ফুটবল প্রেমীদের মনে দাগ কাটা এই ফুটবলারের বর্নিল জীবন কাহিনী নিয়ে সাজানো হয়েছে আজকের আয়োজন।
বাল্যকাল :
মেসুত ওজিলের জন্ম তৎকালীন পশ্চিম জার্মানীর জেলসেনকির্সেন শহরে ১৯৮৮ সালের ১৫ ই অক্টোবর একটি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তার দাদা ছিল তুরস্কের নাগরিক এবং বাবা মা ছিল অভিবাসী এজন্য তাকে তুরস্কের বংশোদ্ভূত বলা হয়। ওজিলের বাল্যকালে তাকে দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কারণ, তখন অভিবাসীদের বেকারত্বের হার ছিল ৭০%। তার বাবা মা কে কোন রকম ভাবে সংসার চালাতে হত।
বাল্যকাল থেকেই তার ফুটবলের প্রতি ভালবাসা জন্ম নেয়। বাড়ির কাছেই আবর্জনা পূর্ণ একটি মাঠে বড় ভাইয়ের সাথে ফুটবল খেলত ওজিল।
ফুটবলের প্রতি তার ভালবাসা এতটাই গভীর ছিল যে সে ঘুমানোর সময় ও ফুটবল সাথে নিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করত। তার এই ভালবাসা দেখে ভাই মাতলু ওজিল তাকে ফুটবলের বিভিন্ন
কলা কৌশল শিক্ষা দিত। একজন অভিবাসী হয়ে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন তৎকালীন যুগে অনেকটা আকাশ কুসুম চিন্তার মতই ছিল।
মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়ার সময় “Monkey Cage” ফুটবল একাডেমী থেকে ওজিলের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। কলেজ ফুটবল টিমকে নেতৃত্ব দানের মত সক্ষমতা ওজিল নিজ গুণেই অর্জন করেছিল। ওজিলের কলেজ ছিল জার্মানীর তৎকালীন সর্ব বৃহৎ প্রতিষ্ঠান যার ছাত্র সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪০০ জনের বেশি। কলেজ ফুটবল একাডেমীর সাথে স্থানীয় ক্লাব গুলোর সখ্যতা ছিল। ওজিল তার ক্লাস রুম থেকে শালকে ০৪ এর ট্রেনিং মাঠ দেখতে পেত আর স্বপ্ন দেখত একদিন তাদের হয়ে খেলার। ওজিলের প্রতিভা সম্পর্কে তখন সবাই অবগত ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে ওজিল যেই কলেজের ছাত্র ছিল সেখানে তার সিনিয়র ছিল জার্মান গোলকিপার ম্যানুয়েল নুয়্যার আর তার জুনিয়র ছিল মিডফিল্ডার ডেক্সলার। ওজিল সম্পর্কে তার কলেজ ফুটবল একাডেমীর কোচ বলেছিল,
“ Mesut was not the student that could face a crowd. He was always very shy. But if you saw him on the pitch he was another person,
because there he exploded. Give him a ball, and he would be somebody else.”
ওজিল কার সামর্থ্যের উপহার হিসেবে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে ওজিল জার্মানি অনুর্ধ্ব ১৭ দলের জন্য ডাক পান। ২০০৭ সাল হতে ওজিল জার্মানি অনুর্ধ্ব ২১ দলের হয়ে খেলেন।
ফুটবল ক্যারিয়ার :
ওজিল তার ফুটবল ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে জেলসেনকির্সেনের বিভিন্ন যুব ক্লাবে খেলেন। তারপর, তিনি ৫ বছর রট-উইস এসেনের হয়ে খেলেন। ২০০৫ সালে ওজিল তার শৈশবের স্বপ্নের ক্লাব শালকে ০৪ এর হয়ে খেলা শুরু করেন। তিনি মূলত মিডফিল্ডার হিসেবে শালকের যুব একাডেমী খেলতে শুরু করেন। যুব দল থেকে মুল দলে স্থানান্তরিত হয় এবং শুরু হয় ওজিলের ক্যারিয়ারের পথ চলা। ২০০৮ সালে ক্লাব ছাড়ার পূর্ব পর্যন্ত ওজিল শালকের হয়ে পারফর্ম করেছে।
