আবু সালেহ মুসা
বাধার ভেতরেই লুকিয়ে আছে জয়। যার জ্বলন্ত উদাহরণ মিহির। কারণ মিহিরের উঠে আসায় লুকিয়ে আছে হাজার রকমের বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আসার গল্প। তার জন্ম বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বড়বেল ঘড়িয়া গ্রামে। তার বাবার একজন বর্গাচাষি এবং মা গৃহিণী। অভাবের সংসার হওয়ায় পরিবার থেকে পড়াশোনার খরচ দেওয়া সম্ভব হতো না। কলেজে পড়ার সময় থেকেই মিহিরকে কাজ খুঁজতে হয়। মিহির জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন।
অভাবের কারণে বাড়ি ছাড়েন
অভাব চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে ২০১২ সালে এইচএসসির পর গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় আসেন। কারণ পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়ার চেয়ে পেটের ভাত জোগানো জরুরি। ঢাকায় আসার পরে এক বন্ধুর সহযোগিতায় জোটে নিরাপত্তা কর্মীর চাকরি। সেই চাকরিতে ৮ ঘণ্টা ডিউটি থাকলেও করতে হতো ১৬ ঘণ্টা। তা-ও আবার একেক সময় একেক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। রাস্তার পাশে এটিএম বুথেও দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। কখনো বুথের পাশে ব্যানার বিছিয়ে ইটের ওপর মাথা রেখে সময় কাটাতে হয়েছে। পাশাপাশি করতে হয়েছে টিউশনি এবং প্রুফ রিডারের কাজও।
কম বেতন ও খাবারের কষ্ট
এমনও সময় গেছে রাস্তার পাশের দুই টাকার শিঙারাও কিনে খেতে পারেননি। বহুবার মনে হয়েছে একবার ওই শিঙারা কিনে খাবেন। কিন্তু বেতন এতই কম যে, যা দিয়ে মাস চালানোই দুঃসাধ্য ছিল। শখের খাবার তো দূরের কথা, পড়ার জন্য একটা বইও কেনার সুযোগ ছিল না।
আরও পড়ুনঃ সপ্তমবারের চেষ্টায় ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার পেয়েছেন রিয়াজ !
আছে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা
শুরু থেকেই নানাভাবে হেয় হতে হয়েছে মিহিরকে। যা থেকে বাদ পড়েনি বাবা-মাও। অপমান-অপবাদের চাকা পিছু ছাড়েনি গ্রাম ছাড়ার পরও। সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করার সময়েও নানাজন নানাভাবে ছোট করতো তাকে। বয়সে ছোট ছেলেটাও তুই করে সম্বোধন করতো। নিজের একটা সুন্দর নাম থাকার পরও মানুষ ‘এই সিকিউরিটি’ বলে ডাকতো। এসব তাকে মানসিক কষ্ট দিলেও সহ্য করা ছাড়া উপায় ছিল না।
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
একসময় মাথায় চিন্তা আসে ঘুরে দাঁড়ানোর। যত কষ্টই হোক, যেভাবেই হোক ঘুরে দাঁড়াতেই হবে। এসময় তার এক বন্ধু এসেছিলেন ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিং করতে। সেই বন্ধুর সাথে মিহিরও গেলেন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ে। এরপর অক্লান্ত পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছার মধ্য দিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। সেখান থেকে বাছাই করে ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে।
জীবনের নতুন অধ্যায়
ভর্তির পর শুরু হয় নতুন পরিশ্রমের অধ্যায়। রাতে ডিউটি, দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে শুরু করেন। কর্মস্থলে রাতের খাবার পেতেন। তার একাংশ খেয়ে বাকি অংশ রেখে দিতেন সকালের জন্য। বেতনের বেশিটাই পড়াশোনার খরচ ও থাকাসহ নানা প্রয়োজনে চলে যেত। তাই মাঝেমধ্যে বাস ভাড়া বাঁচাতে সদরঘাট থেকে হেঁটেই কর্মস্থলে চলে যেতেন। এভাবে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই ভার্সিটি জীবনটা শেষ করতে হয় তাকে।
অবশেষে বিসিএস
এরপর ধীরে ধীরে বিসিএসের চিন্তা আসে। হবে কি হবে না, পারবে কি পারবে না—এসবের মধ্য দিয়ে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেন। একবার হলেও বিসিএসের জন্য চেষ্টা করতে হবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সবকিছুর ফাঁকে একটু একটু করে নিতে শুরু করেন বিসিএস প্রস্তুতি। ফল স্বরূপ সর্বশেষ ৪৩তম বিসিএসে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) তাকে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী ও ফ্রিল্যান্স ফিচার রাইটার।
Discussion about this post