বয়স মাত্র দশ-বার বছর।
দরিদ্র কৃষকের সন্তান।
লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি।
টাঙ্গাইলের গোপালপুরে উপজেলার সুতিপলাশ গ্রামের এক দামাল কিশোর।
গাঁয়ের মেঠোপথ, ঝোপঝাড়, পুকুরে সাঁতার কাটা এবং কিশোর বন্ধুদের নিয়ে নদী-খাল-পুকুর পাড়ে হৈ-হুলেস্নাড় করে কৈশোরের দিনগুলো কাটছিল।
বাবা মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, মা আমিনা বেগম।
তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন তিনি।
ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত সাহসী ও দুরন্ত।
আমি যার কথা বলছি সেই কিশোর বীর সৈনিকের নাম শহীদুল ইসলাম।
ডাক নাম লালু।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাঁর বীরত্বের কাহিনী ও জীবনকাহিনী রূপকথার গল্পের মতো।
কিন্তু সে গল্প অতীব সত্য।
চন্দ্র সূয্যির মতো দুঃসাহসী সেই কিশোর লালুর ইতহিাস আমাদের ইতিহাসের অংশ।
একদিন সেই কিশোর দেখল মানুষগুলির ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। সূতীপলাশ গ্রামের অদূরে গোপালপুর থানার আশেপাশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাক সৈন্যরা বাঙালিদের মারছে। লালু পালাতে পালাতে এল কেরামজানী জাওয়াল স্কুল মাঠে। সেখানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার আনোয়ার হোসেন পাহাড়ী দলবল নিয়ে পাকসেনা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লালু এক বুক সাহস নিয়ে তাদের কাছে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করার আবদার জানাল। লালুর সাহস ও বায়না দেখে তারা প্রথমে হেসে ফেলে এবং অবাক হন। কিন্তু লালু নাছোড়বান্দা। যুদ্ধে সে যাবেই। এক সময় ফুট-ফরমাশ খাটানোর লক্ষ্যে তাকে দলে ভর্তি করিয়ে নেয়া হল। কিছুদিনের মধ্যে পাঠানো হল ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ নিয়ে লালু ফিরে এল মাতৃভূমি উদ্ধারের জন্য।যুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে গ্রুফ কমান্ডার পাহাড়ী তাকে আদেশ দেন গোপালপুর থানার হালহকিকত জেনে আসতে।লালু সেখানে গিয়ে তার এক চাচাতো ভাইকে দেখতে পায় যেকিনা পাকিস্তানিদের দালালী করত।সে লালুকে দেখে তার সাথে কাজ করার কথা বলে।লালু কৌশলে পরিচয় গোপন করে কাজ করতে রাজী হয়।সে ফিরে গিয়ে এই কথা জানান।কমান্ডার খুশি হয়ে এই সুযোগ কাজে লাগানোর কথা বলল।
যে কথা সেই কাজ ।লালুকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল গোপালপুর থানায় হানাদারদের বাংকার গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার। বয়সে ছোট বলে সবার অগোচরে এ কাজ সহজে করা যাবে এবং ক্যাম্পের ভেতরে সহজে ঢুকতে পারবেন, শত্রু বলে সন্দেহও করবে না কেউ, সেজন্য লালুকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। নির্ধারিত দিনে লালু হাফপ্যান্ট পরে বিকেলে তিনটি গ্রেনেড নিয়ে গোপালপুর থানার উদ্দেশে রওনা হন। থানার কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। গ্রেনেড তিনটি থানার পেছনের পুকুরপাড়ে রেখে ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। একসময় সুযোগ বুঝে সবার অগোচরে থানার ভেতরের একটি পরিত্যক্ত স্থানে গ্রেনেড তিনটি রেখে তা ব্যবহারের সময় খুঁজতে থাকেন। তারপর চা-পানি খাওয়ানোর ফাঁকে ফাঁকে চারদিকে কে কোথায় আছে দেখে নেন। তিনি তিনটি ব্যাংকার টার্গেট করে নেন, যা সহজেই গ্রেনেডে উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। তাতে কজন পাকসেনা ঘায়েল হবেন তার হিসাবও কষে নেন। একেক ব্যাংকারে ৫ জন, ৪ জন ও ৩ জন করে পাকসেনা রয়েছে। তারা ভারী অস্ত্র নিয়ে ব্যাংকারগুলোতে পজিশন নিয়ে আছে। লালু ছোট হওয়ার কারণে সবার সন্দেহের বাইরে থেকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হন।
