আরিফুর রহমান বাবু
আচ্ছা! ১৯৭১ সালে আজকের দিনের সূর্যটিও কি এমন ছিল? নাকি তার লাল আভা আরও অনেক বেশি উজ্জ্বল ছিল? নিশ্চয়ই বেশি। সেদিনের সূর্য হয়তো অনেক গাঢ় লাল হয়ে উঠেছিল। ৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ভোরের পূব আকাশ ছিল লালে লাল। যে সূর্য কিরণের লাল আভায় রাঙ্গানো ছিল বাংলার আকাশ-বাতাস। সেটা ছিল বাংলাদেশের মানুষের বিজয়ের সূর্য। সেটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সকাল।
ঠিক এই দিনেই ৩০ লাখ শহীদের বুকের তাজা রক্ত এবং ৩ লাখ মা বোনের সম্ভ্রম হারানোর পর পাকিস্তানী হানাদার ও তার দোসর রাজাকার- আলবদরদের পরাজিত করে সবুজ গালিচা ভেদ করে বাংলার নীল আকাশে উদিত হয়েছিল বিজয়ের লাল সূর্য।
মোটকথা, শিল্প-সংস্কৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের ক্রীড়া প্রেম, অনুরাগ-ভালবাসাও প্রবল। মাঠে গিয়ে খেলা দেখায় বাংলাদেশের মানুষের জুড়ি মেলা ভার। নিজ দেশকে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে দেখার আগ্রহ, ইচ্ছে ও প্রত্যাশা প্রতিটি মানুষের।
তাই বিজয়ের শুভলগ্নে খেলাপ্রেমিরা হিসেব কষছেন, বিজয়ের ৫০ বছর পর ক্রীড়া ক্ষেত্রে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ? এই চার যুগের বেশি সময়ে দেশের ক্রীড়া সাফল্য কী কী? এ দীর্ঘ সময়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে কারা আলোকিত করেছেন? কাদের নৈপুণ্যের আলোকচ্ছ্বটায় আলোকিত হয়েছে ক্রীড়াঙ্গন?
সোজা সাপটা বললে হয়ত কানে লাগবে। শুনতে খারাপ শোনাবে, কিন্তু কঠিন সত্য হলো, বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে খেলাধুলা ভালবাসেন, জাতিগতভাবে খেলাধুলার প্রতি এ জাতির যে উৎসাহ- সে অনুপাতে গত ৫০ বছরে ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য নেহায়েত কম। অথচ এখনো আন্তর্জাতিক ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, শ্যুটিং, দাবা, আর্চারি, গলফ, সাঁতার, অ্যাথলেটিক্স, ভলিবলের কোন আন্তর্জাতিক আসর বসলেই সাড়া পড়ে যায় দেশে; কিন্তু কোন ইভেন্টেই ভক্ত-সমর্থকদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
৫০ বছরে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি এনে দিয়েছে ক্রিকেট
একমাত্র ক্রিকেট ছাড়া আর কোন খেলায় বাংলাদেশ এ দীর্ঘ সময়ে বিশ্ব পর্যায়ে যেতে পারেনি। ক্রিকেটেও যে কাঙ্খিত উন্নতি ঘটেছে তা নয়। কেনিয়া, স্কটল্যান্ড, হল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড পেছনে ফেলে ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি বিজয় আর ৯৯’তে প্রথম বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে হইচই ফেলে দেয়া বাংলাদেশ সে অর্থে খুব বেশি দুর এগুতে পারেনি।
২১ বছর ধরে টেস্ট খেলেও প্রত্যাশিত উন্নতি হয়নি। এখনো বিশ্ব ক্রিকেটে ঠিক প্রতিষ্ঠিত শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি বাংলাদেশ। মহাদেশীয় ও বৈশ্বিক আসরে বড়সড় সাফল্য বলতে যুবাদের বিশ্বকাপ জয়।
২০২০ সালের শুরুতে আকবর আলীর নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে ভারতীয় যুবাদের হারিয়ে তানজিদ তামিম, পারভেজ ইমন, মাহমুদুল হাসান জয়, শাহাদাত হোসেন জয়, শামীম পাটোয়ারী, রাকিবুল, তানজিম সাকিব আর শরিফুলরা উড়িয়েছেন বিজয়ের কেতন। যুবাদের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অনন্য কৃতিত্ব দেখায় বাংলাদেশ।
