আন্তর্জাতিক ডেস্ক
যিনি ছিলেন যুক্তরাজ্যের অর্থমন্ত্রী, তিনি হতে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী। ঋষি সুনাক; ব্রিটেনে তো বটেই, সারা বিশ্বে আলোচিত এক ব্যক্তি। মূল্যস্ফীতির আঘাতে জর্জরিত ব্রিটিশ অর্থনীতিকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে জনগণকে কতটা স্বস্তি যোগাতে পারবেন তাই দেখার বিষয়। আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শেষ হতে শুক্রবার পর্যন্ত সময় লাগলেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বরিস জনসন সরে যাওয়ার পর লড়াইয়ে থাকা পেনি মরডন্টের চেয়ে সুনাকের পাল্লাই ভারী।
জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী জনসনের পদত্যাগের পর তার সম্ভাব্য উত্তরসূরী হিসেবে আলোচনায় আসেন ঋষি সুনাক। কিন্তু সেপ্টেম্বরের সে যাত্রায় তাকে হটিয়ে প্রধানমন্ত্রীত্বের মুকুট জয় করেন লিজ ট্রাস। কিন্তু মাত্র ৪৫ দিন ডাউনিং স্ট্রিটে থাকতে পেরেছিলেন তিনি। চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ হারে করপোরেট ছাড় দেওয়াসহ ‘মিনি বাজেট’ নামে যে আর্থিক পরিকল্পনা তার সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, তা ব্রিটেনের জনগণ পছন্দ করেনি। দলের ভেতরে বাইরে তীব্র অসন্তোষের মুখে সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা ছাড়েন কনজারভেটিভ পার্টির এই নেত্রী।
গত বৃহস্পতিবার লিজ ট্রাসের পদত্যাগের পর আবারও আলোচনার কেন্দ্রে ঋষি সুনাক, এবার আরও জোরালোভাবে। আর্থিক খাতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনৈতিক সম্পর্কে বাজার ও অর্থনীতি সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক ধারণা রয়েছে। দিশেহারা ব্রিটেনকে সঠিক দিশা ঋষি সুনাক দিতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সবাই উৎসুক। কেমন নেতা হতে পারেন তিনি?
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
ঋষি সুনাকের জন্ম ১৯৮০ সালের ১২ মে যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটনে। তাঁর পূর্ব পুরুষেরা বাস করতেন ভারতের পাঞ্জাবে। সেই সূত্রে তাঁকে বলা হয় ভারতীয় বংশোদ্ভূত। পাঞ্জাব থেকে ঋষির দাদা-দাদি ও নানা-নানিরা অভিবাসী হয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়া ও কেনিয়ায়। তাঁর মায়ের জন্ম তানজানিয়ায়, বাবার কেনিয়ায়। ১৯৬০ এর দশকে এই দুই পরিবার যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটনে পাড়ি জমালে, সেখানে পরিচয় হয় ঋষির বাবা যশবীর ও মা উষা সুনাকের মধ্যে। পরে তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
যশবীর ও উষা সুনাক সাউদাম্পটনেই থিতু হোন। সেখানেই জন্ম হয় ঋষি সুনাকের। তিন ভাই-বোনের মধ্যে ঋষিই সবার বড়। ঋষির বাবা চাকরি করতেন ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে, মা ছিলেন ফার্মাসিস্ট।
পড়াশোনা
ঋষি সুনাকের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল সাউদাম্পটনের বিখ্যাত বেসরকারি স্কুল উইনচেস্টার কলেজে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছেন এমন ছয়জন ব্যক্তি পরবর্তীতে যুক্তরাজ্যের চ্যান্সেলর হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে ঋষি সুনাক একজন।
উইনচেস্টার কলেজের পাট চুকানোর পর ঋষি ভর্তি হন অক্সফোর্ডের লিঙ্কন কলেজে। সেখানে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা নেন তিনি। অক্সফোর্ডে পড়ার সময় তিনি কনজারভেটিভ পার্টির সদর দপ্তরে ইন্টার্নশিপ করেন। ২০০১ সালে অক্সফোর্ড থেকে স্নাতক ও পরে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ ডিগ্রি নেন তিনি।
পরিবার
স্ট্যানফোর্ডে পড়ার সময় ভারতের অন্যতম ধনকুবের নারায়ণ মূর্তির মেয়ে অক্ষতা মূর্তির সঙ্গে পরিচয় হয় ঋষি সুনাকের। সেই পরিচয় ভালো লাগা থেকে প্রণয় গড়িয়ে ২০০৯ সালে দাম্পত্য সম্পর্কে রূপ নেয়। ঋষি ও অক্ষতার দুটি কন্যা সন্তান আছে।
রাজনৈতিক জীবন
২০১০ সাল থেকে কনজারভেটিভ পার্টির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে শুরু করেন ঋষি সুনাক। মাত্র ১২ বছরের মাথায় তিনি দলটির শীর্ষপদে অধিষ্ঠিত হতে যাচ্ছেন।
যুক্ত হওয়ার পর থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তিনি দলটির ব্ল্যাক অ্যান্ড মাইনরিটি এথনিক (বিএমই) গবেষণা শাখার প্রধান ছিলেন। পাশাপাশি দলের নীতি নির্ধারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
এরপর উত্তর ইয়র্কশায়ারের রিচমন্ড থেকে হাউস অফ কমন্সের সদস্য পদে কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী হন। পরের বছর মে মাসে সুনাক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচিত হন।
এরপর ২০১৭ সালে ও ২০১৯ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হোন। প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের ব্রেক্সিট পরিকল্পনার পক্ষে ঋষি তিন তিনবার ভোট দিয়েছিলেন।
