নিউজ ডেস্ক
যেকোনো নারীর জন্য বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে নেয়া অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে জয়ী হয়ে দেশবাসীর জন্য গৌরব বয়ে আনা আরও বেশি কঠিন। আর এ কাজটি এখনও পর্যন্ত সফলতার সঙ্গেই করে চলেছেন বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের পেস বোলিং অলরাউন্ডার জাহানারা আলম।
২০১৮ সালে ক্রিকেটে প্রথম কোনো শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। এশিয়া কাপের ফাইনালে শক্তিশালী ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। সেই ম্যাচের শেষ বলে ২ রান নিয়ে দলকে শ্বাসরুদ্ধকর এক জয় এনে দেন জাহানারা।
ছোটবেলা থেকে খেলাধুলায় নাম লেখানোয় পরিবার ছাড়া আর কারও ন্যুনতম সমর্থন পাননি জাহানারা। আশপাশের মানুষ পেছনে বলেছে নানান কথা, পরিবারকে শুনিয়েছে অনেক বাজে মন্তব্য। সেসবের সঙ্গে রীতিমতো লড়াই করেই এখন সফল নারী ক্রীড়াবিদ জাহানারা।
বাংলাদেশের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার যাত্রা শুরু হয়েছে ২০১১ সালে। তবে এরও প্রায় তিন বছর আগে থেকেই ছিলেন জাতীয় দলের সঙ্গে। একজন পেশাদার ক্রীড়াবিদ হিসেবে দীর্ঘ এই দেড় দশকের যাত্রায় অনেক কিছুরই মোকাবিলা করতে হয়েছে জাহানারাকে।
নারী দিবসে নিজের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে তিনি কথা বলেছেন সেসব বিষয়ে। একইসঙ্গে সমাজের সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, দৃষ্টিভঙ্গি বদলে নারীদের প্রাপ্য সম্মান দিতে। এতে করে নারীরাও দেশের উন্নতিতে সমান অবদান রাখতে পারবে।
আমি যখন খেলাধুলায় নাম লেখাই, আমার বয়স নয় বছর। তখন আমি হ্যান্ডবল-ভলিবল খেলি। যখন ক্রিকেটে এলাম, তখন আমার বয়স ১৪ বছর। শুরুতে তো তখন অনেক ছোট। আস্তে আস্তে যখন বড় হয়েছি, তখন শুনতে হয়েছে যে মেয়ে বড় হচ্ছে, মেয়েকে কেন এভাবে ছেলেদের পোশাক পরিয়ে খেলতে দিচ্ছেন? এগুলো ঠিক না। আমাকে এটাও শুনতে হয়েছে যে, মেয়ের চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে, পরে তো বিয়ে দিতে পারবেন না। আবার এমনও কথা হয়েছে যে, ছেলেদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছে। এটা তো সমাজবিরোধী।
আমার বাবা শুধু একটা কথাই বলেছেন, সে এমন কোনো কাজ করছে না যেটা অসম্মানজনক। সে খেলতে চাচ্ছে, খেলতে দাও। আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা সম্মানজনক কাজ, তাকে খেলতে দাও। এই যে পরিবারের কাছ থেকে যে সমর্থনটা পেয়েছি, এখনও পর্যন্ত পাচ্ছি। এখন আমি যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছি, এটা আমার পরিবারেরই অবদান।
পরবর্তীতে আসলে হয় কী, পৃথিবীতে সবাই সাফল্যের পাগল। লাভ ছাড়া কেউ বিনিয়োগ করতে চায় না। আমি যখন সাফল্য নিয়ে এলাম, ২০০৮ সালে জাতীয় দলে ঢুকলাম এবং হংকংয়ের বিপক্ষে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে আনঅফিসিয়াল হ্যাটট্রিক করলাম। তখন দেশের শীর্ষস্থানীয় এক দৈনিকে আমার বড় একটি ছবি ছাপা হয়। তখন আস্তে আস্তে মানুষ জানতে পারল।
তারপর যখন আমি শ্রীলঙ্কা সফর করলাম, এক কথায় প্রথমবার যখন বিদেশ সফর করলাম। তখন আমার এলাকার মানুষের খুশি আর দেখে কে! পুরো বাধভাঙা খুশি যে, তাদের এলাকার একটা মেয়ে খেলতে বিদেশ যাচ্ছে এবং পত্রিকায়, টিভিতে, খবরে তাকে দেখা যায়।