ছোটরা বিশ্ব বিজয়ী হলেও বড়রা এখনো ক্রিকেটে সেরাদের কাতারে যেতে পারেনি। তবে ২০১০ সালে চীনের গুয়াংজুতে এশিয়ান গেমস ক্রিকেটে স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব আছে বাংলাদেশের। বলার অপেক্ষা রাখে না সেই এশিয়াড ক্রিকেটে অংশ নেয়নি এশিয়া তথা বিশ্ব ক্রিকেটের দুই পরাশক্তি ভারত এবং পাকিস্তান।
আফগানিস্তানকে হারিয়ে এশিয়ান গেমস ক্রিকেটে প্রথমবার স্বর্ণ জেতে বাংলাদেশ। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘হারাধনের একটি ছেলের’ মত এশিয়ান গেমসে যে কোন ইভেন্ট ও ডিসিপ্লিনে সেটাই একমাত্র স্বর্ণ বাংলাদেশের।
যুবাদের মত বিশ্বসেরা হতে না পারলেও মহাদেশীয় পর্যায়ে নারী ক্রিকেট দলের আছে উল্লেখ করার মত সাফল্য। সালমা, রুমানা আর জাহানারাদের সে সাফল্যকে ছোট করে দেখার কোনোই উপায় নেই। এশিয়ান নারী ক্রিকেটের এক নম্বর শক্তি ও বিশ্বের অন্যতম সেরা নারী ক্রিকেট দল ভারতকে হারিয়েই ২০১৮ সালে এশীয় নারী ক্রিকেটের প্রথম শিরোপা জিতেছে বাংলাদেশ নারী দল।
বরং বিশ্ব ক্রিকেটে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই পুরুষ দলের। সর্বোচ্চ সাফল্য বলতে ২০১৭ সালের আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা। ভারতের সঙ্গে সেই সেমির যুদ্ধে পরাজয়ে ভাঙ্গে ফাইনাল খেলার স্বপ্ন। এর আগে ও পরে মোট ছয়বার বিশ্বকাপ খেললেও একবারের জন্য শেষ চারে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে ২০০৭ সালে সেরা আটে জায়গা হয়েছে। আর কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত যাওয়া মাত্র একবার; ২০১৫ সালে।
বৈশ্বিক আসরে ফাইনাল খেলাটা এখনো স্বপ্ন হয়ে থাকলেও মহাদেশীয় পর্যায়ে একবার দু’বার নয়, তিন-তিনবারের ফাইনালিস্ট বাংলাদেশ। ২০১২, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে তিনবার এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠলেও ক্রিকেটের শিরোপা অধরাই থেকে গেছে। প্রথমবার পাকিস্তানের কাছে আর পরের দুইবার ভারতের কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। মানে এখন পর্যন্ত এশিয়ান ক্রিকেটে সেরা হওয়ার কৃতিত্বটাও অধরা ।
দলীয় খেলা ক্রিকেট থেকেও ক্রীড়াঙ্গনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আকাশ ছোঁয়া সাফল্য আছে সাকিব আল হাসানের। এই দেশ বরেণ্য ও সব্যসাচী ক্রিকেটার দেশের ক্রিকেটকে এক অন্য মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন। আইসিসি র্যাংকিংয়ে একটানা প্রায় ১০ বছর বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারের তকমাধারী সাকিব। এছাড়া ২০১৯ সালের বিশ্বকাপে ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্টেরও দাবিদার ছিলেন সাকিব। অস্ট্রেলিয়া ছাড়া বাকি ৭ দেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নিউজিল্যান্ড, আফগানিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে পঞ্চাশের বেশি স্কোর করা সাকিব বিশ্বকাপে ৬০৫ রান করার পাশাপাশি ১১ উইকেট শিকারীও। বিশ্বকাপের ইতিহাসে এমন অলরাউন্ড কৃতিত্ব আর কারো নেই।
বিশ্বকাপের মত বিশ্বআসরে এমন অলরাউন্ড পারফরম্যান্স চাট্টিখানি কথা নয়। এছাড়া টেস্ট (৬ বার), ওয়ানডে (২৩ বার) আর টি-টোয়েন্টি (৯ বার) মিলে ৩৮ বার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যাচ সেরার অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারি সাকিব। তিন ফরম্যাটে বেশিবার ম্যান অব দ্য ম্যাচের তালিকায় সাকিবের অবস্থান ১৫ নম্বরে।
বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল
এইতো গেল ক্রিকেটের সাতকাহন। আসুন এবার দেখা যাক ফুটবলে কী অবস্থা?
