আযমাইন রাফিন
‘মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়।’
অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্যের জন্য উপরের বাক্যটা বেশ জনপ্রিয়। বড় স্বপ্ন-ই যদি দেখতে না পারি, মানুষ হিসেবে বড় হবো কীভাবে! কিন্তু স্বপ্নটা কত বড় হওয়া উচিত? স্বপ্নের আকার বড় হতে হতে যদি অবাস্তবের কাতারে চলে যায়, তাহলে তা বাস্তবায়ন করা কি সম্ভব? এখন যদি বলি, ‘আমি পুরো পৃথিবীকে রুল করতে চাই্’, কেমন হাস্যকর আর বোকা বোকা শোনাবে না কথাগুলো?
কিন্তু ঠিক এই কথাটাই সাকিব আল হাসান বলেছিলেন আজ থেকে তেরো বছর আগে, ২০০৮ সালে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় একটি পত্রিকা থেকে বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের পুরস্কার গ্রহণের সময়ে তাঁর এই বক্তব্যটি বিশ বছর বয়সী এক তরুণের অপরিণত মস্তিষ্কের অসম্ভব কল্পনা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তেরো বার পঞ্জিকা বদলানোর পরে, বর্তমানে দাঁড়িয়ে আমরা দেখতে পাই, কী দারুণভাবে মিলে গেছে সাকিবের সেই বক্তব্যটি। ক্রিকেটের তিন সংস্করণেই শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডারের তালিকায় নিজের নাম স্থায়ী রাখা আর এক নামে ক্রিকেটবিশ্বে পরিচিতি পাওয়াটা তো পৃথিবী শাসন করার মতোই ব্যাপার।
অলিম্পিকে কখনো কোন পদক না পাওয়া সর্বাধিক জনসংখ্যাসমৃদ্ধ দেশের কোন ক্রীড়াবিদ যে কোন ক্ষেত্রে বিশ্বসেরা হবেন, সাকিব আল হাসানের আগে এই বিষয়টা তো শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্বের কাছেই অচেনা ছিল। সেই পরিস্থিতি থেকে নিজেকে ‘শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার’ প্রমাণ করেছেন সাকিব, পাশাপাশি এক নম্বর স্থানটা নিজের দখলে রাখতে রাখতে ‘বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার’ শব্দটাকেই কেমন ডালভাতের মতোই সাধারণ করে ফেলেছেন তিনি। সব্যসাচীদের তালিকায় সাকিবের শীর্ষে থাকাটা এখন কোন বড় খবর নয়, না থাকলেই বরং পত্রিকার শিরোনাম হয়।
অথচ বাংলাদেশ দলে সাকিবের আগমনটা নির্ভেজাল ব্যাটসম্যান হিসেবে, যিনি মাঝেমধ্যে হাতটাও ঘোরাতে পারেন। ’০৮ সালের নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের আগে কোচ জেমি সিডন্স হঠাৎ ঘোষণা দিলেন, সাকিবকে তিনি খেলাবেন বিশেষজ্ঞ স্পিনার হিসেবে। আগের ছয় টেস্টে মাত্র তিন উইকেট পাওয়া একজন খেলোয়াড়ের ওপর কোচের আস্থা দেখে চাঞ্চল্য দেখা দিলো ক্রিকেটাঙ্গনে। সাকিব অবশ্য নিজের কাজটা ভালোভাবেই করলেন। শুধু ভালোভাবে বললে কম বলা হবে, ৩৬ রানে ৭ উইকেট প্রাপ্তিকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলা যেতে পারে। অবশ্য সাকিব আল হাসান যে মানের ক্রিকেটার, এসব ‘অবিশ্বাস্য’ ব্যাপারও তাঁর জন্য সাধারণ ঘটনা। এখানে একটু বলে রাখি, মাগুরার কোন এক অখ্যাত মাঠে ক্রিকেট বল (কথ্য ভাষায় ‘কাঠের বল’) দিয়ে করা প্রথম বলে যিনি উইকেট পেতে পেরেন, অবিশ্বাস্য ব্যাপার-স্যাপার তাঁর জন্য গা-সওয়া বলে ধরে নেওয়াই যায়।