৩১ জানুয়ারি ২০০৮ সালে €৪.৩ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফির মাধ্যমে তিনি ওয়ের্ডার ব্রেমেনের সাথে চুক্তি বদ্ধ হয়। এট্যাকিং মিডফিল্ডে দুতি ছড়িয়ে সবার নজর কাঁড়ে ওজিল। ২০০৮–০৯ মৌসুমে, ৩ টি গোল ও ১৫ টি গোলে এসিস্টের মাধ্যমে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন ওজিল। পরবর্তী মৌসুমে ওয়ের্ডার ব্রেমনকে লীগে ৩য় হতে সাহায্য করে এবং অবদান স্বরুপ করেন ৯ টি গোল ও ১৭ টি গোলে এ্যাসিস্টের মত ঈর্ষনীয় পারফরমেন্স।
জাতীয় দল কোনটা হবে তুরস্ক নাকি জার্মানী? ওজিল অবশ্য জার্মান যুব দলে খেলার সময়ই ইঙ্গিত করেছিল সে জার্মানীর হয়ে খেলতে চায়। এক সাক্ষাতকারে ওজিল বলেছিল,
“জার্মানিতে আমি আমাদের তৃতীয় প্রজন্ম: আমার বাবা এখানে বেড়ে উঠেছেন। তুরস্ক আমার জন্য সর্বদাই একটি বিশেষ দেশ, কিন্তু আমি কখনোই জার্মানির হয়ে খেলার ব্যাপারে সংশয়ে ছিলাম না। এই জন্যই আমি জার্মানির যুব দলে খেলা শুরু করি।”
১১ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে নরওয়ের বিরুদ্ধে এক প্রীতি ম্যাচে জাতীয় দলে তার অভিষেক ঘটে আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নিজের তৃতীয় ম্যাচে তিনি তার প্রথম আন্তর্জাতিক গোল করেন।
ওজিল ততদিনে জার্মানীর নির্ভরতার প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছিল। ২০১০ বিশ্বকাপ ফুটবলে তিনি প্রতিটি খেলায় মূল একাদশে ছিল। উক্ত বিশ্বকাপে নিজের সেরাটাই দিয়েছিল, যদিও দুর্ভাগ্য যে স্পেনের কাছে সেমিতে হেরে বিদায় নাতে হয়েছিল। ৩ এ্যাসিস্ট ও ১ টি গোলে অবদানের জন্য ওজিল গোল্ডেন বলের জন্য মনোনীত দের লিস্টে ছিল।
বিশ্বকাপ ও লীগে দুতি ছড়িয়ে লাভ করেন বিশ্বের সেরা ক্লাব গুলোর নজর কাড়তে সক্ষম হয়। অনেক জল্পনা কল্পনা শেষে ওজিল যোগ দেয় বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। রিয়াল মাদ্রিদে যোগদান সম্পর্কে ওজিল বলেছিল, রিয়াল মাদ্রিদ এমন একটি ক্লাব যাকে কখনো না বলা যায়। রিয়াল মাদ্রিদে আসার পরই পুরো বিশ্বের ফোকাসে চলে আসে ওজিল। রিয়াল মাদ্রিদকে হতাশ করে নি ওজিল। নিজের জাদু করী ফুটবল দিয়ে রাজত্ব করেছে মধ্য মাঠে। ২০১১–১২ মৌসুমে লা লীগায় ১৭ টি গোলে অবদান রেখে সবাই কে তাক লাগিয়ে দেয় ওজিল, একই বছর উয়েফা অনুমোদিত ট্রুর্নামেন্টে সর্বমোট ২৫ টি এ্যাসিস্ট করে রেকর্ড করে। লা লীগা ক্যারিয়ারে ১০৫ ম্যাচে ১৯ গোল ও ৫৫ এ্যাসিস্ট সবাইকে তাক করে দেয়! তৎকালীন মাদ্রিদ কোচ হোসে মরিনহো ওজিলকে জার্মানীর জিদান বলে আখ্যায়িত করেছিল। কিন্তু এত কিছুর পরও রিয়াল মাদ্রিদে বেশি দিন থাকা হয় নি ওজিলের। রিয়াল মাদ্রিদ কর্তৃপক্ষের অন্ত কোন্দলের ফলে মাত্র দুই সিজন পরেই ৫০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ইংলিশ জায়ান্ট আর্সেনালে যোগ দেয় ওজিল। ওজিলের দল বদল নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে রিয়াল মাদ্রিদের খেলোয়াড়েরা। স্বয়ং রোনালদো মন্তব্য করেছিল, “সে একজন খেলোয়াড় যে গোলের আগে আমার পদক্ষেপগুলো জানত, তার চলে যাওয়া নিয়ে আমি অত্যন্ত অখুশি।”