সবার জানা খেলা পাগল বাংলাদেশের মানুষের ফুটবল প্রেম ও আকর্ষণ সর্বোচ্চ। সেটা বোঝা যায় বিশ্বকাপ আসলে। বিশ্বকাপ এলেই পাল্টে যায় পুরো দেশের চালচিত্র। নাগরিক জীবন যাত্রায় আসে ব্যাপক পরিবর্তন। গোটা জাতি মেতে ওঠে ফুটবল আনন্দে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস আর স্পেন-পর্তুগালের পতাকায় ছেয়ে যায় বাংলার আকাশ।
নিশ্চিত করে বলে দেয়া যায় বিশ্বকাপ না খেলা কোন দেশেই ফুটবল নিয়ে এমন উৎসাহ, উদ্দীপনা দেখা যায় না। ফুটবল এ দেশের মানুষের প্রাণের খেলা। নাড়ির আকর্ষণ। ৭০, ৮০ এবং ৯০-এর দশকে ঢাকাই ফুটবল ছিল জমজমাট। মোহামেডান, আবাহনী, বিজেএমসি আর ব্রাদার্সের খেলা মানেই ছিল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের গ্যালারি উপচে পড়া ভিড়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- সময়ের প্রবাহমানতায় সে ফুটবল ‘ক্রেজ’ কমেছে। তারপরও বিশ্বকাপ, ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়রশিপ, কোপা আমেরিকা আর ইউরোপীয় ক্লাব ফুটবল নিয়ে উৎসাহ একচুলও কমেনি মানুষের। রাত জেগে ওসব আসর দেখা অনেকেরই জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
দেশের ক্লাব ফুটবলের টানে মাঠে না আসলেও স্প্যানিশ, ইংলিশ, ইতালিয়ান, জার্মান ও ফরাসী ক্লাব ফুটবল দেখায় উৎসাহে কোনই ভাটা নেই বাংলাদেশের ফুটবল অনুরাগীদের।
কিন্তু হায়! যে দেশে ফুটবল এত জনপ্রিয়, সেই দেশ বিশ্ব ফুটবল অঙ্গনে কোন পর্যায় ও অবস্থানেই নেই। মহাদেশীয় পর্যায়ের ফুটবলেও অনেক নিচে বাংলাদেশ। এশিয়া কাপে কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল তো অলিক কল্পনা মহাদেশীয় ফুটবলের চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলার যোগ্যতা অর্জনই সম্ভব হয় না। সেই ১৯৮০ সালে সাকুল্যে একবার এশিয়া কাপের মূল পর্বে খেলতে কুয়েত গিয়েছিল জাতীয় দল।
মহাদেশীয় পর্যায়ে অনেকদুর পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশের ফুটবলে সাফল্য বলতে একবার করে সাফ ফুটবল আর এসএ গেমসে স্বর্ণ জয়।
১৯৯৯ সালে জুয়েল রানার অধিনায়কত্বে নেপালের মাটিতে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে দক্ষিণ এশীয় ফুটবলে প্রথমবার শ্রেষ্ঠত্ব দেখায় বাংলাদেশ। সেটা ছিল দক্ষিণ এশিয়ান গেমস মানে এসএ গেমস ফুটবলে।
স্বাধীনতার ঠিক দেড় যুগ পর স্ট্রাইকার আলফাজের একমাত্র গোলে ফুটবলে কাঙ্খিত সাফল্যর দেখা মেলে। এরপর ২০০৩ সালে সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকা তথা বাংলাদেশের ক্রীড়াকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে মালদ্বীপকে টাইব্রেকারে হারিয়ে দক্ষিণ এশীয় ফুটবল আসরে শেষ হাসি হাসেন রজনী কান্ত বর্মন, আমিনুল, হাসান আল মামুন, আরিফ খান জয়, ফরহাদ ও কাঞ্চনরা।
