মুয়াজ মাহি
যেকোন কিছুতেই পরিবর্তন একটা কমন ব্যাপার। ফুটবলেও অনেক পজিশনে, অনেক রোলে পরিবর্তন এসেছে। একটা সময় উইঙ্গাররা সাধারণত ম্যাচের পুরোটা সময়জুড়েই ওয়াইডে অবস্থান করতো, লেফট ফুটেড উইঙ্গার লেফট সাইডে এবং রাইট ফুটেড উইঙ্গার রাইট সাইডে অবস্থান করে বক্সে থাকা স্ট্রাইকারদের জন্য ক্রস দিতো। সেন্ট্রালি তেমন একটা কাট ইন না করে ওয়াইডেই অবস্থান করে গোল স্কোরিং চান্স ক্রিয়েট ও ফুলব্যাকদের ডিফেন্সিভ সাপোর্ট দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো মাঠে তাদের দায়িত্ব।
নব্বই এর দশকের শেষের দিকে এসে উইঙ্গারদের এই রোলে পরিবর্তন আসে ও উদ্ভব হয় ‘ইনভার্টেড উইঙ্গার নামক টার্মের। রাইট ফুটেড উইঙ্গাররা লেফট সাইডে ও লেফট উইঙ্গাররা রাইট সাইডে খেলা শুরু করে। ফলে তাদের ডিফেন্সিভ সাপোর্ট দেওয়া কমে গেলেও এটাকিং এ শুধুমাত্র বক্সে ক্রস দিয়ে স্ট্রাইকারদের গোলের চান্স ক্রিয়েট করার সাথে সাথে নিজেরাও সেন্ট্রালি কাট ইন করে নিজেদের স্ট্রং ফুটে শট নিয়ে গোল করতে থাকে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে ভার্সেটাইল উইঙ্গারদের আবির্ভাব ও প্রচলনের পর উইঙ্গার রোলটার আরো পরিবর্তন ঘটে। ভার্সেটাইল উইঙ্গার বলতে সাধারণত তাদের বুঝানো হয় যারা উভয় পায়েই সমান পারদর্শী। তারা যেকোন সাইডেই ওয়াইডে অবস্থান করে বক্সে ক্রস দিয়ে চান্স ক্রিয়েট করতে যেমন পারদর্শী, তেমনি সেন্ট্রালি কাট-ইন করে গোল করতেও সমান পারদর্শী। আর এই ইনভার্টেড উইঙ্গার ও ভার্সেটাইল উইঙ্গারদের পথিকৃৎ খুঁজতে গেলে যে অল্প কয়জনের নাম সবার আগে আসবে তাদের মধ্যে একজন হলেন ডাচ ‘রোডরানার’ মার্ক ওভারমার্স। আজকের লেখাটা মূলত তাকে নিয়েই।
১৯৭৩ সালের ২৯ মার্চ নেদারল্যান্ডসের এমস্টে তার জন্ম। এমস্টে তাদের ফ্যামিলি ফার্মেই তার বেড়ে ওঠা। তার দাদার ছিলো একটি আলুর ফার্ম। তার দাদা ছিলো না কোন ট্রাক্টর বা মেশিনারিজ। যখন আলু তোলার সময় হতো তখন ওভারমার্সের ডাক পড়ত। তিনি কোমরে একটি মোটা রশি বেঁধে তার পরিবারের সদস্যদের একটি গাড়িতে টেনে নিয়ে যেতেন। পরবর্তীতে ওভারমার্স বলেছিলেন, ছোটবেলায় এই কাজের কারণেই তিনি পরবর্তীতে যে গতির জন্য পরিচিত ছিলেন, তা পেয়েছিলেন।
ওভারমার্সের ইউথ ক্যারিয়ার শুরুর হয় এসভি এপের হয়ে। ১৯৮৭ সালে ১৪ বছর বয়সে গো অ্যাহেড ঈগলস এর ইউথ টিমে যোগ দেন। ১৯৯০ সালে তিনি ফার্স্ট টিমে প্রোমোটেড হন এবং ঐ সিজনে ১১ ম্যাচে ১ টি গোল করেন। ১৯৯১ সালে তিনি যোগ দেন উইলেম ২ তে। সেখানে ১ সিজন খেলার পর ১৯৯২ সালের জুনে ২.৫ মিলিয়ন ইউরোর ট্রান্সফার ফিতে যোগ দেন ডাচ জায়ান্ট আয়াক্সে। তখন আয়াক্সের কোচ ছিলেন লুইস ভ্যান গাল। ১৯৯য়া সালের সেপ্টেম্বরেই আয়াক্সের কোচ হয়ে আসার পর প্রথম ট্রান্সফার উইন্ডোতে ওভারমার্স ছিলো ভ্যান গালের অন্যতম পছন্দ।
