খেলাধুলা ডেস্ক
ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ বেশ সমীহ আদায় করা দল বাংলাদেশ, তবে সেটি ঘরের মাঠে। বিদেশে খেলতে গেলেই জয় হয়ে যায় অধরা। নিউজিল্যান্ডের খেলতে গিয়েও অসহায় আত্মসমর্পণ টাইগারদের। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের তিনটিতেই হার সফরকারীদের। কিউইদের সঙ্গে হোয়াইট ওয়াশ হওয়ার পর অধিনায়ক তামিম ইকবাল বললেন, সমস্যাটা মূলত বিদেশের মাটিতে। দেশের বাইরে ধারাবাহিক নয় দল।
কিন্তু কিছু ভুলের কারণে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের তিনটিতেই হারতে হয়েছে তামিমের দলকে। কিছু পুরোনো ভুল নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন ভুল।
ফিল্ডিং:
ফিল্ডিংয়ে চাইলে ধারাবাহিক হওয়া সম্ভব। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ একদিন খুব দারুণ তো আরেক দিন একেবারে গড়পড়তা। ব্যাটিং, বোলিং খারাপ হলে তার প্রভাবও পড়ে ফিল্ডিংয়ে। দলের সেরা ফিল্ডারও সেদিন ভুল করেন। আর ম্যাচের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেও ফিল্ডারদের হাত ফসকায়। আর সফরটা বিদেশে হলে তো কথাই নেই।
নিউজিল্যান্ডে যেমন চিরায়ত ফিল্ডিং অধারাবাহিকতার সঙ্গে যোগ হয়েছে তীব্র বাতাস, আউটফিল্ড আর পরিষ্কার আকাশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ। আর মানিয়ে নিতে না নিতেই সিরিজ শেষ। ক্রাইস্টচার্চের দ্বিতীয় ওয়ানডেতে মাঝের ওভারে মাত্র ৯ বলের ব্যবধানে তিন ক্যাচ ফেলে বাংলাদেশ জেতা ম্যাচই ফেলে দিয়ে এসেছে। সঙ্গে গ্রাউন্ড ফিল্ডিংয়ের যাচ্ছেতাই অবস্থা তো আছেই। ঠিক ক্রাইস্টচার্চের ভুলগুলো ওয়েলিংটনের শেষ ম্যাচেও পুনরাবৃত্তি করেছে তামিমের দল। শেষ হওয়া ওয়ানডে সিরিজে ফিরে তাকালে সবার আগে এই ফিল্ডিং–ব্যর্থতাই চোখে ভাসবে।
ব্যাটিং:
ডানেডিনে আগে ব্যাট করে ১৩১ রানে অলআউট। ওয়েলিংটনে পরে ব্যাট করে ১৫৪ রানে অলআউট। মাঝের ক্রাইস্টচার্চ বাদ দিলে সিরিজজুড়ে বাংলাদেশের ব্যাটিং ছিল দিশেহারা। নিউজিল্যান্ডে প্রথম ১০-১৫ ওভার সিম, সুইং ও বাউন্স পাবেন বোলাররা। শুরুর ঝড়টা সামলে দিলেই নিউজিল্যান্ড যেন ব্যাটিং স্বর্গ। আর এই নিউজিল্যান্ড দলের ডেথ ওভার বোলিং সামর্থ্যও এর আগে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। ক্রাইস্টচার্চ ছাড়া কিউই বোলারদের পরীক্ষা নিতেই পারেনি বাংলাদেশ। ডানেডিন ও ওয়েলিংটনে শুরুতে টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের হারিয়ে পঙ্গু বাংলাদেশ। ক্রাইস্টচার্চে তামিম ৭৮ রানের ইনিংস খেললেও লিটন দাস ও সৌম্য সরকার থেকে কিছুই পায়নি বাংলাদেশ।
সাধারণত বিপদে পড়লে মুশফিকুর রহিমের ব্যাট বাংলাদেশকে রক্ষা করে। সেটি হয়নি তিন ম্যাচের একটি ম্যাচেও। ২৩, ৩৪ ও ২১—তিন ম্যাচেই মুশফিক আউট হয়েছেন থিতু হয়ে। নিউজিল্যান্ড পেসাররা মুশফিককে শর্ট বলে বেঁধেছেন। ইনসুইং বোলিংয়ে কৌশলের দুর্বলতাও আবার প্রকাশ্যে এনেছেন বোল্ট-হেনরিরা। পুরো সিরিজে ফুল লেংথের বল মুশফিক খেলেছেন সামনে পা কাভার বরাবর রেখে। অথচ সেরা ফর্মের মুশফিকের সামনে পা থাকে বোলার বরাবর।
রক্ষণাত্মক মানসিকতা:
