নাইম ইসলাম
ক্রিকেটের নিয়মত ছাত্র হয়ে থাকলে জেনে থাকবেন, ক্রিকেট এক অনিন্দ্য সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন, এবং গৌরবময় এক অনিশ্চয়তার খেলা! মাঠের পারফরম্যান্সের আড়ালে ভালোবাসার এই প্লাটফর্মে প্রতিদিন অনেক রেকর্ডের আবডালে জন্ম নেয় কিছু কাকতালীয় ঘটনা! কাকতালীয় সেসব ঘটনা কারো জন্যে গৌরব এবং নিজের নামের পাশে সুভাষিত হয় রেকর্ডময় গল্পে কিংবা কারো জন্যে শুধুই বিষাধময় ঘড়ির কাঁটার সেই সময়!
কারো হাসি কিংবা কারো বেদনাক্রান্তের গল্পের স্মৃতিরমোন্থনে চলুন জেনে নেই এমন কিছু কাকতালীয় ঘটনার নায়ক কিংবা খলনায়কের ভূমিকায় কারা ছিলেন!
১.
১৯৮৯ সালের ১৫ নভেম্বর ছিলো ব্যাট হাতে শচীনের প্রথম দিন! ঠিক ২৪ বছর পরে ক্যারিয়ারের ক্রান্তিলগ্নে শচীন আবারো ফিরে গিয়েছিলেন সেই ১৫ নভেম্বরেই। উইন্ডিজেরর সঙ্গে সেই টেস্ট ম্যাচে ২০১৩ সালের ১৫ নভেম্বর ছিলো ২২ গজে শচীনের শেষদিন! অর্থাৎ শচীনের শুরু এবং শেষ দুটোই ১৫ নভেম্বর!
২.
২৪ বছরে শচীনের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের ঝুঁলিতে ম্যাচ সংখ্যা ৬৬৪ টি। স্কুল ক্রিকেট নিজের বন্ধু বিনোদ কাম্বলির সঙ্গে শচীনের ঐতিহাসিক সেই জুটিও ছিলো ৬৬৪ রানের। সেই পার্টনারশিপের তারিখ ছিলো ২৪ নভেম্বর এবং ওয়ানডে ইতিহাসে ১ম ডাবল সেঞ্চুরি শচীনের ব্যাট থেকে আসে ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১০ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নিজ দেশে!
৩.
৫ নভেম্বর; ভারতীয় দলের ব্যাটিং এ অন্যতম পথপ্রদর্শক সুনীল গাভাষ্কার নিজ ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলেন ১৯৮৭ সালের ৫ নভেম্বর। ঠিক ১ বছর পরে ১৯৮৮ সালের ৫ নভেম্বর বিরাট কোহলি জন্মগ্রহণ করে। এরপরের বছরের ৫ নভেম্বরে প্রথমবারের মতো ভারতীয় দলের ডাক পায় শচীন টেন্ডুলকার!
৪.
প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে ৫৪ হাজার রান এবং ২৮০০ এর অধিক উইকেট নেওয়া ক্রিকেটের ফাদার বলে খ্যাত ডব্লিউ জি গ্রাসের ১০০ তম জন্মবার্ষিকী ছিলো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের বিদায়ী ম্যাচ খেলেন ডন ব্র্যাডম্যান। সময়ের ঘড়ি তখন বলে ১৯৪৮ সালের ১৪ আগষ্ট সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।
আবার ব্রেডম্যানের বিদায়ের ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ৪২ বছর পরে ১৭ বছর বয়সী শচীন টেন্ডুলকার হাকিঁয়েছিলেন নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট শতক! তারিখ টা ছিলো ১৪ আগষ্ট!
৫.
ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে ভারতের হয়ে ওয়ানডেতে ডাবল সেঞ্চুরি হাকিঁয়েছেন ৩ জন। তাদের প্রত্যকের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসের দিন ভারত জয় পেয়েছে ১৫৩ রানে! ওয়ানডে তে রোহিত শর্মার ২৬৪, বিরেন্দর শেবাগের ২১৯ এবং শচীন টেন্ডুলকারে ২০০ রানের দিনে প্রতিটা ম্যাচে ভারত প্রতিটা ম্যাচ জয় পেয়েছে ১৫৩ রানে!
৬.
ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলায় দিন শেষে এমন অনেক কিছুই ঘটে অদ্ভুতুড়ে এবং কাকতালীয় ভালে। ঠিক যেমনি ঘটেছিল ২০১১ সালের ৯ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার শুরু হওয়া কেপটাউন টেস্টে। ১১ তারিখে ম্যাচের এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়ায় যখন বেলা গড়িয়ে ১১ টা বেজে ১১ মিনিট ঠিক তখনি দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের জন্যে প্রয়োজন ১১১ রান! সময় কাঁটা বলছিলো তখন ১১/১১/১১ সেই দিনক্ষণ।
৭.
