বিরাট কোহলি এ দুনিয়ার অন্যতম সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত ক্রীড়াবিদ। ক্রিকেটারদের মধ্যে শচীন টেন্ডুলকারই প্রথম দামি ফেরারি স্পোর্টস কার আমদানি করেছিলেন। মহেন্দ্র সিং ধোনি, সৌরভ গাঙ্গুলীরা তাঁদের গাড়ি সংগ্রহের জন্য বিখ্যাত। ক্রিস গেইলের এমন একটা ম্যানশন আছে, যেটির সঙ্গে কেবল একটি পাঁচ তারকা হোটেলেরই তুলনা চলে। বাংলাদেশ, পাকিস্তানের অনেক ক্রিকেটারই নিজেদের বাৎসরিক আয় কোটির ঘরেই দেখেন। ক্রিকেটের আয়ে নিজেদের আর্থিকভাবে ধনবান বানিয়ে ফেলা তারকারও অভাব নেই ক্রিকেট-দুনিয়ায়। উল্টো চিত্রটাও আছে। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন, খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট, কিন্তু খেলা ছাড়ার পর জীবন কাটছে সংগ্রাম করে। টাকা কামিয়েছেন, কিন্তু সে টাকা ধরে রাখতে পারেননি। ভুল বিনিয়োগ, বিপথে যাওয়া বা কোনো কারণে এখন অর্থকষ্ট আছেন—এমন অনেক ক্রিকেটারই আছেন। এঁদের মধ্য থেকে পাঁচজনের ধনী থেকে গরিব হওয়ার গল্পটা শুনুন…
আরশাদ খান
আরশাদ খানের কথা মনে আছে? পাকিস্তানের সেই অফ স্পিনার। দীর্ঘদেহী। একটু আলসে ভঙ্গিতে, প্রায় হেঁটে এসে বল ছুড়তেন। নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তানের হয়ে পাকিস্তানের হয়ে অভিষেক। খেলেছেন ২০০৪-০৫ মৌসুম পর্যন্ত। ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছেন ২০১১ পর্যন্ত। খুব সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার বলা যাবে না, ৯ টেস্টে ৩২ উইকেট আর ৫৮ ওয়ানডেতে ৫৬ উইকেট। নব্বইয়ের দশকে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগেও যথেষ্ট নিয়মিত ছিলেন তিনি। সেই আরশাদ খানের আর্থিক অবস্থা এখন যে খুব ভালো সেটি বলা যাবে না। অস্ট্রেলিয়াতে স্থায়ীভাবে বাস করছেন তিনি। কিন্তু সেখানে তাঁর জীবিকা ট্যাক্সি চালানো। দীর্ঘ দিন ক্রিকেট খেলার পর পাকিস্তানে অনেকেই আর্থিকভাবে লাভবান হন। বিশেষ করে যে খেলোয়াড়টি এক সময় নিয়মিত জাতীয় দলে খেলেছেন, তিনি তো হন-ই! কিন্তু আরশাদের হননি। ইদানীং ক্রিকেট কোচ হিসেবে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডে সাবেক টেস্ট ক্রিকেটারদের কদর থাকলেও আরশাদের বেলায় সেটিও হয়নি।
ম্যাথু সিনক্লেয়ার
তাঁকে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট মনে রাখবে অভিষেকেই ডাবল সেঞ্চুরির জন্য। দুর্দান্ত অর্জন ছিল সেটি। কিন্তু এর পরের ইতিহাসটা সুবিধের নয়। খেলেছেন মাত্র ৩৩টি টেস্ট। তাতে ৩২ গড়ে ১৬৩৫ রান সাকল্য সংগ্রহ। ডাবল সেঞ্চুরি দিয়ে শুরু করা খেলোয়াড়টির ক্যারিয়ারে সেঞ্চুরির সংখ্যাই মাত্র তিনটি। ৫৪ ওয়ানডেতে ২ সেঞ্চুরিতে ১৩০৪ রান তাঁর। মূলত অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম নেওয়া এই সিনক্লেয়ার মা’র সঙ্গে নিউজিল্যান্ডে চলে আসেন মাত্র ৫ বছর বয়সে। তাঁর বাবা মারা যান গাড়ি দুর্ঘটনায়। দলে অনিয়মিত হয়ে পড়ায় ২০১৩ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেন ক্ষুব্ধ হয়েই। এরপর তাঁর জীবনে নেমে আসে নানা সমস্যা। বেশ কিছু দিন কোনো কাজ ছাড়াই ছিলেন। গ্র্যাজুয়েশন না করার কারণে ভালো চাকরিও পাননি। সিনক্লেয়ারের এ মুহূর্তের জীবিকা একটি রিয়াল এস্টেট প্রতিষ্ঠানে। পদবি সেলসম্যান। সেই চাকরি দিয়ে বেশ কষ্টেই কাটে তাঁর দিনকাল
অ্যাডাম হোলিওক
