অনলাইন ডেস্ক
সুহৃদ, মিতা, সখা কিংবা মিত্র- যে নামেই ডাকি না কেন, ‘বন্ধু’ মানেই যেন স্নিগ্ধ, কোমল, প্রশান্তির সুবাতাসে বুকের ভেতরটা জুড়িয়ে যাওয়ার অনুভূতি! প্রিয় বন্ধুর মুখটি স্মরণ করলেই হয়তো মনের পর্দায় ভেসে ওঠে বসন্তের কোনো এক বিকেলে নিরিবিলি রাস্তায় একসাথে হেঁটে যাওয়ার সুখস্মৃতি। অথবা কোনো এক মন খারাপ করা সন্ধ্যায় মন খুলে কথা বলার জন্যে একটি ভরসাস্থলকে পাশে পাওয়ার স্বস্তি। তার সাথে কত কথা, কত খুনসুটি, কত জমানো গল্প! বন্ধু মানেই সেই মানুষটি, যার কাছে মন খুলে বলা যায় সব কথা।
তাই যে হতে পারে আপনার সুখ-দুখের ভাগীদার এবং অনুপ্রেরণার উৎস, এমন মানুষকেই বেঁছে নিন বন্ধু হিসেবে।
হয়তো বলবেন, আজকাল এমন বন্ধু কয়জনই বা হয়! আসলে সত্যিকারের বন্ধুত্বে সংখ্যা কোনো ব্যাপার নয়। দরকার নেই আপনার একপাল বন্ধুর! মনের মতো বন্ধু একজন থাকলেও তা অনেক প্রশান্তি দিবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’-এর ‘বন্ধুত্ব ও ভালবাসা’ অধ্যায়ে বন্ধু নিয়ে কিছু কথা রয়েছে। তা হচ্ছে এমন যে- ‘বন্ধুত্ব আটপৌরে, ভালোবাসা পোশাকী। বন্ধুত্বের আটপৌরে কাপড়ের দুই-এক জায়গায় ছেঁড়া থাকিলেও চলে, ঈষৎ ময়লা হইলেও হানি নাই, হাঁটুর নীচে না পৌঁছিলেও পরিতে বারণ নাই। গায়ে দিয়া আরাম পাইলেই হইল!’
সত্যিই তাই। বন্ধুত্ব তো এমনই! বয়স, ধর্ম, জাত, বর্ণ কোনো কিছুই এই সম্পর্কে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে না। রক্তের সম্পর্কীয় না হয়েও সুখে-দুঃখে, প্রাচুর্যে-দীনতায়, সাফল্যে কিংবা ব্যর্থতায় পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দেবে- এমন বন্ধুই তো সবাই চায়!
আপনি কেমন তা বোঝা যায় আপনার বন্ধুদের দেখে! বলা হয়ে থাকে, কোনো ব্যক্তির বন্ধুদের স্বভাব-চরিত্র কেমন তা জানতে পারলে জানা হয়ে যায় সেই ব্যক্তি কেমন তা। শুধু কথার কথা নয়, রীতিমত বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত এই ধারণার সত্যতা!
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষক ক্যারোলিন পার্কিন্সনের নেতৃত্বে গবেষকদের একটি দল ৪২ জন শিক্ষার্থীর ওপর একটি পরীক্ষা চালান। প্রত্যেককেই একটি সিনেমা দেখতে দেয়া হয় এবং দেখার পরে কার মধ্যে কেমন অনুভুতির উদ্রেক হয়েছে তা পরীক্ষা করতে তাদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করা হয়।
ব্রেন ম্যাপিংয়ে দেখা গেল, শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা পরস্পর বন্ধু তাদের ব্রেন ওয়েভের দৈর্ঘ্য আশ্চর্যজনকভাবে মিলে গেছে! এর কারণ হলো, সহজাতভাবেই আমরা এমন মানুষকেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করি যার সাথে আমাদের মনের মিল আছে।
ব্যক্তির ওপর বন্ধুদের প্রভাব
বন্ধুত্ব যে কেবল আমাদের চিন্তা-চেতনা বা মন-মানসিকতায় ছাপ ফেলে তা নয়; এটি প্রভাবিত করতে পারে আমাদের লাইফস্টাইল, এমনকি স্বাস্থ্যকেও।
ম্যাসাচুসেটসের একটি শহর ফ্রামিংহ্যামে ১৯৪০-এর দশকের শেষ থেকে পরবর্তী তিন প্রজন্মের বাসিন্দাদের ওপরে হৃদরোগ বিষয়ে একটি গবেষণায় চালানো হয়, যেখানে গুরুত্ব দেয়া হয় সামাজিক যোগাযোগের দক্ষতার ওপরে।
দেখা গেল, একজন ব্যক্তির স্থূল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে যদি তার ঘনিষ্ঠ পরিমণ্ডলের কেউ স্থূলকায় হন।
সুতরাং বুঝতেই পারছেন, কাউকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণের ক্ষেত্রে সে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি লালন এবং সঠিক জীবনাচার অনুসরণ করে কিনা তা যাচাই করা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ
বন্ধু না প্রতারক?