১৯৯২ সালের ১৬ আগস্ট আয়াক্সের হয়ে অভিষেক হয় ওভারমার্সের। আয়াক্সে থাকাকালীন ভ্যান গালের পছন্দের ফরমেশন ছিলো ৪-৩-৩ ও ৩-৪-৩ ডায়মন্ড। ওভারমার্স উভয় পায়ে সমান পারদর্শী হলেও তুলনামূলক স্ট্রংগার ফুট ছিলো রাইট ফুট। ভ্যান গাল লীগে প্রথম ১৩ টি ম্যাচে ওভারমার্সকে স্টার্ট করান রাইট উইঙ্গার হিসেবে। কিন্তু ওভারমার্সের গোল স্কোরিং ক্যাপাবিলিটি ইউজ করার জন্য ইউট্রেক্টের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো লেফট উইং এ স্টার্ট করান ওভারমার্সকে। সেই থেকে শুরু করে পুরো ক্যারিয়ারজুড়েই তিনি বেশিরভাগ ম্যাচেই লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলেছেন। আয়াক্সের হয়ে প্রথম সিজনে ওভারমার্স ৭ টি গোল ও ৭ টি এসিস্ট করেন। এই ৭ টি গোলের মধ্যে ২ টি এসেছিলো হিরেনভীনের বিপক্ষে KNVB কাপের ফাইনালে। ঐ সিজনে আয়াক্স জিতে ঐ একটি শিরোপা, লীগে হয় ৩য়।
পরের সিজনে তিনি আয়াক্সের হয়ে জিতে নেন লীগ ও চ্যাম্পিয়নস লীগ। আয়াক্সের উচলজয়ী ড্রিম টিমের একজন ইম্পরট্যান্ট প্লেয়ার ছিলেন ওভারমার্স। উচলের প্রত্যেকটি ম্যাচই খেলেন। উচলে তার সবচেয়ে উজ্জ্বল পারফরম্যান্স ছিলো বায়ার্নের বিপক্ষে সেমিফাইনালের সেকেন্ড লেগে। ফার্স্ট লেগে মিউনিখ থেকে গোলশুন্য ড্র করে আসার পর সেকেন্ড লেগে নিজেদের মাঠে জিততেই হতো আয়াক্সকে। ১২ মিনিটে রোনাল্ড ডি বোরের গোলে এগিয়ে গেলেও ৩৬ মিনিটে সমতায় আনে বায়ার্ন। এই স্কোরলাইনে খেলা শেষ হলে অ্যাওয়ে গোলের সুবাদে ফাইনালে উঠতো বায়ার্ন। কিন্তু ৪১ মিনিটে ওভারমার্সের এসিস্টে গোল করে দলকে ২-১ এ এগিয়ে দেন ফিনিডি জর্জ। এরপর আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি বায়ার্ন। ৮৮ মিনিটে দলের হয়ে পঞ্চম গোল করে দলকে ৫-২ গোলের জয় এনে দেন ওভারমার্স। এরপর ফাইনালে মিলানকে হারিয়ে শিরোপা জিতে আয়াক্স। ঐ সিজনে ওভারমার্স ৪২ ম্যাচে ৯ গোল ও ১৩ টি এসিস্ট করেন।
ওভারমার্সের পরের সিজনের শুরুটা হয়েছিলো আরো দুর্দান্ত। ১৯৯৫ এর ডিসেম্বরে সিজন শেষ করে দেওয়া ইঞ্জুরিতে পড়ার আগে ২২ ম্যাচে করেন ১২ টি গোল ও ৭ টি এসিস্ট। যদিও আয়াক্স লীগ শিরোপা জিতে ও উচলে রানার্সআপ হয়ে সিজন শেষ করে।
১৯৯৬-৯৭ সিজনটি ওভারমার্স ও আয়াক্স উভয়ের জন্যই একটি ভুলে যাওয়ার মতো সিজন। ওভারমার্স ইঞ্জুরি থেকে ব্যাক করেন ১৯৯৬ সালের ২৮ আগস্ট। পুরো সিজনে ৩৫ ম্যাচে মাত্র ২ টি গোল ও এসিস্ট করেন ওভারমার্স। তার দল আয়াক্সও একটি ট্রফিলেস সিজন কাটায়।
আয়াক্সের হয়ে উচল জয়ের পর থেকেই বিশ্বফুটবলের ওভারমার্সের ট্যালেন্ট, স্পীড, ভিশন ও ড্রিবলিং এবিলিটি সম্পর্কে ভালো ধারণা পায়, উচল জয়ের পরেই ইউনাইটেড ও আর্সেনাল সহ বেশ কয়েকটি ইংলিশ ক্লাব তাদের আগ্রহ প্রকাশ করে। তখন না গেলেও ১৯৯৭ সালে ওভারমার্স আর্সেন ওয়েঙ্গারের আর্সেনালে যোগ দেন।