১৯৯৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত মিনি বিশ্বকাপে (পরবর্তীকালে যেটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) ইংল্যান্ড দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ওয়ানডে দলের অধিনায়কত্ব পাওয়া এই অ্যাডাম হোলিওকের ছোট ভাই বেন হোলিওকও ইংল্যান্ডের হয়ে খেলেছেন। কিন্তু ২০০২ সালে এক মর্মান্তিক গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন তিনি। অ্যাডাম ২০০৭ সাল পর্যন্ত ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট খেলেছেন। এরপরই চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানে তাদের পারিবারিক ব্যবসা ছিল। সেটির দেখভাল করতে করতেই ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক মন্দা গ্রাস করে গোটা পৃথিবীকে। হোলিওকদের পারিবারিক ব্যবসাতেও আঘাত হানে নেই মন্দা। কিছুদিনের মধ্যেই দেউলিয়া হয়ে যান অ্যাডাম। যদিও খাদের কিনারা থেকে তিনি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। মার্শাল আর্টের শিক্ষক হিসেবে ছোট ছোট বাচ্চাদের প্রশিক্ষণ দেন তিনি। পাশাপাশি একটা চাকরিও করছেন।
জনার্দন নাভল
নামটা খুবই অপরিচিত। সেটিই স্বাভাবিক। তিনি যে খেলেছিলেন তিরিশের দশকে। ১৯৩২ সালে ভারতের অভিষেক টেস্টে তিনি ছিলেন দলের উইকেটরক্ষক। দেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম বলও খেলেন তিনি। লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টে তিনি দুই ইনিংসেই ভারতের পক্ষে ওপেন করেছিলেন। এরপর আর দুটি টেস্টই খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। এরপর বিস্তৃতির অতলে তলিয়ে যান তিনি। তাঁর সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। ১৯৭৯ সালে মারা যান তিনি। ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পর তাঁর বাকি জীবন কেটেছে একটি চিনিকলের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে। পুনের একটি দুই রুমের ফ্ল্যাটেই ছিল তাঁর শেষ জীবনের আবাস।
ক্রিস কেয়ার্নস
এক সময় বিশ্ব ক্রিকেটের হার্টথ্রবই ছিলেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার ছিলেন তিনি। কেবল তা-ই নয়, রিচার্ড হ্যাডলি, কপিল দেব, ইমরান খানদের কাতারে যাওয়ার সব সম্ভাবনাই ছিল। পারফরমার হিসেবেও ছিলেন দুর্দান্ত। কিন্তু অর্থলোভ তাঁকে নিয়ে গেছে আর্থিক দৈন্যের দিকে। ২০১০ সালের দিকে দুবাইয়ে ডায়মন্ড মার্চেন্ট হিসেবে বেশ ভালোই টাকা-পয়সা কামিয়েছিলেন। কিন্তু ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ তাঁর জীবন এলোমেলো করে দেয়। আইপিএলের সাবেক চেয়ারম্যান লোলিত মোদি তাঁর বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ আনলে কেয়ার্নস মামলা করেন। সেই মামলা জিতে ভালো অঙ্কের টাকা পান তিনি। কিন্তু পরের বছরই, ২০১৩ সালে তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে মিথ্যে সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। আম-ছালা সবই যায় তাঁর। সতীর্থদের সাক্ষ্যে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগও প্রমাণিত হয় তাঁর বিরুদ্ধে। এক সময় বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম বড় তারকার জীবন নাকি এখন কাটে নিউজিল্যান্ডে বাস স্টেশনের ছাদ পরিষ্কার করে। কী দুর্ভাগ্য!
Discussion about this post