মালয়েশিয়ার মারদেকা টুর্নামেন্ট কিংবা থাইল্যান্ডের কিংস কাপের মত বড় আসরের শিরোপা জেতাও এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে। তবে ১৯৯৫ সালে মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে প্রথম মায়ানমারের মাটিতে স্বাগতিক মায়ানমারকে হারিয়ে ৪ জাতি টুর্নামেন্ট জিতেছিল বাংলাদেশ। সেটাও ফুটবলে সাফল্য হিসেবে পরিগণিত হয়।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খবর হলো বাংলাদেশের ফুটবলে যাদের ধরা হয় কালজয়ী তারকা। মেধা, মনন ও প্রজ্ঞায় যারা ছিলেন অসাধারণ। সেই জাকারিয়া পিন্টু, প্রতাপ শংকর হাজরা, গোলাম সারোয়ার টিপু, মেজর হাফিজ, নওশের, কায়কোবাদ, অমলেশ সেন, শামসু, কাজী সালাউদ্দিন, এনায়েতুর রহমান, শহিদুর রহমান চৌধুরী শান্টু, মনোয়ার হোসেন নান্নু, শামসুল আলম মঞ্জু, ছোট নাজির, গাজী, নীলু, মোতালেব, দেওয়ান শফিউল আরেফিন টুটুল, রামা লুসাই, হাসানুজ্জামান বাবলু, মহসিন, বাদল রায়, ওয়াসিম, চুন্নু, সালাম, আসলাম, সাব্বির, আনোয়ার, মহসিন (গোলকিপার), আবু ইউসুফ, আশিষ ভদ্র, খুরশিদ বাবুল, মোস্তফা কামাল, হাসান, রকিব, জোসি, গাফফার, আবুল, স্বপন ও কোহিনুরদের খেলা দেখতে মাঠে ছুটে যেতেন হাজার হাজার অনুরাগি ।
তাদের কিন্তু মহাদেশীয় আর দক্ষিণ এশীয় ফুটবলে কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য নেই। ওই একঝাঁক মেধাবি আর প্রচন্ড জনপ্রিয় ফুটবলাররা আন্তর্জাতিক ফুটবল মানে মহাদেশীয় ও দক্ষিণ এশীয় ফুটবলে জাতীয় দলের হয়ে কোন সোনালী সাফল্য বয়ে আনতে পারেননি।
বাংলাদেশের ফুটবলে ‘সুপার স্টারদের মধ্যে একমাত্র সোনালী সাফল্যর অধিকারী প্রয়াত মোনেম মুন্না। যার নেতৃত্বে ১৯৯৫ সালে স্বাগতিক মিয়ানমারকে হারিয়ে বাংলাদেশের আছে ৪ জাতি টুর্নামেন্ট জেতার রেকর্ড। ক্লাব ফুটবলেও মুন্না অসামান্য কৃতিত্বের অধিকারী। ৯০-এর দশকের শুরুতে কলকাতা লিগে ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে দুর্দান্ত খেলেছেন মুন্না। বাংলাদেশের ফুটবলারদের মধ্যে তার আগে কাজী সালাউদ্দিনও ৭০ দশকের মাঝামাঝি হংকং পেশাদার লিগে ক্যারোলিন হিল ক্লাবের হয়ে খেলেছেন; কিন্তু মুন্নার মত সুনাম অর্জন করতে পারেননি।
আহামরি সাফল্য হয়ত নেই। তারপরও ধীরে ধীরে উঠে আসছে নারী ফুটবল। বাংলাদেশের নারী অনুর্ধ্ব-১৬ দল একবার নয়, দুইবার (২০১৭ ও ২০১৯) এশিয়ার সেরা ৮ দলের মধ্যে জায়গা করে নিয়ে নজর কেড়েছে ।
ক্রিকেট-ফুটবলের পর সবচেয়ে জনপ্রিয় বাংলাদেশের হকি
জনপ্রিয়তাকে মানদণ্ড ধরলে ফুটবল-ক্রিকেটের পরই আছে হকি। বাংলাদেশ বোধকরি বিশ্বের হাতে গোনা অল্প কিছু দেশের একটি, যে দেশে ফুটবল, ক্রিকেট আর হকি প্রায় সমান জনপ্রিয়। সময়ের প্রবাহমানতায় যদিও জনপ্রিয়তা কমে গেছে। অথচ ৭০, ৮০ আর ৯০-এর দশকে হকি ছিল দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। সম্ভাবনাও ছিল বেশ।
তখন ভারত আর পাকিস্তানের জয় জয়কার। এই দুই দেশ হকির বিশ্ব শক্তি ছিল। দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া আর জাপান তখন বাংলাদেশের খুব কাছাকাছিই ছিল।
তার প্রমাণ ১৯৮৫’র এশিয়া কাপে পাকিস্তানের কাছে ৭-০ আর ভারতের কাছে ৮-১ গোলে পর্যদুস্ত হয়েছিল দক্ষিণ কোরিয়া। আর সেখানে চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তানের সঙ্গে সমান তালে লড়ে শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে মাত্র ১-০ ব্যবধানে হার মেনেছিল বাংলাদেশ।
১৯৮৫ সালে প্রথমবার এশিয়া কাপের আসর বসেছিল বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ঘাসের মাঠে প্রথম এশিয়া কাপে ভারত ও পাকিস্তানের বিশ্ব মানের তারকাদের নৈপুণ্যের দ্যুতি দেখে বাংলাদেশের মানুষের হকি প্রেম আরও প্রবল হয়েছিল। হকি চর্চা বেড়ে যায় বহুগুণে। কিন্তু সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা আর উদ্যমকে শক্তিতে কাজে লাগিয়ে হকিতে উন্নতি ঘটানো সম্ভব হয়নি।