ওয়েঙ্গারের প্রিফারেবল ফরমেশন ছিলো ৪-৪-২ কিংবা ৪-৪-২ ডাবল সিক্স। এই ফরমেশনে ওভারমার্সের মেইন পজিশন হয় লেফট সাইডে ওয়াইড মিডফিল্ডার হিসেবে। এই ৪-৪-২ ফরমেশনে ফ্রন্ট টু এ ফ্রি রোলে থাকা বার্গক্যাম্প ডিপে ড্রপ করলে ফরমেশন হয় ৪-২-৩-১ এ। তখন ওভারমার্স লেফট মিডফিল্ডার কিংবা লেফট উইঙ্গার হিসেবে অপারেট করেন। তার ভার্সেটাইলিটির জন্য কিছু কিছু ম্যাচে ওয়েঙ্গার তাকে রাইট সাইডেও স্টার্ট করিয়েছেন। ঐ সময় প্রিমিয়ার লীগে যেসব টিম ৪-৪-২ এ খেলতো, বেশিরভাগ টিমের ওয়াইড মিডফিল্ডাররা সাধারণত ওয়াইডে থেকে চান্স ক্রিয়েশনেই ভূমিকা রাখতো। কিন্তু ওভারমার্স ওয়াইডে থাকার পাশাপাশি সেন্ট্রালি কাট ইন করে গোলেও শট করার চেষ্টা করতেন। তারই ফলাফল হিসেবে ঐ সিজনে ৩৯ ম্যাচে ১৫ গোল ও ৬ টি এসিস্ট।
ঐ সময় প্রিমিয়াল লীগে ইউনাইটেডের সোনালি সময় অতিবাহিত হচ্ছে। এর আগের ৫ সিজনের মধ্যে ৪ বারই চ্যাম্পিয়ন ইউনাইটেড, বাকি একবার রানার্সআপ। আর আর্সেনালের সর্বোচ্চ সাফল্য বলতে আগের বছর ৩য় হওয়া। সিজনের শুরুতে আর্সেনাল টেবিলের টপে উঠলেও বছরের শেষে ৫ম অবস্থানে নেমে আসে। ওভারমার্সেরও ফর্ম ডাউন হয়। কিন্তু নতুন বছরের শুরুতে ওভারমার্স ও তার দল উভয়েই ভালো সময়ের দেখা পায়। ১৯৯৮ সালের ১৪ মার্চ আর্সেনাল মুখোমুখি হয় ঐ সময়ের লীগ লীডার ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের। ম্যাচের ৮০ মিনিটে ওভারমার্সের গোলে জিতে যায় আর্সেনাল। এই জয়ে ৩ ম্যাচ কম খেলেই ইউনাইটেড থেকে মাত্র ৬ পয়েন্ট পেছনে থাকে আর্সেনাল। শেষ পর্যন্ত ৩ মে ১৯৯৮ প্রথমবারের মতো আর্সেনাল প্রিমিয়ার লীগ শিরোপা জিতে নেয়। এফ এ কাপের ফাইনালে ওভারমার্স ও আনেলকার গোলে নিউক্যাসলকে হারিয়ে ঘরোয়া ডাবল জিতে আর্সেনাল।
১৯৯৮-৯৯ ও ১৯৯৯-২০০০ টানা ২ টি সিজন ওভারমার্সের দল আর্সেনালকে শুধুমাত্র কমিউনিটি শিল্ড আর লীগে রানার্সআপ হয়েই খুশি থাকতে হয়। ১৯৯৯-২০০০ সিজনে ওভারমার্স ক্যারিয়ারের ২য় ইউরোপীয়ান শিরোপার কাছাকাছি গেলেও উয়েফা কাপের ফাইনালে গ্যালাতাসারাই এর কাছে টাইব্রেকারে হেরে যায় আর্সেনাল।
২০০০ সালের সামার ট্রান্সফার উইন্ডোতে তিনি ২৫ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফিতে বার্সেলোনায় যোগ দেন। তিনি ৪ বছর বার্সেলোনায় ছিলেন। ঐ সময়টায় বার্সায় চলছিলো পালাবদলের সময়। ৪ বছরে ৪ জন কোচের আন্ডারে খেলতে হয় ওভারমার্সকে। এছাড়া তার ক্যারিয়ারজুড়ে লেগে থাকা ইঞ্জুরি তো ছিলোই। ৪ বছরে ১৩১ টি ম্যাচে ১৭ টি গোল ও ১৬ টি এসিস্ট করেন ওভারমার্স। তার পুরো ক্যারিয়ারের সঙ্গী হাঁটুর ইঞ্জুরির কাছে হার মেনে ২০০৪ সালে ফুটবল থেকেই অবসর নিয়ে নেন তিনি। যদিও ২০০৮ সালে গো অ্যাহেড ঈগলসের হয়ে কামব্যাক করেছিলেন, কিন্তু হাঁটুর ইঞ্জুরির কারণে তা ১ সিজনের বেশি দীর্ঘায়িত হয়নি।