এর আগে ২০১৮ সালে তিনি প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ওই বছর তিনি যুক্তরাজ্য সরকারের আবাসন, সম্প্রদায় এবং স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
এরপর প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের শাসনামলে তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। জনসনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চ্যান্সেলর সাজিদ জাভিদ পদত্যাগ করলে ঋষিকে চ্যান্সেলর নিয়োগ দেন জনসন।
কিন্তু করোনা মহামারির ধাক্কা, অর্থনৈতিক মন্দা, বরিসের অস্বাভাবিক ব্যয়সহ নানা কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার দাবি জানিয়ে পদত্যাগ করেন ঋষি সুনাক। মূলত তখনই জনসনের ক্ষমতার ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। পরে আরও অনুষঙ্গ যোগ হলে শেষ পর্যন্ত বরিস প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ্য হন।
কেমন নেতা হতে পারেন ঋষি সুনাক
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে নামার পর থেকে ঋষি সুনাক তাঁর প্রচারাভিযানে ‘অর্থনীতি পুনরুদ্ধার ও ঢেলে সাজানোকে’ প্রাধান্য দিয়েছেন। গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে জয়ী হওয়ার চেয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোকে তিনি শ্রেয় মনে করেন। অর্থাৎ প্রয়োজনে তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়াবেন, তবু মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবেন না।
ব্রিটেনের অর্থনীতি যে গভীর খাদে পড়েছে, সেখান থেকে অর্থনীতিকে উদ্ধার করতে ঋষি সুনাকের ওপর অনেকেই আস্থা রাখছেন। যেমন গতকাল রোববার বর্তমান অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট তাঁকে সমর্থন করে বলেছেন, ‘আমাদের দীর্ঘ মেয়াদি সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো তিনি নিতে পারবেন’ বলে আশা করা যায়।
ইতিবাচক দিকের পাল্লা ভারী হলেও ঋষি সুনাকের বিরুদ্ধে সমালোচনাও কম নয়। ব্রিটেনের স্থানীয় এক গণমাধ্যম বলেছে, ২০২০ সালে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জের ট্যাক্স হেভেন ট্রাস্টের সুবিধাভোগী হিসেবে তালিকাভুক্ত ছিলেন ঋষি। তবে এই অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন তিনি।
তরুণ এ রাজনীতিক ব্রিটিশ আইনপ্রণেতাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনীদের একজন। কিন্তু তিনি তাঁর সম্পদ নিয়ে কখনোই প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। তাঁর সম্পদ নিয়ে তদন্ত চলছে। তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে।
ব্রেক্সিট আন্দোলনের পক্ষে একজন সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন ঋষি। তিনি স্থানীয় গণমাধ্যম ইয়র্কশায়ার পোস্টকে বলেছিলেন, ইইউ জোট থেকে যুক্তরাজ্য বের হয়ে এলে দেশটি মুক্ত, সুন্দর ও সমৃদ্ধ হবে। অভিবাসন নীতিতেও পরিবর্তন আনতে চান তিনি। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের অবশ্যই সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে।’
বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার পরেও ঋষি ও তাঁর স্ত্রী মার্কিন গ্রিন কার্ড নিজেদের কাছে রেখেছিলেন। এ বিষয়টি ঋষির দেশপ্রেমকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলে সমালোচকেরা মনে করছেন।
একজন জ্যেষ্ঠ টোরি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সময়ে দ্য অবজারভারকে বলেন, ‘তিনি (সুনাক) নির্লজ্জতা দেখিয়েছেন। তিনি যুক্তরাজ্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েও এমনভাবে সব সাজিয়েছেন, তা থেকে বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্রে ক্যারিয়ারের বিকল্প পথ খোলা রেখেছেন তিনি।’
ঋষির বিরুদ্ধে আছে বিলাসবহুল জীবনযাপনের অভিযোগও। গত জুলাই মাসে ঋষি উত্তর ইংল্যান্ডের একটি নির্মাণাধীন অবকাঠামো পরিদর্শন করেছিলেন। সেখানে তাঁকে প্রায় ৬০০ ডলার মূল্যের একটি জুতা পরা অবস্থায় দেখা গেছে। আর তাতেই ব্রিটিশ মিডিয়ায় সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
এর আগেও ঋষি সুনাক তাঁর ব্যয়বহুল জীবনযাপনের জন্য আলোচনায় এসেছিলেন। ২০২০ সালে দেশের চ্যান্সেলর হিসেবে প্রাক-বাজেট ফটোগ্রাফে ২২০ ডলারের মগ ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। যুক্তরাজ্যের জনগণ যখন জীবনযাত্রার ব্যয় চালাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন সুনাক উত্তর ইয়র্কশায়ারে ৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার খরচ করে একটি পুলও নির্মাণ করেছেন বলে খবরে বেরিয়েছে।
ঋষি সুনাক যদি এ যাত্রায় প্রধানমন্ত্রী হয়েই যান, তবে এসব সমালোচনা উজিয়ে তিনি ডাউনিং স্ট্রিটের কেমন নেতা হবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, ব্রিটানিকা, হিন্দুস্তান টাইমস, এনডিটিভি ও ডয়চে ভেলে
Discussion about this post