তবে বোলার সাকিব আল হাসানের নবজন্ম যদি হয় এই নিউজিল্যান্ড সিরিজে, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নবজন্ম হয়েছে ২০০৯ সালে, ত্রিদেশীয় সিরিজে। প্রথম ম্যাচে জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে বাংলাদেশ দলের টিম ম্যানেজমেন্ট শেষ ম্যাচের আগে হঠাৎ আবিষ্কার করলো, শ্রীলঙ্কাকে শুধু হারালেই চলবে না, হারাতে হবে বোনাস পয়েন্টসহ। একে তো সামনে মহাপরক্রমশালী শ্রীলঙ্কা, তার ওপর বোনাস পয়েন্টসহ জয়, এ যেন পিঠে একমণী বস্তা নিয়ে অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া এভারেস্ট জয়ের মতো সমীকরণ! কিন্তু এই অসম্ভবকে সম্ভব করলো বাংলাদেশ, অবশ্যই সাকিবের ব্যাটে চড়ে। ৬৯ বলে ৯২ রানের সেই ঝড়ো অপরাজিত ইনিংসটা সাজঘরে বসে মুগ্ধচোখে দেখেছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা, পরে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ঐ ম্যাচের পরই সাকিব অন্য প্লেয়ার হয়ে গেছে’।
বলছিলাম ২০০৯ সালের গল্প। সাকিবের প্রথম অধিনায়কত্ব প্রাপ্তিও ঐ বছরই এক নাটকীয় ঘটনার মাধ্যমে, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে। প্রথম টেস্টে বোলিং করতে গিয়ে ইনজুরিতে পড়লেন মাশরাফি, লিগামেন্ট ছিঁড়ে ছিটকে গেলেন সিরিজ থেকে। সহঅধিনায়ক হিসেবে সাকিবকেই তাই দায়িত্ব নিতে হলো। পরের গল্পটা একান্তই সাকিবের। দল জিতেছিল টেস্ট-ওয়ানডে সিরিজ, সাকিব জিতেছিলেন সিরিজসেরার পুরস্কার। শেষ টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ছক্কা মেরে ম্যাচ শেষ করে ড্রেসিংরুমে ফিরছেন, অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক সিরিজে এর চেয়ে বড় আর কী-ইবা স্বপ্ন দেখতে পারতেন সাকিব!
মাশরাফি ফেরার পর তাঁর কাছে অধিনায়কত্ব সঁপে দিয়ে আবার নিজের সহঅধিনায়ক পদে ফিরে যান সাকিব। কিন্তু অদৃষ্টের লেখা কে পড়তে পারে? নিউজিল্যান্ড সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে মাশরাফি আবার ইনজুরিতে পড়লেন, আবারও আপৎকালীন দায়িত্ব নিলেন সাকিব, আবারও বাজিমাত। নিউজিল্যান্ডকে ধবলধোলাই করলো বাংলাদেশ, সিরিজসেরা হলেন সাকিব। আতহার আলী খানের বদৌলতে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অভিধানে যুক্ত হলো নতুন শব্দ ‘বাংলাওয়াশ’।
‘সাকিব আল হাসান একজন অতিমানব, চাইলেই করতে পারেন যা ইচ্ছে।’
বক্তব্যটি আমার মনগড়া নয়, বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমের বাতাসে কান পাতলেই শোনা যায় এই ধরনের কথাবার্তা। অবশ্য দিনের পর দিন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে নিজেকে অন্যদের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে সাকিবই এই বিশ্বাসের পালে হাওয়া দিয়েছেন। ’১৭ এর অস্ট্রেলিয়া সিরিজের দিকে তাকানো যাক। প্রথম টেস্টের চতুর্থ দিনের খেলা যখন শুরু হবে, অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন ১৫৬ রান, বাংলাদেশের প্রয়োজন ৮ উইকেট। ক্রিজে স্মিথ-ওয়ার্নার ছিলেন বলে অস্ট্রেলিয়ার দিকেই যেন কিছুটা ঝুঁকে ছিল ম্যাচটা। কিন্তু সাকিব আল হাসান কী ভেবে নেমেছিলেন কে জানে! একের পর এক মারণাস্ত্র বের হতে লাগলো সাকিবের ঝোলা থেকে। ফলস্বরূপ চা বিরতির আগেই খতম অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ পেল স্মরণীয় জয়।
