ঈশপ ছিলেন মিশরের ফারাও
বাদশাহ আমাসিসের সময়কার লোক।
সামস দ্বীপে তিনি বাস
করতেন।
–
ইয়াডমন নামে এক নাগরিকের
ক্রীতদাস ছিলেন তিনি। ঈশপ দেখতে ছিলেন
কদাকার কিন্তু বুদ্ধি ও
হাস্যরসে ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গির
মাধ্যমে তাঁর শিক্ষাপ্রদ অমর
কাহিনীগুলো মানুষকে শোনাতেন।
বিখ্যাত গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস
থেকে শুরু করে সব
শ্রেণীর মানুষ ছিলেন তার
গল্পের ভক্ত।
তার মৃত্যুর পর গ্রীসের দার্শনিক
জিমট্রিয়াস তার গল্পগুলো সংগ্রহ
করে রাখেন।
সেই থেকে ঈশপের গল্প
আজও সারা বিশ্বের অমূল্য
সম্পদ।
কে এই ঈশপ?
“খরগোশ আর কচ্ছপ দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করল। অল্প সময়েই অনেক দূর চলে যাওয়ায় খরগোশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়ার কথা চিন্তা করে ঘুমিয়ে যায়। অলস খরগোশ ঘুমিয়ে সময় কাটালেও একাগ্রচিত্তে ধীর পায়ে এগিয়ে যাওয়া কচ্ছপ ঠিকই প্রতিযোগিতায় জিতে গেল।” – খরগোশ আর কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার এই গল্পটি শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পেতে খুব সম্ভবত অনেক বেগ পেতে হবে।
ছোটবেলায় খরগোশ ও কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার মতো এমন অনেক গল্প আমরা পড়েছি কিংবা শুনে এসেছি। যেগুলোর মাধ্যমে আমাদের অনেক ধরণের নীতিকথা শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের অনেকেরই হয়ত জানা নেই এই গল্পগুলোর স্রষ্টা কে। এই নীতিকথামূলক গল্পগুলোর স্রষ্টা ছিলেন গ্রিক উপকথার জনক ঈশপ।
ঈশপের জীবন:
ধারণা করা হয় খ্রিষ্টপূর্ব ৬২০ থেকে ৫৬০ পর্যন্ত ঈশপের জীবনকাল ছিল। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল এর মতে, ঈশপের জন্মস্থান ব্ল্যাক সি এর উপকূল ঘেঁসে থ্রেস নামক একটি স্থানে। কিন্তু রোমান সাম্রাজ্যের কিছু চিঠিপত্রে আবার তাঁর জন্মস্থান হিসেবে ফ্রিজিয়ার কথা বলা হয়। এছাড়া ইথিওপিয়া, সামোস, অ্যাথেন্স এবং সার্দিসকেও ঈশপের জন্মস্থান হিসেবে মনে করা হয় এবং এগুলোকে তাঁর জন্মস্থানের সম্মান দেয়া হয়।
ক্রীতদাস পরিবারে জন্ম নেয়া ঈশপ নিজেও ছিলেন একজন ক্রীতদাস। ঈশপের প্রথম মনিব ছিল জ্যান্থাস এবং দ্বিতীয় মনিব ছিল জ্যাডমন। দুইজন মনিবই ছিল সামোস এর বাসিন্দা। ঈশপের চমৎকার যে গুণটি ছিল সেটি হচ্ছে অসাধারণ ভঙ্গিমায় গল্প বলে মানুষকে মুগ্ধ করা। সহজ, সরল ভাষায় বলা তাঁর গল্পগুলোর মাঝে লুকিয়ে থাকতো অনেক মূল্যবান উপদেশ। এই নীতিকথামূলক গল্পগুলো এখনও ছোটদের পড়ানো হয় যাতে করে তারা সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে।
ঈশপের গল্প বলার অসাধারণ গুণটির জন্য অল্প সময়েই গ্রিসের নগর রাজ্যগুলোতে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে যেতে লাগল। ঈশপের এই গুণ দেখে তাঁর মনিব জ্যাডমন মুগ্ধ হলেন। ঈশপের ঈশ্বরপ্রদত্ত এই গুণকে আরও বেশি করে চর্চা করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য তিনি ঈশপকে মুক্ত করে দেন। এরপর ঈশপ বিভিন্ন নগরে গিয়ে ঘুরে ঘুরে মানুষকে গল্প শোনাতেন। যে গল্পগুলোর মাঝে লুকিয়ে থাকতো অনেক উপদেশ আর নীতিকথা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঈশপের বেশিরভাগ গল্পই পশুপাখি, জীবজন্তুদের নিয়ে আর সেগুলো গল্পের মাঝে মানুষের মত কথা বলতে পারে। নীতিকথামূলক গল্পগুলোর কারণে ঈশপের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়তে থাকে।
ঈশপের জনপ্রিয়তার কথা লাইডিয়া রাজ্যের রাজা ক্রোসাসের কানে পৌঁছায়। রাজা ক্রোসাসের আমন্ত্রণে ঈশপ লাইডিয়া রাজ্যে গিয়ে তাঁকে গল্প শোনালে ঈশপের প্রতি মুগ্ধ হয়ে যান ক্রোসাস। ঈশপের গল্পের মাধ্যমে সমাজে মানুষের কাছে নীতিকথা পৌঁছানোর কথা চিন্তা করে রাজা ক্রোসাস ঈশপকে তাঁর সভাসদ হিসেবে নির্বাচিত করেন। এরপর রাজা ক্রোসাস বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অঞ্চলে ঈশপকে তাঁর সদুপদেশসমৃদ্ধ গল্পগুলো প্রচারের জন্য পাঠাতে থাকেন।