প্রতারক কখনোই বন্ধু হতে পারে না। তবে বন্ধুর ছদ্মবেশে প্রতারণা কিন্তু হরহামেশাই হচ্ছে!
পত্রিকার পাতা থেকে একটি ঘটনা-
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এক কেতাদুরস্ত যুবকের থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে এক নারীর ফেসবুকে। বিদেশে নাকি তার বড় ব্যবসা আছে, তবে সে খুব নিঃসঙ্গ। কোনো বন্ধু নেই! তার সাথে সে বন্ধুত্ব করতে আগ্রহী।
বন্ধুত্বের কিছুদিন পর সেই নারী ফেসবুকে দামি অলঙ্কারের ছবি পায়, ‘প্রিয়’ বন্ধুকে সেই যুবক গহনাগুলো উপহার হিসেবে পাঠাতে চায়!
দু’দিন পর মেয়েটির নম্বরে ফোন আসে- তার নামে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পার্সেল এসেছে, ছাড়াতে ২৫ হাজার টাকা লাগবে! টাকা পাঠানোর কিছুক্ষণ পরই আবারো ফোনকল- একটা সমস্যা হয়েছে, প্যাকেটটা ছাড়াতে আরো ৩০ হাজার টাকা দরকার। দিন কয়েক পর ফোন, পার্সেলের প্যাকেট খুলে প্রচুর ডলার পাওয়া গেছে। প্যাকেটটা ছাড়িয়ে নিতে দুই লাখ টাকা দিতে হবে।
সব টাকা দেয়ার পরও কোনো পার্সেলের নামগন্ধ নেই! মাঝখানে গচ্চা গেল সরল বিশ্বাসে পরিবারকে না জানিয়ে অলঙ্কার বিক্রি করে পাওয়া ছয় লাখ টাকা!
কাজেই বন্ধুত্ব করার আগে যাচাই করে নিন; চটকদার কথাবার্তা বা বাহ্যিক রূপে আকৃষ্ট হয়ে বন্ধুত্ব করতে যাওয়া বোকামি।
বন্ধু নির্বাচনে করণীয়-বর্জনীয়
– আর্থিক প্রাচুর্য, জমকালো পোশাক-আশাক বা দামী গ্যাজেট ব্যবহার করে- কেবল এই বিবেচনায় কখনোই বন্ধুত্ব করতে যাবেন না।
– লক্ষ্য, চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত মিল আছে এমন কারো সাথেই বন্ধুত্ব করুন।
– এমন কাউকেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করুন যার কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করেন।
– বন্ধু যে ধর্ম বা মতাবলম্বীরই হোক, খতিয়ে দেখুন তার মধ্যে অনুসরণীয় গুণ আছে কিনা এবং সে আপনার ধর্ম, মত, ধ্যানধারণা ও পছন্দ-অপছন্দকে শ্রদ্ধা করে কিনা।
– ইতিবাচক ও আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের সাথে বন্ধু করুন। কারণ নেতিবাচক ও হতাশ কারো সাথে বন্ধুত্ব করলে তার কাছ থেকে নেতিবাচকতা ও হতাশা আপনার মধ্যেও চলে আসতে পারে।
– বিপরীত লিঙ্গের কারো সাথে বন্ধুত্ব করার ক্ষেত্রে পারস্পারিক সম্পর্ক বন্ধুত্বেই সীমাবদ্ধ রাখতে পারবেন কিনা তা শুরুতেই ভেবে দেখা ভালো!
– কারো সাথে বন্ধুত্ব গড়ার সময় তার কাছে অমূলক কোনো প্রত্যাশা রাখবেন না। নিঃস্বার্থ সম্পর্ক গড়েই দেখুন, ভালো লাগা বাড়বে বৈকি কমবে না!
Discussion about this post