সাকিবের এমন ‘যা ইচ্ছে তাই’ ম্যাচের অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। ’১২ এশিয়া কাপে ব্যাটে-বলে স্মরণীয় পারফরম্যান্স দেখিয়ে শচীন-কোহলি-সাঙ্গা-জয়া-আফ্রিদিদের পেছনে ফেলে জিতেছিলেন টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার। ’১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহ্র সাথে ঐ অসাধারণ পার্টনারশিপের গল্প কী এত সহজে ভুলে যাওয়া যায়! কিংবা গত বিশ্বকাপে যে উপাখ্যান তিনি রচনা করলেন, ব্যাট হাতে ৬০৬ রান, বল হাতে ১১টি উইকেট, বিশ্বকাপের ইতিহাসেই তো নেই এমন কীর্তি! তাঁর অর্ধেক পারফরম্যান্সও যদি আর কয়েকজন করতে পারতেন, বাংলাদেশের সেমিফাইনালে যাওয়া কে ঠেকাতো? সাকিবও পেয়ে যেতেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়ের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। তবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পেলেও সাকিবের এমন অতিমানবীয় কীর্তি বিপুল প্রশংসা পেয়েছে ক্রিকেটবোদ্ধা ও বিশ্লেষকদের কাছে।
এ তো গেল বড় মঞ্চে সাকিবের পারফরম্যান্স, দ্বিপক্ষীয় কতগুলো সিরিজ যে সাকিবের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের সাক্ষী, তার ফিরিস্তি দিতে গেলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষ হয়ে যাবে। রান-উইকেট সংক্রান্ত রেকর্ডগুলো বাদই রাখলাম, ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের ফল হিসেবে ১৪ বার পেয়েছেন সিরিজসেরার পুরস্কার, টানা তিনটি বিশ্বকাপে খেলেছেন অলরাউন্ডারদের তালিকায় নিজের নাম লেখা অবস্থায়। শুধু তাই নয়, অবসরের আগেই সাকিব পেয়ে যান বৈশ্বিক ক্রিকেটের আইন প্রণেতা সংস্থা মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) এর সদস্যপদ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিব যেন রূপকথার রাজপুত্র।
কিন্তু জীবনটা রূপকথা নয়, সাকিবও নন সেই অবিসংবাদিত রাজপুত্র। পারফরম্যান্সের প্রশ্নে সাকিবের ধারেকাছেও কেউ নেই, পড়তি ফর্মের যুক্তি তাই সাকিবের সাথে যায় না। নিতান্ত চোটে না পড়লে, অথবা শৃঙ্খলাভঙ্গ না করলে দল থেকে বাদ পড়েননি সাকিব। শৃঙ্খলাভঙ্গ! সাকিবের ক্যারিয়ারের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে এই শৃঙ্খলাভঙ্গ আর বিতর্ক। বিতর্কের সাথে তাঁর গাঁটছড়া বাঁধার ঘটনা আজকের নয়। কখনো ড্রেসিংরুম থেকে গ্যালারিতে গিয়ে দর্শককে পিটিয়েছেন, কখনো ক্যামেরার সামনে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করেছেন, কখনো এড়িয়ে গেছেন বিশ্বকাপগামী দলের ফটোসেশন, কখনো পত্রিকায় কলাম লিখে সাবেক ক্রিকেটারদের ধুয়ে দিয়েছেন সাবেক ক্রিকেটারদের, আবার কখনো অনাপত্তিপত্র ছাড়াই উড়াল দিয়েছেন ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে। মোট কথা, প্রায় সবগুলো সম্ভাব্য উপায়ে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন প্রচলিত আইনকানুনকে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা নিয়মগুলোর প্রতি যেন তাঁর থোড়াই কেয়ার!