মহাদেশীয় পর্যায় থেকে দক্ষিণ কোরিয়া আর মালয়েশিয়া বিশ্বমানে পৌঁছে গেলেও বাংলাদেশ এখনো এশিয়ান স্ট্যান্ডার্ডেই ছয়-সাত নম্বরে রয়ে গেছে। সম্ভাবনা ও সুযোগ থাকলেও একবারের জন্য এশীয় হকিতে কখনো পঞ্চমও হতে পারেনি বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদ
বিস্ময়কর হলেও ক্রিকেট ছাড়া বাংলাদেশ যে আর হাতে গোনা কটি ‘ডিসিপ্লিনে’ বড় সড় সাফল্য পেয়েছে, তার একটিও তেমন জনপ্রিয় নয়। সাধারণ খেলাপ্রেমিদের ওসব ডিসিপ্লিন নিয়ে উৎসাহ-আগ্রহ তুলনামূলক কম। চর্চাও খুব বেশি নয়। তারপরও দাবা, শ্যুটিং, আর্চারি আর গলফে এসেছে বড়সড় সাফল্য।
ওসব ডিসিপ্লিনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াবীদরা দেশকে উপহার দিয়েছেন অনেক বড় সাফল্য। তাদের ব্যক্তিগত সাফল্যে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে উজ্জ্বল হয়েছে দেশের ভাবমূর্তি।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাংলাদেশকে প্রথম সোনালী সাফল্য উপহার দিয়েছেন দেশ বরেণ্য দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদ। স্বাধীনতার ১৬ বছরের মাথায় ১৯৮৭ সালে দাবায় নিয়াজ মোর্শেদ এমন এক বড় সাফল্য দেখান, যা ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের এ যাবৎকালের অন্যতম সেরা অর্জন ও প্রাপ্তি হিসেবে পরিগণিত।
ওই সময় দাবায় গ্র্যান্ড মাস্টার হন নিয়াজ। ভাবছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিশ্বনাথন আনন্দ তো বিশ্বসেরা দাবাড়ু। তাহলে নিয়াজ কী তার চেয়েও বড় কিছু? শেষ পর্যন্ত নিজেকে বিশ্বনাথন আনন্দের পর্যায়ে নিয়ে যেতে না পারলেও নিয়াজের সামনেও সুযোগ ছিল দাবায় বিশ্বসেরা হওয়ার। কারণ তিনি শুধু বাংলাদেশেরই প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার নন, দক্ষিন এশিয়া তথা ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা মিলিয়ে প্রথম গ্র্যান্ড মাস্টার বাংলাদেশের নিয়াজ মোর্শেদ। তারও কয়েক বছর পর গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব পান বিশ্বনাথন আনন্দ।
শ্যুটিংয়ের আতিকুর রহমান ও আব্দুস সাত্তার নিনি
দেশ বরেণ্য দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদের গ্র্যান্ড মাস্টার হওয়া যদি হয় বিশ্বক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের প্রথম সোনালী সাফল্য, তাহলে দ্বিতীয় সাফল্যটি অবশ্যই দুই শ্যুটার আতিকুর রহমান আর আব্দুস সাত্তার নিনির। তারাও দেশের হয়ে শ্যুটিংয়ে অনেক বড় সাফল্য বয়ে এনেছেন।
১৯৯০ সালে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে কমনওয়েলথ গেমস পিস্তল শ্যুটিংয়ে স্বর্ন পদক বিজয়ী হন আতিক আর আব্দুস সাত্তার নিনি।
তখন দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ফুটবলের জয় জয়কার। ফুটবলের নামে নিয়মিত মাঠে ছুটে যেতেন অর্ধলক্ষ খেলাপ্রেশি। ক্রিকেট-হকির দিনকালও ছিল বেশ রমরমা। সে সময় শ্যুটিং নিয়ে সাধারণ ক্রীড়া অনুরাগীদের তেমন উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিল না। চর্চাও ছিল খুব সীমিত; কিন্তু তা ছাপিয়ে কমনওয়েলভুক্ত দেশ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, কানাডা, ভারত, নিউজিল্যান্ডের নামী শ্যুটারদের পিছনে ফেলে আতিক আর নিনির স্বর্ণ জয় ছিল সেই সময়ের আলোচিত ঘটনা ও বিরাট সাফল্য।