ওজিলের দল বদলকে ইতিহাসের অন্যতম অনাকাঙ্খিত দল বদল বলে বিবেচনা করা হয়। উক্ত দল বদলের ফলে ওজিল জার্মানীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ দামী প্লেয়ারের মর্যাদা পায়, কিন্তু ওজিল মোটেও সন্তুষ্ট ছিল না। রিয়াল মাদ্রিদের আচরণ নিয়ে ওজিল মন্তব্য করেছিল, “সপ্তাহের শেষের দিকে, আমি নিশ্চিত ছিলাম আমি রিয়াল মাদ্রিদে থাকব কিন্তু আমি দেখলাম যে আমার কোচ ও মালিকের আমার প্রতি সেই বিশ্বাসটি নেই। আমি একজন খেলোয়াড় যার জন্যে ওই বিশ্বাসটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যা আমি মনে করেছি আর্সেনালের আমার প্রতি ছিল, এটাই ছিল সেই কারণ যা আমাকে আর্সেনালে আসতে প্রভাবিত করেছে।”
২০১৩ –১৪ মৌসুম থেকে এখন পর্যন্ত ওজিল খেলছেন আর্সেনালের মধ্য মাঠের মণি হয়ে। আর্সেনালে হয়ে নিজেকে আরো ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছেন ওজিল। সম্প্রতি আর্সেনাল ওজিলের সাথে ২০২১ সাল পর্যন্ত চুক্তি রিনিউ করেছে। আর্সেনালের হয়ে ওজিল ১৯৬ ম্যাচে ৩৭ গোল ও ৭১ টি এ্যাসিস্ট করেছে।
ওজিলের ক্যারিয়ারের সেরা সময় ছিল ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপ। তারকা বহুল দল নিয়ে হট ফেভারিট হিসেবেই আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হয় জার্মানী। বিশ্বকাপ জয়ী দলের অন্যতম ভরসা ছিল মাঝ মাঠের নির্ভরতার প্রতীক মেসুত ওজিল। শুধু বিশ্বকাপ নয়, ২০১৪ সালের বাছাই পর্বে ৮ গোল করার মাধ্যমে সর্বোচ্চ গোল দাতার মর্যাদা লাভ করে। বিশেষ করে আলজেরিয়ার সাথে অতিরিক্ত মিনিটে তার জয় সূচক গোলটি জার্মান ভক্তদের মনে এখনও দাগ কেটে আছে। বিশ্বকাপ জয়ের পর সাবেক উয়েফা সভাপতি মিশেল প্লাতিনি ওজিলের কাছে তার ম্যাচ জার্সি চেয়ে বসেন, ওজিল তাকে হতাশ করে নি।
জাতীয় দল থেকে অবসর:
তুরস্কের নির্বাচনের পূর্বে লন্ডনে এরদোগানের সাথে সাক্ষাতকে জার্মান সমর্থকরা নির্বাচনী প্রচারনা হিসেবে গ্রহণ করে। ঘটনাটি এমন একটি সময় ঘটেছে যখন জার্মান সরকারের সাথে তুরস্কের রাজনৈতিক টানা পোড়ান চলছিল। ওজিলের এহেন আচরণ আগুনে ঘি ঢালার সামিল বলে মন্তব্য করছে সমালোচকরা।
অবশেষে ২২ জুলাই মেসুত ওজিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানিয়ে দিলেন তিনি আর জার্মানীর জার্সি পড়তে আগ্রহী নন। শেষ বার্তা-
“খুব গর্ব আর আনন্দ নিয়ে আমি জার্মান জার্সি পরতাম। কিন্তু এখন আর সেরকম নয়। আমার নিজেকে এখানে অনাকাঙ্খিত মনে হয়। আমার মনে হয়, ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে আমার অভিষেক হওয়ার পর থেকে আমি যা কিছু অর্জন করেছি সেসব মানুষ ভুলে গেছে,” লিখেছেন তিনি।
অবশ্য ওজিলের প্রতি বর্ণ বাদী আচরণকে অস্বীকার করেছে জার্মান ফুটবল ফেডারেশন। তারা দাবি করছে জার্মান ফুটবলে কোন বর্ণ বাদের স্থান নেই। একই সাথে জার্মান ফুটবলে অবদানের জন্য ওজিলকে ধন্যবাদ ও জ্ঞাপন করে ডিএফবি।
জার্মানীর হয়ে ৯২ ম্যাচে ২৩ গোল ৪০ টি এ্যাসিস্ট করেছেন তার এই বর্ণিল ময় ক্যারিয়ারে। সেই সাথে পাচ বার বর্ষ সেরা জার্মান প্লেয়ার হবার গৌরব ও অর্জন করেছেন। একজন নিঃস্বার্থ ফুটবল যোদ্ধা হিসেবেই ওজিলকে মনে রাখবে জার্মান ফুটবলের ভক্ত ও সমর্থকেরা।
Discussion about this post