খেলাধুলা ডেস্ক
ক্রিকেটকে ভদ্র লোকের খেলা বলা হয়, কারণ ভদ্রলোকের দেশ ইংল্যান্ডেই এই ক্রিকেট খেলার জন্ম। ১৮৭৭ সালে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট খেলার মধ্যে দিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু হয়। আজ পর্যন্ত ক্রিকেট জগতে যত খেলোয়ারের আর্বিভাব হয়েছে এবং ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে তাদের মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটার এবিডি ভিলিয়ার্স।
উৎসাহ দিয়ে মানুষকে তার সফলতার দ্বার প্রান্ত পৌছে দেওয়া যে সম্ভব তার জ্বলন্ত প্রমাণ ডি. ভিলিয়ার্স ও তার বাবা। ডি.ভিলিয়ার্সের বাবা ছিলেন একজন ডাক্তার এবং একই সাথে একজন স্পোস্টর্সম্যান। এ কারণে ছেলেকে সব সময় খেলার পক্ষে উৎসাহ দিতেন। ছেলেটিও খেলতে খুব পছন্দ করত। ছেলেটির জীবনে এমন কোন দিন নাই যে দিন খেলা বাদে কাটিয়েছেন। আর সেই ছেলেটি আজ ক্রিকেট সৌন্দর্যের এক উজ্জ্বল প্রদীপ, এক ক্রিকেট কিংবদন্তী। একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে অসাধারণ নৈপুণ্যতার সাথে উইকেটের সামনে চারিদিকে সমানভাবে ব্যাট করতে সমর্থ্য ছিলেন এ বি ডি ভিলিয়ার্স ।
ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতে সেরা খেলোয়ার হিসেবে খেতাব পাওয়ার কারণ হলো, ডি. ভিলিয়ার্স এমন একজন ব্যাটসম্যানস যে ব্যাট হাতে শাসন করতে পারে বিশ্বের যে কোনো বোলারকে। ক্রিকেটের ২২ গজে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন তিনি। তিনি যা চান তাই করেন নিত্যদিনে।অবিশ্বাস্য ফর্ম ও অভাবনীয় সব শটের কারণে বোলারদের চোখে খলনায়কে পরিনত হওয়া ব্যাটসম্যান হচ্ছে তিনি। ক্রিকেটের সব ধরণের ব্যাকারণকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে ৩৬০ ডিগ্রী আ্যাঙ্গেলে চারিদিকে শর্ট খেলতে সিদ্ধ হস্ত এই ব্যাটসম্যান। আর এই কারণেই ভক্তরা তাকে ভালবেসে ডাকেন ’মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রি’। রাহুল দ্রাবিড় বলেছিলেন-“ডিভিলিয়ার্স ক্রিকেটের নিয়মই বদলে দিচ্ছে”।
আবার কেউ কেউ বলেন ক্রিকেটের ’সুপারম্যন’, বিশ্বসেরা বোলারটিকে যিনি পাড়ার বোলারে পরিণত করতে খুব একটা সময় নেন না। আর তাই তাকে আসলে ’সুপারম্যন না বলে আর কি বা বলা যায়।
আকাশ চোপড়া বলেছিলেন,”এবি এর ডিএনএ টেস্টের দাবি জানাই, কেননা ক্রিকেট তো মানুষের খেলা।”
মাইকেল ভন বলেছিলেন,“ক্রিকেট জিনিয়াস বলতে যা বোঝায়, এবি ডি হল এমন একজন।”
তার পুরো নাম:- আব্রাহাম বেঞ্জামিন ডি ভিলিয়ার্স’। তার বাবা ’ ড. এ.পি. ডি ভিলিয়ার্স ’এবং মা ’ মিলি ডি. ভিলিয়ার্স ’।
১৯৮৪ সালে ১৭ ই ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিন আফ্রিকার প্রিটোরিয়া শহরে জন্মগ্রহন করেছিলেন ক্রিকেটের এই মহানায়ক।