এরপর আরও একবার কমনওয়েলথ শ্যুটিংয়ে স্বর্ণ পদক বিজয়ের অনন্য কৃতিত্ব আছে আরেক মেধাবী বাংলাদেশি রাইফেল শ্যুটার আসিফ হোসেনের। ২০০২ সালে ম্যানচেস্টারে এয়ার রাইফেলে স্বর্ণ জিতেছিলেন আসিফ; কিন্তু তারপর আর আন্তর্জাতিক শ্যুটিংয়ে স্বর্ণের দেখা মেলেনি। তবে আরেক রাইফেল শ্যুটার আবদুল্লাহ হেল বাকি ২০১৪ আর ২০১৮’তে ওেই কমনওয়েলথ গেমস রাইফেল শ্যুটিংয়ে দু’বার রৌপ্য পদক জিতেছেন।
আরচারিতে রোমান সানা
দাবা আর শ্যুটিংয়ের পর আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সাফল্যটি আর্চার রোমান সানার। দেশসেরা এই আর্চার ২০১৯ সালে বিশ্ব আরচারিতে ব্রোঞ্জ পদক জিতে হই চই ফেলে দেন। সেই অভাবনীয় সাফল্য তাকে পৌঁছে দেয় এবার ২০২১ সালে টোকিং অলিম্পিক আরচারির মূল পর্বে অংশ গ্রহণের টিকিট।
গলফে সিদ্দিকুর রহমান
এছাড়া গলফার সিদ্দিকুর রহমানও দেশকে এনে দিয়েছেন বেশ কিছু সাফল্য। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও একাধিকবার এশিয়ান ট্যুরে রানার্সআপ হওয়ার কৃতিত্ব আছে সিদ্দিকুরের। আর শ্রীলঙ্কান, সিঙ্গাপুর ও থাই ওপেনের চ্যাম্পিয়ন হয়ে মহাদেশীয় গলফে নিজের নামকে সু-প্রতিষ্ঠিত করেছেন সিদ্দিকুর।
অ্যাথলেটিকস ও সাঁতারে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন যারা
এর বাইরে সাতারু মোশারফ, অ্যাথলেট শাহ আলম, মাহবুব, বিমল চন্দ্র আর বক্সার মোশারফও গত ৫০ বছরে দেশকে এনে দিয়েছেন কিছু সাফল্য। এর মধ্যে দেশ বরেণ্য সাঁতারু মোশারফ হোসেন ৯৩’র সাফ গেমসে (পরে এসএ গেমস) একাই ৫ টি স্বর্ণ জিতে সুইমিং পুলে ঝড় তুলেছিলেন।
মোশাররফের পরপরই যার নাম চলে আসে, তিনি খাট পাল্লার দৌড়বীদ শাহ আলম। মোটর সাইকেল অ্যাক্সিডেন্টে অকাল প্রয়াত শাহ আলম দু-দু’বার দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হওয়ার বিরল কৃতিত্ব দেখিয়ে এখনো ইতিহাসের পাতায় নিজের নামকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখে গেছেন তিনি।
এছাড়া আরও দুজন অ্যাথলেট দক্ষিণ এশীয় পর্যায়ে দেশকে উপহার দিয়েছেন সোনালী সাফল্য। তার একজন ৯৩’র ঢাকা সাফ গেমসে দ্রুততম মানব বিমল চন্দ্র রায় আর অন্যজন খাট পাল্লার দৌড়বীদ মাহবুব। তিনিও মাদ্রাজ সাফ গেমসে ২০০ মিটার দৌড়ে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। গত ৫০ বছর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আরও একটি ব্যক্তিগত সাফল্য আছে। তিনি বক্সার মোশারফ। ৮৬’র সিউল এশিয়াডে বক্সিংয়ে ব্রোঞ্জ পেয়েছেন এ বক্সার। এশিয়ান গেমসে সেটাই ছিল বাংলাদেশের প্রথম পদক।
বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান মোহাম্মদ আশরাফুল
ওপরে যাদের নাম বলা হলো, তার বাইরে আরও কজন ক্রিকেটারের নাম না বললে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সাতকাহন পূর্ণ হবে না। যার প্রথম নামটি মোহাম্মদ আশরাফুলের। এক পর্যায়ে ম্যাচ ও স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে নিন্দিত ও ধিকৃত হলেও টেস্ট অভিষেকে সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান আশরাফুল ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশের প্রথম তারকা।
