তাহসিন ইসলাম রুদ্র
দিনটা ছিলো ২৪ মে,২০১৪। ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগের ফাইনালে পর্তুগালের লিসবনে মুখোমুখি মাদ্রিদের দুই জায়ান্ট এটলেটিকো মাদ্রিদ আর রিয়াল মাদ্রিদ।
এটলেটিকো লড়ছিলো তাদের ১ম চ্যাম্পিয়নস লীগ টাইটেলের জন্য আর রিয়াল মাদ্রিদ লড়ছিলো তাদের স্বপ্নের লা ডেসিমার জন্য। ১২ বছর আগে ২০০২ এ চ্যাম্পিয়নস লীগ জয়ের পর এই শিরোপা রিয়ালের ততদিন আর ধরে দেখা হয়নি। সেদিনও হয়তো হতো না। কারণ তখন খেলা চলছিলো ৯৩ তম মিনিটের আর এটলেটিকো ১-০ তে এগিয়ে। আর কয়েকটা সেকেন্ড পার করলেই যে শিরোপা তাদের! এমন সময় কর্নার পায় রিয়াল। লুকা মদ্রিচ কর্নার নিতে প্রস্তুত। ঘড়ির কাটায় সময় এগিয়ে যাচ্ছে ৯২ঃ৪১, ৯২ঃ৪৩, ৯২ঃ৪৪…..। এথলেটিকো ফ্যানরা উল্লাসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলো। রিয়াল ফ্যানরা আরেকটি রাত হয়তো অশ্রুতে ভিজাতে যাচ্ছিলো। এমন সময় কর্নার নিলেন মদ্রিচ। সবার নজর বলের দিকে। বল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে গেলো। হয়তো এটলেটিকোর সমর্থকরা সেকেন্ডেরও কম সময়ে ভেবে নিয়েছিলেন যে জিতে গেছেন তারা। কিন্তু ফাঁকায় দাড়িয়ে থাকা সাদা জার্সির নাম্বার ফোর লাফিয়ে উঠলেন। মাথা দিয়ে বলটাকে ঠেলে দিলেন গোলের মুখে। বলটা খুঁজে নিলো নিজের গন্তব্য। ৯৩ তম মিনিটে খেলার ফলাফল ১-১। সমতা সূচক গোলটি করে সেদিন ম্যাচে ফিরিয়েছিলেন সার্জিও রামোস। আর ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত শেষ হয় রিয়ালের বিশাল ৪-১ গোলের জয়ে। ঘরে আসে স্বপ্নের লা ডেসিমা। সার্জিও রামোস শুধু সেদিন নয় এর আগে বা পরে আরও অনেক সুখকর মূহুর্তে উপহার দিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদ ফ্যানদের।
রামোসের গল্পের শুরুর জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই ১৯৮৬ সালের আজকের এই দিনে। স্পেনের আন্দুলুসিয়ার সেভিয়ার শহর কামাসে সেদিন জন্ম হয়েছিলো সার্জিও রামোসের। ছোট বেলা থেকে ফুটবলের সঙ্গীতটাকেই নিজের করে নিয়েছিলেন সার্জিও রামোস। আর সেই সঙ্গীতের অপরূপ সুর তুলা শুরু করেন মাত্র ৬ বছর বয়স থেকেই। নিজের শহর কামাস এফ.সি তে যোগদানের পর মাত্র ১০ বছর বয়সেই রামোসকে নিজেদের ইয়ুথ সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করে সেভিয়া। ১৯৯৬-২০০৪ এই সময়টা পার করেন সেভিয়াতেই। ২০০৪-২০০৫ সিজনে সেভিয়ার মূল দলে জায়গা করে নেন সার্জিও রামোস। তখন তার বয়স মাত্র ১৯। সেই সিজনে সেভিয়ার হয়ে ৩৯ ম্যাচ খেলেন রামোস। ডিফেন্ডার হয়েও গোল করেন ২ টি।
রামোসের মুগ্ধতা ছড়ানো ১ম সিজন নজর কাড়ে রিয়াল মাদ্রিদের। যেখানে গ্যালাকটিকো কিনে এনে দল গোছাতে ব্যস্ত রিয়াল সেখানে তারা দলে ভিরায় তরুণ তুর্কি সার্জিও রামোসকে। এরপরের ইতিহাস টা বোধহয় সবারই জানা। ২০০৫-২০২১ এই সময়টাতে রামোস জিতেছেন সবকিছু। হ্যাঁ সবকিছু। লা লীগা থেকে শুরু করে চ্যাম্পিয়নস লীগ, কিংবা ইউরো থেকে বিশ্বকাপ সবকিছুই নিজের করে নিয়েছেন রামোস এই ১৬ বছরে।

এরপরের সময়টা অর্থাৎ ২০০৯-২০১৫ ছিলো রামোসের প্রাইম টাইম। এই সময়ে রামোস নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা আর তার সময়ের সেরা ডিফেন্ডার হিসেবে। এ সময়েই রামোস স্পেনের হয়ে জিতেন বিশ্বকাপ আর ইউরো। রিয়ালের হয়ে জিতেন লা লীগা, কোপা দেল রে, ইউয়েফা সুপার কাপ, চ্যাম্পিয়নস লীগ। এক কথায় সবকিছু। প্রতিবছরই জায়গা করে নিয়েছিলেন ফিফা টিম অফ দ্য ইয়ারে।
২০১৫-২০২১ সময়টাতে যে রামোসকে দেখা যাচ্ছে একজন লিডারের ভূমিকায়। এই সময়ে রিয়াল মাদ্রিদকে নেতৃত্ব দিয়েছেন হ্যাট্রিক ইউসিএল জয়ে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন ৩৪ তম লা লীগা জয়েও। ২০১৮ সালে রোনালদো যাওয়ার পর ভঙ্গুর মাদ্রিদকে টেনে নিচ্ছেন নিজের কাধে। সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়াই যে নেতার পরিচয়। আর সেই নেতৃত্ব আর নেতার সবচাইতে বড় উদাহরণ সার্জিও রামোস।

আজ মাদ্রিদের রাজা ৩৫ পেরিয়ে ৩৬ এ পা দিলো। এ সময়ে রামোস জিতেছেন ৫ টা লা লীগা, ২ টি কোপা দেল রে,৪ টি স্পেনিশ সুপার কাপ, ৪ টি ইউয়েফা চ্যাম্পিয়নস লীগ, ৩ টি ইউয়েফা সুপার কাপ,৪ টি ক্লাব বিশ্বকাপ, ১ টি বিশ্বকাপ আর একটি ইউরো। ব্যক্তিগত অর্জন বলতে ২ বার জিতেছেন ইউয়েফা ডিফেন্ডার অফ দ্য ইয়ার খেতাব, ১২ বার ফিফা টিম অফ দ্য ইয়ারে জায়গা করে নিয়েছেন যা মেসি, রোনালদোর পর সর্বোচ্চ।
বুড়ো হতে চলেছেন মাদ্রিদের রাজা। রাজদণ্ডটা হয়তো অন্য কারো হাতে দিয়ে কিছু দিন পরই বনবাসে চলে যাবেন। কিন্তু রাজার যুদ্ধ জয়ের গল্প গেথে থাকবে প্রতিটা মানুষের মনে।
শুভ জন্মদিন, সার্জিও রামোস!
Discussion about this post