লুকিয়ে রাখা গ্রেনেডগুলো আনতে গিয়ে কিছুটা বিপদের সম্মুখীন হন লালু। গ্রেনেডের ওপর শুয়ে ছিল মস্ত বড় একটা সাপ। সাপ চলে যাওয়ার পর গ্রেনেডগুলোর সেফটিপিন খুলে দ্রুত প্রত্যেক ব্যাংকারের দিকে ছুড়ে মারেন। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হয় গ্রেনেডগুলো। এতে তিনটি ব্যাংকারের সবাই মারা যায়। আর সেদিনই মুক্তিযোদ্ধারা গোপালপুর থানা সহজেই দখল করে নেন। লালু থানা থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি যে ফিরে আসতে পারবেন, সে ধারণা কমান্ডারদেরও ছিল না।
সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়ে শহীদুল ইসলাম লালু মুক্তিযুদ্ধের অনন্য ইতিহাস রচনা করেন। এছাড়া তিনি গোপালপুর, ভূঞাপুর, মধুপুর ও নাগরপুরের কয়েকটি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছেন। অধিকাংশ সময়ে তিনি পাকবাহিনীর ওপর নজরদারির কাজ করতেন। তারা কোথায় অপারেশন পরিকল্পনা করে সব গোপন খবর জোগাড় করে মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছে দিতেন। ছদ্মবেশ ধারণ করে অগ্রিম খবর সংগ্রহের ব্যাপারে তার জুড়ি ছিল না। অনেক সময় তার তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই মুক্তিযোদ্ধারা পরবর্তী প্ল্যান তৈরি করতেন।
১৬ই ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলে ২৪শে জানুয়ারী টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুলে আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তাঁর বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র জমা দেন। লালুও সেদিন অন্যদের সাথে তৎকালীন রাষ্ট্রপতির হাতে জমা দেন অস্ত্র। রাষ্ট্রপতি ক্ষুদে মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে অবাক হন এবং কোলে তুলে নিয়ে মঞ্চে বসান। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।
মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করলেও জীবনযুদ্ধে তিনি ছিলেন পরাজিত। অভাব ও দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। মুক্তিযুদ্ধের সফল কিশোরযোদ্ধা এবার জীবনযুদ্ধে নিজেকে হারিয়ে ফেললো। সহযোদ্ধাদের কোন খবর নেই। বয়স হয়নি চাকরি করার। একদিন প্রাণের কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ছুটে এলো ঢাকায়। ঢাকার এসে ঠেলাগাড়ী ঠেলা, রাজমিস্ত্রী ও সোয়ারীঘাটের কুলিগিরি তাঁর ভাগ্যে জুটল। একাদিন সোয়ারীঘাট ছেড়ে চলে এলো কমলাপুর। এখানে লালু দীর্ঘক’টি বছর কুলিগিরি করেন। এরপর আরো ক’ট বছর একটি হোটেলে বাবুর্চির সহকারী হিসেবে কাজ করেন।
তবে বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, তিনি যে বীর প্রতীক খেতাব পেয়েছেন সে কথা নিজেও জানতেন না। জেনেছেন বহু পরে, ১৯৯৬ সালে।মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল বাংলাদেশ সরকারের ১৯৭৩ সালের ১৫ই ডিসেম্বর প্রকাশিত গেজেটে খেতাবপ্রাপ্ত বীরমুক্তি সেনাদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। লালুর নাম রয়েছে ৪২৬ জন বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে। তার নম্বর ৪২৫। তাঁর নাম ছাপা হয়েছে শহীদ ইসলাম, প্রযত্নে/ আব্দুল কাদের সিদ্দিক, টাঙ্গাইল। লালুর ‘বীর প্রতীক’ খেতাবটির সংবাদ সাথে সাথে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং সবাই জানতে পারে তিনিই সর্বকনিষ্ঠ খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। খবর পড়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালুকে দপ্তরে ডেকে পাঠান এবং তাকে সম্মানীত করেন। লালুর দুঃখ, আমাদের দুঃখ-মুক্তিযুদ্ধের বীর সন্তানদের দেয় খেতাবটির সংবাদ জানানো হয়নি। ৩০ বছর পর সে জানতে পেরেছে এবং দেশবাসীর ভালোবাসা শ্রদ্ধা পেয়েছেন।তারপর লালুকে ঢাকার মিরপুরে মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন প্রকল্পের মাধ্যমে মাথা গোঁজার ঠাঁই দেওয়া হয়।দেশের সর্বকনিষ্ঠ বীর প্রতীক শহীদুল ইসলাম লালু ২০০৯ সালের ২৫ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।বীর প্রতীক শহীদুল ইসলাম লালু আমাদের গর্ব। বাংলা মায়ের বীর সন্তান।
Discussion about this post