলো।
অংশীদারদের সঙ্গে জ্বালানি নিরাপত্তায় কাজ করার আগ্রহের কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সারা বিশ্বে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো, খাদ্য-জ্বালানি নিরাপত্তা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে জিসিআরসি গঠনে এগিয়ে আসে জাতিসংঘ। এ গ্রুপের মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশ্বের দরিদ্র ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়া। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা এ গ্রুপে যোগ দেন।
গত ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে জিসিআরজি গঠনের কথা জানান অ্যান্তোনিও গুতেরেস। ১৩ এপ্রিল জিসিআরজিতে যুক্ত হতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন জাতিসংঘ মহাসচিব। অ্যান্তোনিও গুতেরেসের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এ প্লাটফর্মে যুক্ত হয় বাংলাদেশ।
Discussion about this post