এ নন্দিত উইলোবাজের ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্যের কার্ডিফে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ জেতানো শতকটি গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচ জেতানো ইনিংস হিসেবে পরিগণিত। পাশাপাশি দুই ব্যাটার তামিম ইকবাল ও মুশফিকুর রহিমও সাফল্য দিয়ে নিজেদের দেশের ক্রিকেটের দুই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে নিজেদের মেলে ধরেছেন। তাদের সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মিনহাজুল আবেদিন নান্নু, আমিনুল ইসলাম বুলবুল আর খালেদ মাহমুদ সুজনও ক্রিকেট অগ্রযাত্রায় রেখেছেন কার্যকর ভূমিকা।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের সত্যিকার অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজা
ব্যক্তিগত সাফল্য, অর্জন ও কৃতিত্বকে মানদন্ড ধরলে হয়তো সাকিব, তামিম ও মুশফিকের চেয়ে পিছিয়ে। কিন্তু দল হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার পিছনে যার নাম সবার আগে উঠে আসবে তিনি মাশরাফি বিন মর্তুজা। সন্দেহাতীতভাবেই দেশের ক্রিকেট অগ্রযাত্রায় একদম সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাশরাফি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সত্যিকার দিন বদলে পালা সূচিত হয় তার অধিনায়কত্বে। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট থেকেই শুরু। তারপর ঘরের মাঠে প্রথমে পাকিস্তান, পরে ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকার মত তিন-তিনটি পরাশক্তির বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ বিজয়ে মাশরাফিই ছিলেন টিম বাংলাদেশের ক্যাপ্টেন।
বৈশ্বিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের এ যাবতকালেল সবচেয়ে বড় সাফল্য হচ্ছে ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনাল খেলা। সেই মিশনে মাশরাফিই ছিলেন টাইগার ক্যাপ্টেন। তাই দেশের ক্রিকেট ও ক্রীড়াঙ্গনে নড়াইল এক্সপ্রেসও এক বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে। এছাড়া তার নেতৃত্বে ২০১৫ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছিল বাংলাদেশ।
৫০ বছরে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের সেরা তারকা কে?
তারকা ইমেজ আর জনপ্রিয়তাকে মানদণ্ড ধরলে ফুটবলার সালাউদ্দিন, এনায়েত, নান্নু, চুন্নু, টুটুল, ওয়াসিম, বাদল রায়, মুন্না, সাব্বির, কায়সার আর আসলাম, ক্রিকেটার নান্নু, আকরাম, রফিকুল আলম, গাজী আশরাফ লিপু, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, হকি খেলোয়াড় জামাল হায়দার, রামা লুসাই, জুম্মন লুসাই, মাহবুব হারুন, সাদেক ও কামালই হয়ত বেশি জনপ্রিয় ছিলেন।
তবে সাফল্য, অর্জন কৃতিত্ব এবং আন্তর্জাতিক পরিচিতির কথা ধরলে দাবাড়ু নিয়াজ মোর্শেদ, ক্রিকেটার সাকিব-মাশরাফি, শ্যুটার আতিকুর রহমান-আব্দুস সাত্তার নিনি, আর্চার রোমান সানা আর গলফার সিদ্দিকুর রহমানই গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের অগ্রগণ্য ক্রীড়াবিদ। সৌজন্যে-জাগো নিউজ
Discussion about this post