এবি তার পরিবারের ছোট সন্তান। তার জন ও ওয়েসেলস নামে বড় দুই ভাই আছে। তার বাবা ডাক্তারের পাশাপাশি একজন দেশ সেরা রাগবি খেলোয়ার ছিলেন। এবি ছোটবেলা থেকেই প্রতিদিন কিছু না কিছু খেলা করতেন। আমরা ক্রিকেট খেলায় অল-রাউন্ডার দেখেছি কিন্তু রিয়েল লাইফ অল-রাউন্ডার খুবই কম দেখেছি। রিয়েল লাইফ অল-রাউন্ডার হিসেবে যদি কাউকে বলা হয় তাহলে চোখ বন্ধ করে আমরা এ. বি. ডি. ভিলিয়ার্স কে বলতে পারি। এ. বি. ক্রিকেটের পাশাপাশি অন্য খেলায়ও সমানভাবে পারদর্শী ছিলেন। নিজের দেশের হয়ে রাগবী দলেও খেলেছেন এবং রাগবী টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি ’আন্ডার-১৬’ হকি টিমের একজন নিয়মিত সদস্য ছিলেন। তিনি সাঁতারেও চ্যাম্পিয়ানশীপ জিতেছেন জাতীয় দলের হয়ে।
এছাড়াও তিনি ’আন্ডার-১৯’ ন্যাশনাল ব্যাডমিন্টনেও চ্যাম্পিয়ান ছিলেন। এবং আন্ডার-১৭ ফুটবল টিমেরও একজন সদস্য ছিলেন। তিনি ক্রিকেটে পা রাখার আগে সাউথ আফ্রিকার সবচেয়ে প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ হিসেবে পুরুষ্কৃত হন।
পড়াশুনাতেও খুব মনযোগী ছিলেন ডি. ভিলিয়ার্স। তিনি আফ্রিকান্স হোয়ের সিয়ানস্কুল বা ’বয়েজ স্কুলে’ পড়াশুনা করেন।এটি প্রিটোরিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয় সরকারী বিদ্যালয়ে । সাউথ আফ্রিকার জাতীয় ক্রিকেট টিমের আরো দু’জন খেলোয়ার এই স্কুলে পড়াশোন করেছেন। তারা হলো-জ্যাক রুডলফস ও ফাফ ডু প্লেসিস। ডু প্লেসিস ও এবি ছিলেন সহপাঠী। স্কুল লাইফে এবি একটি আশ্বর্যজনক সাইন্স প্রজেক্ট করে সবাইকে অবাক করে দেন এবং সেই প্রজেক্টের জন্য তৎকালালীন আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ’নেলসন মেন্ডেলার’ কাছ থেকে জাতীয় পুরুষ্কার নেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন ছোট বেলায় তার স্বপ্ন ছিলো মেডিসিন বিষয়ে পড়ালেখা করে একজন ভালো ডাক্তার হওয়া। কিন্তু তিনি প্রচুর খেলাধূলা করতেন। তাই ডাক্তার হওয়া আর হয়নি।
সব ধরণের খেলার পারদর্শীতা থাকা শর্তেও তিনি ক্রিকেটকে পেশাদার খেলা হিসেবে বেছে নেন। মাত্র বিশ বছর বয়সে ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলেন। এবি ডি প্রথম দক্ষিন আফ্রিকান খেলোয়াড় যিনি ভারতের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে দ্বিশতক হাঁকান। ২১৭★তিন ধরনের ক্রিকেটেই তিনি সমান পারদর্শী। তিনি তার ব্যাটে ক্রিকেট সৌন্দর্যের চিত্র সাজিয়ে ছিলেন। একজন ব্যাটসম্যান যে কতটা চমকপ্রদ ব্যাটসম্যন হতে পারে সেটি এবিডি ভিলিয়ার্স এর ব্যাটিং না দেখলে বোঝা যেত না। যে কোনো বোলার কে এবং যে কোনো বল স্বাচ্ছন্দে খেলতে পারতেন। তার নামের পাশে এমন কিছু রেকর্ড আছে যা হয়ত ভাঙ্গা প্রায় অসম্ভব। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষের ওডিআই ম্যাচ এবিডি ভিলিয়ার্সের সেই দুর্ধর্ষ খেলা আজও সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। সেই এক ম্যাচেই তিনি এক সাথে ৫ টি বিশ্ব রেকর্ড করেন।