ওভারমার্স প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পান ১৯৯৩ সালে ১৯৯৪ বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ার ম্যাচে। মাঠে নামার ৫ মিনিটের মধ্যেই গোল করেন তিনি। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ দলে তিনি ডাক পান ও নেদারল্যান্ডসের ৫ টি ম্যাচেই খেলেছেন। গোল না পেলেও রাউন্ড অফ সিক্সটিনে আয়ারল্যান্ড ও কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে একটি করে এসিস্ট করেন। ব্রাজিলের বিপক্ষে হেরে নেদারল্যান্ডস বাদ পড়লেও তিনি টুর্নামেন্টের সেরা উদীয়মান ফুটবলার।
১৯৯৬ ইউরো কোয়ালিফায়ারে ইঞ্জুরিতে পড়ায় তিনি ১৯৯৬ ইউরো মিস করেন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের কোয়ালিফায়ারে তিনি ব্যাক করেন। বিশ্বকাপে ওভারমার্স ও নেদারল্যান্ডস উভয়েরই ভালো সূচনা হয়। কোন ম্যাচ না হেরেই উঠে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে। আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ম্যাচের আগে প্র্যাকটিসে তিনি ইঞ্জুরিতে পড়েন ও আর্জেন্টিনা ম্যাচ থেকে বাদ পড়েন, যদিও তিনি পরবর্তীতে মাঠে নামলেও সেটা ইঞ্জুরিকে আরো গুরুতর করে। ফলে ব্রাজিলের বিপক্ষে সেমিফাইনাল মিস করেন ও তার দল টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নেয়।
এই টাইব্রেকার ভাগ্য ওভারমার্সের পিছু ছাড়েনা ২০০০ ইউরোতেও। সেমিফাইনালে এবার ইতালির কাছে হেরে বিদায় নেয় ডাচরা। ২০০৪ ইউরোতেও সেমিফাইনালে উঠে ডাচরা। এবার পর্তুগালের কাছে ২-১ এ হেরে বিদায় নেয় ওভারমার্সরা। ঐ ম্যাচই হয়ে থাকে ওভারমার্সের ক্যারিয়ারের সর্বশেষ ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ। জাতীয় দলের হয়ে ৮৬ ম্যাচে করেন ১৭ গোল।
ওভারমার্সকে এক কথায় বলা যায় ইনভার্টেড উইঙ্গার ও ভার্সেটাইল উইঙ্গারদের পথিকৃৎ। আফসোস এটাই যে হাঁটুর ইঞ্জুরির কারণে তার থেকে তার বেস্টটা পাওয়া যায়নি। তার এক্সিলারেশন ও স্পীডের কারণে তাকে “TGV” ও “Roadrunner” নামে ডাকা হতো। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের রাইটব্যাক গ্যারি নেভিল বলেছিলেন ওভারমার্স তার ফেইস করা বেস্ট উইঙ্গার।
একমাত্র ইঞ্জুরিই তার ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ হতে দেয়নি। কে জানে, ইঞ্জুরিতে না পড়লে হয়তো তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা উইঙ্গারদের তালিকায় নিজেকে নিয়ে যেতেন।
Discussion about this post