স্যার ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান তার ক্রিকেটীয় ক্যারিয়ারে ডাক মেরেছেন কেবল ১০ টি। তবে আশ্চার্যজনক ব্যাপার হচ্ছে স্যার ব্র্যাডম্যান টেস্ট ও খেলেছেন ১০ টি ভেন্যুতেই!
৮.
শতক কিংবা অর্ধশত ক্রিকেটের মঞ্চে হরহামেশাই এই হয়। এমনকি এখন সাদা বলের পোশাকে দ্বিশতক করা ব্যাটসম্যানদের কাছে মুড়ি মুড়কির মতো ব্যাপার৷ সেখানের যদি দেশের নাম টি ভারত হয় তাহলে তো কোনো কথাই নেই। তবে ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে সেসব রেকর্ড কে পাশ কাটিয়ে ১৮৩ সংখ্যা টি একটা বিশেষ কিছু!
সৌরভ গাঙ্গুলী, মাহেন্দ্র সিং ধোনি, ভিরাট কোহলি এই ৩ ব্যাটসম্যানের ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত ইনিংস ১৮৩। ৩ জনেই নিজের ব্যাক্তিগত সর্বোচ্চ এই রান করেছেন অধিনায়কত্ব পাওয়ার আগে। তবে এখানে মজা ব্যাপার হচ্ছে যখনই ভারতীয় কেউ ১৮৩ ইনিংস খেলে ফেলে ঠিক কয়দিন পড়েও সে ভারতের অধিনায়কত্ব পেয়ে যায়। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে সৌরভ গাঙ্গুলি, ২০০৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে ধোনি এবং ২০১৩ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে কোহলি ১৮৩ রানের ইনিংস খেলার পরপরই তারা হয়েছিলেন ভারতের অধিনায়ক!
৯.
টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে ১ম টেস্ট হয়েছিল ১৮৭৭ সালে টেস্টের কুলীন যুগের দুই দল অস্ট্রেলিয়া এবং ইংল্যান্ডের মাঝে। সেই আন্তর্জাতিক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিলো ৪৫ রানে।
ঠিক ১০০ বছর পরে ১৯৭৭ সালে টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসের ১০০ তম ম্যাচে আবারো দেখা হয়েছিলো এই দুই দলের। টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে ১ম ম্যাচ এবং ১০০ তম ম্যাচ দুটোই অস্ট্রেলিয়া জিতেছিলো ৪৫ রানে প্রতিপক্ষ ছিলো বরাবরের মতোই ইংল্যান্ড।
১০.
ক্রিকেট অনিন্দ্য সুন্দর এবং গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলায় এবার ভাগ্য বিধাতাও সায় দিয়েছিলো ইংলিশ ব্যাটসম্যান অ্যালেক স্টুয়ার্টের জন্মদিনে! নথিপত্র বলে অ্যালেক স্টুয়ার্টের জন্মদিন ৮/৪/১৯৬৩ কিংবা ৪/৮/৬৩। ক্রিকেট ক্যারিয়ার শেষে অ্যালেক স্টুয়ার্ট এর রান ছিলো ৮৪৬৩!
১১.
১৩ বছরের ক্যারিয়ারে ৭৫ শব্দকে সাকিব আল হাসান বানিয়েছেন নিজের সমার্থক শব্দ। আর নিজের ৭৫ তম অর্ধশত রানের ইনিংসেও রয়েছে এক অদ্ভুত মিল। সাকিবের ৭৫ তম অর্ধশত রানের ইনিংস ছিলো ঝলমলে ৭৫ রানের ইনিংস!
১২.
১৯৮৬ সালে প্রথমবারের মতো ভারত ইংল্যান্ডকে লর্ডসে হারায়। এবং ২৮ বছর পরে ঠিক ২০১৪ সালে আবারো ২য় বার ইংল্যান্ডকে লর্ডসে হারিয়েছিলো ভারত৷ দুটো জয়ের মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু অদ্ভুতুড়ে মিল। দুটো ম্যাচ এই ছিলো বিশ্বকাপের ঠিক ৩ বছর পরে! দুটো ম্যাচেই জয়ী অধিনায়ক ছিলো বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক! ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী কপিল দেব এবং ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ী মাহেন্দ্র সিং ধোনি।
দুটো ম্যাচেই ‘শর্মা’ ৫ উইকেট নিয়েছিলো, একটায় চেতন শর্মা, আরেকটায় ইশান্ত শর্মা। দুটো ম্যাচেই ‘বিনি’ ৯ রান করেছিলো। এক। ম্যাচে রজার বিনি, আরেকটায় স্টুয়ার্ট বিনি। দুটো ম্যাচেই মুম্বাইয়ের একজন করে ব্যাটসম্যান পেয়েছিলো সেঞ্চুরির দেখা৷ প্রথমে দিলীপ ভেংসরকার এবং ২য় টাই আজিঙ্কা রাহানে! এ ছাড়াও এই মাঝে আরো একটা মিল আছে, ১৯৮৪ এবং ২০১৪ দুটো ফুটবল বিশ্বকাপেই ফাইনালিস্ট ছিলো আর্জেন্টিনা এবং জার্মানি!
