সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, ডিপ্লোমা শিক্ষায় বয়সের বাধা তুলে দেওয়া হবে। ডিপ্লোমা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অর্থাৎ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলো কলেজ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান। এসএসসি পাস করে চার বছর মেয়াদি কোর্সে ভর্তি হতে হয়। বয়সের বাধা তুলে দিলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়াশোনার পরিবেশ বিঘ্নিত হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) বয়সের বাধা তুলে দেওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক আপত্তিও জানিয়ে রেখেছে।
স্পষ্ট করা দরকার, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার দুটি ধারা বিদ্যমান। ট্রেড কোর্স ও ডিপ্লোমা কোর্স। ট্রেড কোর্সে দুই থেকে ছয় মাসের স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ প্রদান করে দক্ষ কারিগর গড়ে তোলা হয়, যারা পরে শ্রমবাজারে কাজ করেন। আর ডিপ্লোমা কোর্সে প্রকৌশল শিক্ষা দেওয়া হয়। ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা প্রচলিত অর্থে কারিগর নন।
শিক্ষামন্ত্রী বয়সের বাধা তুলে দেওয়ার বিষয়টি কেন বলেছেন? বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রবাসী কর্মীদের একটি অংশ ভবিষ্যতে হয়তো দেশে ফিরবেন। অদক্ষ কর্মীদের দক্ষ করে তুলতে এবং আধা দক্ষদের দক্ষতা বাড়াতে তাদের কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে অনেক প্রবাসী কর্মী চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরছেন। তাদের কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করা জরুরি। ফলে পরিকল্পনাটা চমৎকার হলেও প্রস্তাবনায় কিছু সমস্যা রয়েছে।
ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স চার বছরের। ডিপ্লোমা পাস করার পর ক্ষুদ্র একটি অংশ আরও চার বছরের বিএসসি কোর্সে ভর্তি হয়। একটি অংশ চাকরি পায়, অনেকেই বেকার থাকেন। কেউ কেউ দক্ষতা-সংশ্নিষ্ট নয় এমন কাজ বেছে নিতে বাধ্য হন। ঢাকার মালিবাগে একটি অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তারক্ষীকে আমি জানি, যিনি একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। এ রকম অনেককেই পাওয়া যাবে।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভিকে বলেছেন, ডিপ্লোমায় প্রতিবছর অনেক আসন খালি থাকে, বয়সের বাধা তুলে দিলে আসন পূর্ণ করা যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে- আসন খালি থাকে কেন? কারণ ডিপ্লোমা কোর্সে উপযোগিতা আনয়নের জন্য কার্যকর কোনো পরিকল্পনা ও সমীক্ষার ব্যবস্থা নেই।
সিঙ্গাপুরে ডিপ্লোমায় ছাত্র ভর্তি করা হয় সমীক্ষার ভিত্তিতে। ধরুন, সিভিল বিভাগে এক হাজার আসন আছে। তারা আগে সমীক্ষা করে বের করে, পাস করার পর এদের চাকরির বাজারের পরিস্থিতি কী হবে। সে অনুযায়ী তারা ভর্তি করায়। প্রয়োজনে আসন খালি থাকে। আর আমাদের দেশে কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ছাত্র ভর্তি করানো হয়। ফলাফল বেকারত্ব।
অনেকের ধারণা, সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের ডিপ্লোমা প্রকৌশলীরা ভালো বেতনে চাকরি পান। ধারণাটি পুরোপুরি সঠিক নয়। কিছু একটু ফাঁক আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওখানে গিয়ে সবাইকে নতুন করে ন্যাশনাল ট্রেড সার্টিফিকেট (এনটিসি) অর্জন করে নিতে হয়। এক্ষেত্রে একজন এসএসসি পাস বাংলাদেশির সঙ্গে ডিপ্লোমা পাস বাংলাদেশির কোনো পার্থক্য থাকে না। জাপানেও সে রকম। তবে ওসব দেশে ডিপ্লোমা সনদ দিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সীমিত সুযোগ রয়েছে। সিঙ্গাপুরে গিয়ে যারা এনটিসি করেন না তারা ওই দেশের শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে শর্ট কোর্স করে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। ইলেকট্রিক্যাল বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা করা আমার এক ছাত্র সিঙ্গাপুরে গিয়ে এনটিসি না করতে পারায় পাইপ ফিটিংয়ের কাজ পেয়েছিলেন। হতাশ হয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরে এসেছেন।
এই যখন অবস্থা তখন বয়সের বাধা তুলে দিয়ে সবাইকে ডিপ্লোমায় সুযোগ করে দেওয়া কতটুকু যুক্তিযুক্ত হবে সেটি চিন্তার বিষয়। আর ওই বয়সী কর্মীরা চার বছরের জন্য আবার ছাত্রত্ব বরণ করবেন কিনা তাও প্রশ্নসাপেক্ষ। তবে বয়সের ব্যাপারটা স্বল্পমেয়াদি ট্রেড কোর্সে প্রয়োগ করা যেতে পারে। এতে অল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা দক্ষ কারিগর হয়ে উঠতে পারবেন। অবশ্য সরকার চাইলে বয়স্ক শিক্ষার্থীদের ডিপ্লোমা গ্র্যাজুয়েট বানাতেই পারে। সে ক্ষেত্রে পলিটেকনিক কেন, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিকল্প তো রয়েছেই।
ননটেক বিভাগের শিক্ষক, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট
Discussion about this post