কিন্তু তবুও, সাকিব ‘সাকিব’ বলেই শাস্তি আর নিষিদ্ধের ফাঁড়া কাটিয়ে বারবার বীরের মতো ফিরে এসেছেন জাতীয় দলে। দুয়েকটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছিনা। ’১৪ সালের শেষ দিকে এনওসি ছাড়া ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জগামী বিমানে চড়ে বসেছিলেন সাকিব, ফলাফলে হয়েছিলেন নিষিদ্ধ। এরপর ফেরেন জিম্বাবুয়ে সফরে, ফিরেই একই টেস্টে সেঞ্চুরি আর দশ উইকেটের রেকর্ডে ইমরান-বোথামের পাশে বসেন সাকিব। ফটোসেশন-বিতর্ক মাথায় নিয়ে গিয়েছিলেন বিশ্বকাপে, অবশ্যই গণমাধ্যম আর জনগণের চক্ষুশূল হয়ে। অথচ বিশ্বকাপ শেষে সেই সাকিবই মহানায়ক, সবার চোখের মণি। আরেকটা উদাহরণ দিই, সর্বশেষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের ওয়ানুডে দিয়েই সাকিব ফিরলেন ফিক্সিং প্রস্তাব গোপনের অভিযোগে আইসিসির নিষেধাজ্ঞার পর। ঐ ওয়ানডে সিরিজের সেরা খেলোয়াড় কে ছিলেন? মনে করিয়ে দিচ্ছি, সাকিব আল হাসান।
সাকিবের মতো এত বড় মাপের ক্রিকেটার কেন এত বিতর্ক সৃষ্টি করেন, জানি না। হয়তো বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতেই তিনি নিজেকে নিংড়ে দিতে পারেন সর্বোচ্চ, হয়তো প্রতিকূল পরিবেশই বের করে আনে তাঁর ভেতরের সর্বোচ্চটাকে। অথবা সাকিব হয়তো জানেন, বিতর্ক আর সমালোচনাকে প্রশংসায় রূপান্তরের সক্ষমতা বাংলাদেশ দলে তাঁর মতো আর কারো নেই। দর্শক-সমর্থক-ক্রিকেটবোদ্ধারা তাই যতই বিরক্ত হোন না কেন, সাকিবের নামের সাথে বিতর্ক থাকতেই হবে। লাল-সবুজের জার্সিতে নিজেকে উজাড় করে দিতে বিতর্ক বোধ হয় তাঁর বড্ড প্রয়োজন। রাজহাঁসের মতো সমালোচনার পঙ্কিলে তিনি বিচরণ করেন, কিন্তু গা ঝাড়া দিতেই বেরিয়ে আসে তাঁর শ্বেত-শুভ্র রূপটি। সাকিবকে তাই সাকিবের মতো থাকতে দেওয়াই শ্রেয়।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে সাকিবের হাত ধরেই এসেছে ‘মহাতারকা’ শব্দটি। লাল-সবুজের ব্যাটে-বলে তাই তাঁর অবস্থান অমর, অক্ষয়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেও সমকালীন ক্ষেত্রে তিনি অন্যতম সেরা, সাকিবের জন্য পরবর্তী চ্যালেঞ্জ তাই ‘সমকাল’কে ছাপিয়ে সর্বকালের সেরাদের কাতারে নিজেকে নিয়ে যাওয়া। আর সেই জন্য ২০২৩ বিশ্বকাপের চেয়ে বড় মঞ্চ আর হতেই পারে না।
চ্যালেঞ্জটা নিচ্ছেন তো, সাকিব?
অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।
শুভ জন্মদিন, সাকিব আল হাসান!
Discussion about this post