সিরিজজুড়ে বাংলাদেশ দলের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত রক্ষণাত্মক মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে যে ধরনের ওয়ানডে খেলা দরকার, সেটি করেনি তামিমের দল। পরপর দুই ম্যাচে নিউজিল্যান্ড টপ অর্ডারে ধস নামানোর পর বাংলাদেশ কিউইদের বিশাল জুটি গড়তে দিয়েছে। ক্রাইস্টচার্চে যেমন দ্রুত তিন উইকেট তুলে নেওয়ার পর বাংলাদেশ ক্রিজে পায় দুই বাঁহাতি ডেভন কনওয়ে ও টম ল্যাথামকে। বাংলাদেশের ছিলেন দুই অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ ও মেহেদী হাসান। বাঁহাতির বিপক্ষে অফ স্পিন সব সময় আক্রমণে অস্ত্র। অথচ দুজনের বোলিংয়ের সময় তামিম লং অফ, লং অন বাইরে রেখেছেন। ল্যাথাম ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে সহজে নিয়েছেন ১-২ রান। তামিম হয়তো ভেবেছিলেন, বাউন্ডারি থামালে চাপে পড়ে ভুল শট খেলবেন দুই বাঁহাতি, যা সচরাচর বাংলাদেশি উইকেটে হয়ে থাকে। কিন্তু সেদিন সেটি হয়নি। ল্যাথাম থিতু হয়ে পরে করেছেন ম্যাচজয়ী সেঞ্চুরি। কিউইদের চেপে ধরার এমন সুবর্ণ সুযোগ তৃতীয় ম্যাচেও হাতছাড়া করেছে বাংলাদেশ।
দলের ভুল সমন্বয়
মেহেদী হাসান মিরাজ ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ছিলেন দলের সেরা বোলার। ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে চারেও উঠে এসেছেন সে সাফল্যে। নিউজিল্যান্ডে তিন ম্যাচে মোট ২১ ওভার করে তিনি কোনো উইকেট পাননি। কিউই টপ অর্ডারে একঝাঁক বাঁহাতি ব্যাটসম্যান পেয়েও তিনি ছিলেন বল হাতে ব্যর্থ। ব্যাটিংয়েও ছিলেন ব্যর্থ। তাঁর জায়গায় বাঁহাতি স্পিনার নাসুম আহমেদ খেললে হয়তো গল্পটা ভিন্ন হতে পারত। বাঁহাতি স্পিনে কিউইদের দুর্বলতা কার না জানা।
এ ছাড়া তৃতীয় ম্যাচের উইকেটে তো দুই স্পিনার খেলানোই ছিল ভুল। সবুজ ওয়েলিংটনে মিরাজের জায়গায় খেলতে পারতেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। মিরাজ বল করেছেন মাত্র ৫ ওভার। অথচ সৌম্য সরকারকে হাত ঘোরাতে হয়েছে ৮ ওভার। সাইফউদ্দিনের মতো একজন স্কোয়াডে থাকার পরও তাঁকে না নিয়ে মিরাজকে খেলানো তৃতীয় ম্যাচের উইকেটে অনেক বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
সুইং-হারা মোস্তাফিজ
নতুন মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন নিউজিল্যান্ডে বাংলাদেশের ভালো করার প্রধান হাতিয়ার। সিরিজ শুরুর আগে অধিনায়ক তামিম বলেছিলেন, ‘দলে যদি একজন পেসার নিতে হয়, তাহলে মোস্তাফিজের নাম সবার আগে থাকবে।’ সেই মোস্তাফিজের প্রথম কোনো বাংলাদেশি বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে তিন ম্যাচে ৮০–এর বেশি রান দেওয়ার অপ্রীতিকর রেকর্ড হয়ে গেছে আজ। নতুন করে নিজের বোলিংয়ে সুইং যোগ করে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দারুণ বোলিং করেছিলেন তিনি। ভালো করার প্রত্যাশার কারণ তাঁর এই সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স। কিন্তু নিউজিল্যান্ডে গিয়ে যেন সেই সুইং হারিয়ে বসেছেন তিনি। তিন ম্যাচ খেলে মোস্তাফিজের উইকেট মাত্র দুটি। একটি এসেছে ক্রাইস্টচার্চে নতুন বলের কাটারে। আরেকটি কাল ডেথ ওভারে। জানা গেছে, অনুশীলনে সুইং পেলেও কেন জানি ম্যাচে বলটা ডানহাতিদের ভেতরে আনতেই পারছেন না এই বাঁহাতি।
Discussion about this post