ঈশপের মৃত্যু:
ঈশপের জীবনকাল নিয়ে যতটা না রহস্য আছে তার চাইতে বেশি রহস্য কিংবা মতপার্থক্য আছে ঈশপের মৃত্যু নিয়ে। ঈশপের জীবনকাল নিয়ে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল আর ইতিহাসবেত্তা হিরোডোটাসের কাছ থেকে অনেক তথ্য জানা গেলেও ঈশপের মৃত্যু নিয়ে তাঁদের কাছ থেকে কিছুই জানা যায়নি।
কেউ যেমন অল্প সময়ে অনেক ভালো কিছু করে ফেললে আশেপাশের লোকজন হিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে, লোকমুখে প্রচলিত ছিল তেমনটাই ঘটেছিল ঈশপের ক্ষেত্রেও। ঈশপ রাজা ক্রোসাস এর অনেক বেশি আস্থাভাজন হয়ে ওঠায় ক্রোসাস এর অন্যান্য সভাসদেরা ঈশপকে পছন্দ করতে পারছিল না। তারা তাই ঈশপের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করা শুরু করল।
রাজা ক্রোসাস একবার গ্রিসের অন্য একটি নগর রাজ্য ডেলফিতে স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ করতে চাইলেন। ক্রোসাসের সভাসদরা তাঁকে পরামর্শ দেয় ঈশপকে ডেলফিতে স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ করতে পাঠানোর জন্য। ঈশপকে ডেলফিতে পাঠালে স্বর্ণমুদ্রা বিতরণের পাশাপাশি একইসাথে তাঁর নীতিকথার প্রচারও হয়ে যাবে ভেবে রাজা ক্রোসাস খুশিমনেই এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান। কিন্তু রাজা ক্রোসাস জানতেও পারলেন না ঈশপের জন্য কী মারাত্মক একটি সিদ্ধান্তই না তিনি নিয়ে ফেললেন!
গ্রিসের ডেলফিতে দেবতা অ্যাপোলোর মন্দির ছিল দেখে ডেলফির অধিবাসীদের মাঝে বেশ অহংকার ছিল। ঈশপ ডেলফিবাসীদের কাছে স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ করার জন্য সেখানে গেলে কে কতটা স্বর্ণমুদ্রা পাবে তা নিয়ে বিশাল হট্টগোল শুরু হয়ে যায়। ঈশপের এই বিষয়টিকে রাজা ক্রোসাসের জন্য চরম অবমাননাকর বলে মনে হয় এবং তিনি স্বর্ণমুদ্রা বিতরণ না করেই সেগুলো নিয়ে ফেরত চলে যেতে থাকেন।
ঈশপের স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে চলে যাওয়া দেখে অহংকারী ডেলফিবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে ঈশপের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা শুরু করে দেয়। ডেলফিবাসী অ্যাপোলো মন্দিরকে এবং মন্দিরের সমস্ত জিনিসপত্রকে পবিত্র বলে মনে করত। ষড়যন্ত্রকারীরা গোপনে ঈশপের জিনিসপত্রের সাথে অ্যাপোলো মন্দিরের একটি সোনার পাত্র রেখে দেয়। ডেলফি নগর পার হওয়ার সময় ডেলফিবাসী ঈশপের জিনিসপত্র পরীক্ষা করার নাম করে অ্যাপোলো মন্দিরের সোনার পাত্রটি উদ্ধার করে।
ডেলফিবাসী তাদের পূর্বপরিকল্পনামত ঈশপের বিরুদ্ধে মন্দিরের পবিত্র দ্রব্য চুরি করার মত গুরুতর অভিযোগ এনে তাঁকে নিয়ে অ্যাপোলো মন্দিরে যায়। এরপর চুরির দায়ে ঈশপকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং নিয়ম অনুযায়ী ঈশপকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিয়ে মেরে ফেলা হয়।
এমন নিষ্ঠুর পরিসমাপ্তি ঘটলেও ঈশপের স্মৃতি, গল্প হারিয়ে যায়নি। তাঁর গল্পগুলো দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভিন্ন জনপদ, গোষ্ঠী, অঞ্চলের মানুষের কাছে ছড়িয়ে পড়েছে।
এমন আরও অনেক অনেক উপদেশ রেখে গেছেন ঈশপ তাঁর গল্প বা উপকথাগুলোর মাঝে। ছোটবেলায় তাঁর উপকথাগুলোর অনেক কিছুই আমাদেরকে পড়ানো হলেও সেগুলোর মর্ম বুঝে উঠতে আমাদের অনেক সময় লেগে যায়। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য তিনি যেমন তাঁর উপদেশ সংবলিত গল্পগুলো রেখে গেছেন তেমনি আমাদের উচিৎ এই উপকথাগুলোর উপদেশ আর নীতিকথা আমাদের মাঝে ধারণ করে তাঁর সব গল্প অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। যাতে করে ঈশপের উপকথা আর তাঁর স্মৃতি আমাদের মাঝে বেঁচে থাকে বছরের পর বছর।
Discussion about this post