১৩.
এমন অদ্ভুতুড়ে দুই ম্যাচের জন্ম আবার দেখে ক্রিকেট বিশ্ব৷ সেখানে উচ্চারিত হয় ভারতের নামই। ১৯৮৬ সালে ভারত বনাম পাকিস্তান এবং ২০১৪ এশিয়া কাপে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যকার দুই ম্যাচে মিলে গিয়েছিলো কিছু অদ্ভুত ভাবেই।
দুটো ম্যাচই আয়োজিত হয় একটি নিরপেক্ষ ভেন্যুতে, দুটো ম্যাচেই টসে জিতে বোলিং নেয় পাকিস্তান, ভারতীয় একজন ওপেনার দুটো ম্যাচেই দুটো করে ছয় হাকিঁয়েছিলো, উভয় ম্যাচেই ভারতের দলীয় স্কোর ছিলো ২৪৫, উভয় ম্যাচেই তিনজন করে ভারতীয় ব্যাটসম্যান অর্ধশত করেছিলো, ২ ম্যাচের ২ টি ইনিংসেই ২ জন পাকিস্তানিরান আউট হয়। শেষদিকে এসে উভয় ম্যাচে পাকিস্তানের ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান শূন্য রানে রান আউট হয়েছিলেন, উভয় ম্যাচেই পুরো ম্যাচে ৩ উইকেট পাওয়া ভারতীয় বোলার ছক্কা হজম করে ম্যাচ হারিয়েছিলো এবং দুটো ম্যাচই পাকিস্তান জিতে নিয়েছিলো ১ উইকেটে।
১৪.
উইলফ্রেড রোডসের প্রথম শ্রেনীর ক্রিকেটে প্রায় ৪০ হাজার রান, ৪ হাজারেরও অধিক উইকেট এবং ৭০০ এর বেশি ক্যাচ। ডব্লিউ জি গ্রেস সবচেয়ে বেশি বয়সে টেস্ট খেলার রেকর্ড গড়ে যেই ম্যাচে ক্রিকেট কে বিদায় বলেছিলেন সে ম্যাচে অভিষেক হয়েছিলো উইলফ্রেড রোডসের৷ ডব্লিউ জি গ্রেসের এই রেকর্ড ঠিক ৩১ বছর পরে ভেঙেছিলো তার বিদায়ী ম্যাচে অভিষেক হওয়া উইলফ্রেড রোডস!
১৫.
বিরাট কোহলি তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারে ১২ সেঞ্চুরির দেখা পান ঠিক ২১ জুলাই ২০১২ সালে, তার ঠিক ৪ বছর পর ২০১৬ সালের ২১ জুলাই ভিরাট পূর্ণ করেন নিজের টেস্ট ক্যারিয়ারের ১২ তম টেস্ট সেঞ্চুরি!
১৬.
কোহলি এবং শচীনের মধ্যে রয়েছে আরো কিছু কাকতালীয় ঘটনা। বিরাট এবং এবং শচীন দুজনেরই রয়েছে টেস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০০০ এর উপরে রান। শচীন যেদিন ১০০০ রান পূর্ণ করেন সেদিন ২৮ ডিসেম্বর এবং কোহলিও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০০০ রান পূর্ণ করেন ঐ ২৮ ডিসেম্বরেই৷ আরো কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে ভেন্যু ছিলো এক; মেলবোর্ন, তাদের দুজনের বয়সও ছিলো এক; ২৬ বছর, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তখন তাদের ম্যাচ সংখ্যান ও ছিলো সমান; ১১ ম্যাচ, ইনিংস ও ছিলো সমান ২৬ ইনিংস, শতক এবং অর্ধশতকের পরিমাণ ছিলো সমান; ৫ টি শতক এবং ২ টি অর্ধশত।
দিনের শেষে এমন অনেক রেকর্ড কিংবা একাল-সেকাল মিলে এমন অনেক কাকতালীয় ব্যাপার দেওয়াই ক্রিকেটের অনিন্দ্য সৌন্দর্যের প্রতীক! এমন আরো অনেক জানা অজানা কাকতাল ব্যাপার আছে! অনেকগুলো একসঙ্গে করার একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস ছিলো আজ! থাকুক কিছু অজানা আজ! জানার ক্ষুধা বেড়িয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে!
Discussion about this post