এই যে সাফল্য আনার পর যে বিশাল সমর্থনটা, এটা বলতে পারেন যে আমাদের সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য। এখান থেকে যদি আমরা বের হয়ে আসতে পারি, তাহলে আমার মনে হয় যে সমাজব্যবস্থাটা আরও সুন্দরভাবে এগোতে পারবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও যদি একটু বদলাতে পারি, তাহলে আমাদের কাজগুলো আরও সহজ হয়ে যায়। এ জিনিসটা আসলে কাউকে জোর দিয়ে করা যায় না। এটা যার যার অবস্থান থেকে তার ভেতর থেকে আসতে হবে।
আমরা যদি অনেক বড় চিন্তা না করে, ছোট ছোট ক্ষেত্র ধরেই চিন্তা করি যে, আমার পরিবার থেকেই শুরু হোক বিষয়টা। বাইরের কথা চিন্তা না করে যদি আমি চিন্তা করি আমার ঘরে একটা বোন আছে, মা আছে বা ভাবী আছে- বা যেই হোক, তাদেরকে যদি ঐভাবে সম্মান করা হয়… এমন না যে শুধুমাত্র খেলাধুলায়, আমি প্রত্যেকটা সেক্টরের কথাই বলছি। বাংলাদেশে এখন বিভিন্ন সেক্টরেই নারীদের অবদান অপরিসীম। শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বেই এটা বিদ্যমান।
কিন্তু আমরা এখনও পুরুষশাষিত সমাজে বসবাস করছি। যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী, তবু আমার কাছে মনে হয় যে আমরা পুরুষশাষিত সমাজেই বাস করছি। কিছু ঘটনার প্রেক্ষিতে বলছি, অনেক সময় দেখা যায় যে, অনেক পরিবারে মেয়েরা তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারছে না। এমন না যে তারা খারাপ কিছু চাইছে, তারা ভালো কাজই করতে চায়। কখনও কখনও তারা পড়তে চায় কিন্তু পড়তে দেয়া হচ্ছে না, খেলাধুলা করতে চায় কিন্তু সেটা করতে দেয়া হচ্ছে না বা চাকরি করতে চাইলে সেখানেও সমর্থন পাচ্ছে না।
আপনি চিন্তা করুন, একজন শিক্ষিত নারীর বিয়ে হলো এবং তিনি চাকরি করতে পারছে না। যদি তার স্বামীর বাড়িতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদে পড়ে, তাহলে কিন্তু তার সামনে আর কোনো পথ খোলা থাকছে না। আমি এক্ষেত্রে দেখেছি যে, অনেক পরিবার কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেয় যে, আমরা কিছু জানি না, শ্বশুড়বাড়ি গিয়েছ তো ওখানেই থাকো।
নারী দিবস দেখে আসলে এসব কথা বলছি। শুধু ইতিবাচক বললে অন্য বিষয়গুলো সামনে আসবে না। তো আমি শুধু এটাই বলবো যে, আমরা যদি দৃষ্টিভঙ্গিটা বদলাই, সেখান থেকে নারীদের সম্মান করতে শিখি… আমাদের মূল বিষয় হওয়া উচিত সম্মান দেয়া, এটা সবার আগে আসা উচিত।
আমার বিশ্বাস, যদি আমরা একটু সম্মান দেখাই, নারীদের প্রাপ্য সম্মান দেই এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই তাহলে নারীরা যে অবদান রাখছে এবং যে নারীরা ঘরের কোণে পড়ে আছে, তাদের প্রতিভা ধামাচাপা পড়ে আছে, সেগুলো কিন্তু আরও সুন্দরভাবে সামনে আসবে। আমার বিশ্বাস, বাংলাদেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে এই নারীরা, ছেলেদের পাশাপাশি।
ক্রিকেটে প্রায় এক যুগের যাত্রা জাহানারার। যেখানে আছে ইতিবাচক অনেক স্মৃতি । নারী দিবসে সমাজের নারীদের জন্য বার্তা দিয়ে জাহানারা বলেন- ‘সব দিনই নারীদের। আমার কাছে প্রতিদিনই নারী দিবস। শুধু একটা দিন (৮ মার্চ) হলো যে একটু আলাদা করে বিশেষভাবে সম্মান দেয়া, অন্যভাবে চিন্তা করা- এটাই হয়তো নারী দিবস। এটা জাস্ট আলাদা একটা সম্মান যে, প্রত্যেকটা দিবস এমনভাবে পালন করা হয়। তবে আমার কাছে মনে হয় যে প্রত্যেকটা দিনই আসলে নারীদের। নারীরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সামনেও আরও এগোবে ইনশাআল্লাহ্।
আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও যদি সমানভাবে এগিয়ে যায় এবং প্রত্যেকটা ভালো কাজে সমান অবদান রাখতে পারে- তাহলে এটা বাংলাদেশের উন্নতিতে আরও সাহায্য করবে এবং দেশকে বহির্বিশ্বে আরও ভালোভাবে তুলে ধরবে।
Discussion about this post