১. দ্রুত অর্ধশতক মাত্র ১৬ বলে।
২. দ্রুত শতরান মাত্র ৩১ বলে। যেটা আগে ছিলো নিউজিল্যান্ডের কোরি এন্ডারসনের ৩৬ বল।
৩. দ্রুত দেড়শত রান ৪৯ বল।
৪. এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট ৩৩৮.৬।
৫.এক ম্যাচে ১৬ টি ছক্কা হাঁকান।
এছাড়াও তিনি একমাত্র টেস্ট প্লেয়ার যিনি ৭৮ টেস্ট ইনিংস খেলে কোনোরুপ শূণ্য রান করেননি। যা একটি বিরল রেকর্ডরুপে চিহ্নিত। অবশেষে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্টে এ রেকর্ড ভেঙ্গে যায়। টেস্টে ধারাবাহিক ভাবে অর্ধ-শতক (১২টি) লাভকারী ক্রিকেটার এবিডি ভিলিয়ার্স । এছাড়া ’এবিডি ভিলিয়ার্স একটি টেস্ট ম্যাচে সর্বাধিক আউট করে বিশ্বরেকর্ডের অংশীদার রাসেলের সাথে। আরসি রাসেল ১৯৯৫/৯৬ মৌসুমে জোহানেসবার্গে ইংল্যান্ড বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্যকার খেলায় ১১ টি আউট করে এ রেকর্ড করেন। আর ডি ভিলিয়ার্স ২০১৩ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্ট খেলায় ১০ টি আউট করেন এবং দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৭ বলে ১০৩ রান করেন। এর ফলে একজন উইকেট-রক্ষক হিসেবে এক টেস্টে সেঞ্চুরিসহ দশটি আউট করেন। এরকম অসংখ্যা রেকর্ডের মালিক আমাদের সবার প্রিয় এ বি ডি ভিলিয়ার্স।
আইসিসি ওডিআই প্লেয়ার অব দা ইয়ার জিতেছেন তিন বার (২০১০, ২০১৪, ২০১৫)। ৪১৮ টা ম্যাচ খেলেছেন সাউথ আফ্রিকার হয়ে, ঝুলিতে আছে ৪৭টি আন্তর্জাতিক শতক ইনিংস। ব্যাটিং গড় টেস্ট এবং ওডিআইতে যথাক্রমে ৫০.৬৬ এবং ৫৩.৫০।
তার জীবনী নিয়ে একটি বই লেখা হয়েছে ’এ বি দ্যা অটোবায়োগ্রাফি’।
২০১৭ সালে তিনি টেস্ট খেলা থেকে অবসর নেন। এরপর ২০১৮ সালে তিনি শেষমেশ ক্রিকেটপ্রেমীদের হতবাক করে এক ভিডিও বার্তায় তিনি সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসরের কথা জানান। ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন ’আমি ক্লান্ত ,আমি অনেক খেলেছি এখন সময় এসেছে অন্যদের সুযোগ করে দেওয়ার আমি সব ধরনের ক্রিকেট খেলা থেকে আজ থেকে অবসর নিলাম’। ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে ডি.ভিলিয়ার্সবিহীন দক্ষিন আফ্রিকা ক্রিকেট দল মূলত চালচুলোহীন ছিল।
ক্রিকেটপ্রেমীরা মিস্টার ৩৬০ ডিগ্রী, সুপারম্যান ডি.ভিলিয়ার্সের ব্যাটিং সৌন্দর্য্যকে যেন খুব বেশীই মিস করছে।
Discussion about this post