রফিকুল ইসলাম
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। পৃথিবীর মানচিত্রে সংযুক্ত হলো নতুন এক দেশ। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে ওই দিন লাল-সবুজের পতাকা উড়ায় বাংলার দামাল সন্তানেরা। আজ ১৬ ডিসেম্বর ২০২১। স্বাধীনতার ৫০ বছর পালন করছে জাতি।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ? এক সময়ের তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো যেই বাংলাদেশকে সেই বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, অনেক দেশের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শুরু হয়েছে নানা হিসাব-নিকাশ।
যুব ক্রিকেট দলের বিশ্বজয়
৫০ বছরে খেলাধুলায় বাংলাদেশের যে অর্জনগুলো আছে তার অন্যতম সেরা জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দলের বিশ্বকাপ জয়। ২০২০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত এই বিশ্বকাপের ফাইনালে বাংলাদেশ হারিয়েছিল ভারতকে। আগের আসরগুলোর মধ্যে চারবারের চ্যাম্পিয়ন ভারতীয় যুবাদের হারানো সহজ কাজ ছিল না। তাও আবার ফাইনালের মতো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা সে কাজটি করেছে দারুণভাবে। যে মিশনের নেতৃত্বে ছিল আকবর আলী।
এশিয়ান গেমসে প্রথম পদক
স্বাধীনতার ৫০ বছরের আরেকটি বড় অর্জন এশিয়ান গেমসে প্রথম পদক। এশিয়ার অলিম্পিক হিসেবে পরিচিত এই গেমসে বাংলাদেশ অংশ নেয় ১৯৭৮ সাল থেকে। তবে বাংলাদেশ প্রথম পদকের মুখ দেখে ১৯৮৬ সালে। সিউল এশিয়াডে বক্সার মোশারফ হোসেন লাইট হেভিওয়েট ৮১ কেজিতে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন। এখন পর্যন্ত ওটাই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তিগত পদক। এর পর কাবাডিতে পদক জিতেছে বাংলাদেশ, ক্রিকেটের মাধ্যমে স্বর্ণও এসেছে। তবে মোশারফ হোসেনের প্রথম পদক অর্জন ইতিহাস হয়েই থাকবে।
প্রথম আন্তর্জাতিক পদক
বক্সিংয়ের মাধ্যমে যেমন বাংলাদেশ প্রথম এশিয়ান গেমসে পদক পেয়েছিল, তেমন তার আগে এই ডিসিপ্লিনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ পেয়েছিল প্রথম আন্তর্জাতিক পদক ১৯৭৭ সালে। আবদুল হালিম জাকার্তায় লাইট ফ্লাই ওয়েটে ১০৫ পাউন্ড ওজন শ্রেণিতে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন বাংলার মোহাম্মদ আলী খ্যাত আবদুল হালিম।
অলিম্পিকে পদক জয়ের স্বপ্ন দেখা
অলিম্পিকে পদক জয় থেকে এখনো যোজন যোজন দূরে বাংলাদেশ। তবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও মর্যাদার এই আসরে বাংলাদেশ পদক জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। আর অলিম্পিকে পদক জয়ের স্বপ্নটা দেখিয়েছে আরচারি। ওয়ার্ল্ড আরচারি চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জিতে কোয়ালিফাই করে টোকিও অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন রোমান সানা। এই প্রথম বাংলাদেশের কোনো ক্রীড়াবিদকে ঘিরে অলিম্পিকে পদক জয়ের আশার কথা মুখ থেকে বেরিয়েছিল ক্রীড়া সংগঠকদের মধ্যে।
গলফ দুনিয়ায় বাংলাদেশ
গলফ অভিজাতদের খেলা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশেও গলফ খেলা হয়। তবে এ দেশের কোন খেলোয়াড় বাংলাদেশকে গলফ দুনিয়ায় নিয়ে যাবেন সেটা ছিল কল্পনারও বাইরে। বলবয় থেকে এশিয়া জয় করে সিদ্দিকুর রহমান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নাম ছড়িয়েছেন। ২০১০ সালে ব্রুনাইয়ে এবং ২০১৩ সালে দিল্লিতে এশিয়ান ট্যুর জিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে প্রথম বাংলাদেশি ক্রীড়াবিদ হিসেবে সরাসরি অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন সিদ্দিকুর রহমান।
টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন
ক্রিকেটে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জন করে ২০০০ সালে। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয় ওই বছরের ১০ নভেম্বর ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে। দেশের খেলাধুলার ইতিহাসে অনন্য দুটি দিন হয়ে থাকবে ক্রিকেটের টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া এবং টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার দিনগুলো। বাংলাদেশ অভিষেক টেস্ট খেলেছিল বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ভারতের বিপক্ষে।
ফুটবলে প্রথম ট্রফি
বাংলাদেশে ফুটবল ঐতিহ্য বহুদিনের। ফুটবল বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের খেলা। অথচ বাংলাদেশ একটি ট্রফির জন্য হাপিত্যেশ করেছে অনেকদিন। বাংলাদেশের মানুষ ফুটবল নিয়ে যতটা আবেগি তার চেয়ে প্রাপ্তি অনেক কম। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ দু’বার সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জিতেছে, একবার জিতেছে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ। তবে ফুটবলে বাংলাদেশ প্রথম ট্রফি জেতে ১৯৯৫ সালে মিয়ানমারে। মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রথম ট্রফি জেতে ওই বছরে। আর এসএ গেমসে প্রথম স্বর্ণ জেতে ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডুতে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম চ্যাম্পিয়ন ২০০৩ সালে।
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে অভিষেক
১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে ওঠার পর বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত হয়। তারপর বাংলাদেশ আইসিসি চ্যাম্পিয়নও হয়। এর দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথম অংশ নেয় বাংলাদেশ। অভিষেক আসরে বাংলাদেশ হারিয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানকে। ক্রিকেট বিশ্ব কেঁপে উঠেছিল টাইগারদের নৈপূণ্যের।
গিনেস বুক অব রেকর্ডসে টেনিসের রাজকন্যা
জোবেরা রহমান লিনুকে বলা হয় দেশের টেবিল টেনিসের রাজকন্যা। এই কিংবন্তী টানা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে নাম লিখিয়েছিলেন গিনেস বুক অব রেকর্ডসে। তিনি ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের কোনো নারীরই টানা ১৬ বার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড নেই লিনু ছাড়া। ২০০১ সালে তিনি জিতেছিলেন ১৬ তম শিরোপা। গিনেস বুক অব রেকর্ডসে তার নাম উঠেছিল ২০০২ সালে।
প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণ জয়ী নারী
বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন শ্যুটার কাজী শাহানা পারভীন। ১৯৯১ সালে কলম্বো এসএ গেমসে (তৎকালীন সাফ গেমস) পদক জিতেছিলেন এই তারকা নারী শ্যুটার। ওইবারই প্রথম এসএ গেমসে শ্যুটিং অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল। এই শ্যুটিংয়েই বাংলাদেশ বেশি পদক পেয়েছে এসএ গেমস থেকে।
দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব
দু’ দু’বার দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হয়েছিলেন মো. শাহ আলম। তিনি ১৯৮৫ সালে ঢাকায় ও ১৯৮৭ সালে দিল্লিতে সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জিতেছিলেন। শাহ আলম ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জতিক মিটেও স্বর্ণ পেয়েছিলেন। তবে সেটা এককভাবে নয়, রিলেতে। ১৯৮৪ সালে কলম্বো সাফ গেমসে চার গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে বাংলাদেশ দলের সদস্য হিসেবে স্বর্ণ জিতেছিলেন শাহ আলম।
উপমহাদেশের প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার
১৯৮৭ সালে উপমহাদেশের প্রথম দাবাড়ু হিসেবে গ্র্যান্ডমাস্টার খ্যাতি অর্জন করেছিলেন নিয়াজ মোরশেদ। এরপর বাংলাদেশ আরো চারজন গ্র্যান্ডমাস্টার পেয়েছেন। তবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব অর্জনে ইতিমহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন নিয়াজ মোরশেদ।
তিনবার ব্রিটিশ মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়ন
দেশের দাবার রানীখ্যাত রানী হামিদ টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন ব্রিটিশ নারী দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে। এরপর আর কোনো নারী দাবাড়ু এই কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার রানী হামিদ এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন দাবার অঙ্গন। ৭৬ বছর বয়সে তিনি জিতেছেন ক্যারিয়ারের ২০ তম জাতীয় চ্যাম্পিয়শি
প্রথম পেশাদার ফুটবলার
দেশের প্রথম পেশাদার ফুটবলার হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন কাজী মো.সালাউদ্দিন। তিনি ১৯৭৫ সালে হংকংয়ের প্রফেশনাল লিগে অংশ নিয়েছিলেন এফসি ক্যারোলিনের হয়ে। দেশের প্রথম নারী ফুটবলার হিসেবে বিদেশের ক্লাবে খেলেছেন সাবিনা খাতুন। ২০১৫ সালে তিনি মালদ্বীপের ঘরোয়া ফুটবলে খেলেছেন।
ফিফার নির্বাহী কমিটিতে বাংলাদেশের নারী
বাংলাদেশের প্রথম সংগঠক হিসেবে ফিফার নির্বাহী কমিটির সদস্য হয়েছেন মাহফুজা আক্তার কিরণ। তিনি প্রথমবার ফিফার কাউন্সিল মেম্বার হয়েছিলেন ২০১৭ সালে। ভোটে হারিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান প্রতিপক্ষকে। দ্বিতীয়বার তিনি ফিফার সদস্য নির্বাচিত হন ২০১৯ সালে। দ্বিতীয়বার তিনি হারিয়েছেন উত্তর কোরিয়ান প্রতিপক্ষকে।
শ্যুটিংয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক পদক
আতিকুর রহমান ও আবদুস সাত্তার নিনি ১৯৯০ সালে অকল্যান্ড কমনওয়েলথ গেমসে জিতেছিলেন ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে দলগত ইভেন্টের স্বর্ণ। এটাই বাংলাদেশের কোন শ্যুটারের প্রথম আন্তর্জাতিক স্বর্ণ জয়।
তিন ফরম্যাটেই শীর্ষে বাংলাদেশের ক্রিকেটার
সাকিব হাসান। এক কথায় তাকে বলা হয় বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার। তিনিই একমাত্র ক্রিকেটার যিনি ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই একসঙ্গে আইসিসি র্যাংকিংয়ে সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন। ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি প্রথম ওয়ানডে অলরাউন্ডারের শীর্ষস্থান অর্জন করে তিনি। ২০০৯ সালেই আইসিসির টেস্ট প্লেয়ার অব দ্য ইয়ার এবং ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ারের জন্য মনোনীতদের তালিকায় নাম ওঠে সাকিবের। একই বছর ক্রিকেটের বাইবেলখ্যাত দ্য উইজডন ক্রিকেটার্স অ্যালমানাকের বর্ষসেরা টেস্ট ক্রিকেটার নির্বাচিত হন তিনি। ২০১১ সালে সাকিব উঠে আসেন টেস্ট র্যাংকিংয়ে অলরাউন্ডারদের শীর্ষে। ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে আইসিসির তিন ফরম্যাটেই অলরাউন্ডারদের র্যাংকিংয়ে শীর্ষে উঠে আসেন সাকিব।
প্রথমবার মেয়েরা বিশ্বকাপ ক্রিকেটে
২০২২ সালে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিতব্য ওয়ানডে বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলবে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা। চলতি বছর নভেম্বরেই জিম্বাবুয়েতে অনুষ্ঠিত বাছাই পর্ব থেকে নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে বাংলাদেশের নারীরা। পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে দুর্দান্ত সূচনা করার পর অবশ্য পুরো বাছাই পর্ব শেষ করা যায়নি। করোনার নতুন ধরণ ওমিক্রনের প্রভাবে বাছাই পর্ব বাতিল ঘোষণা করা হয় এবং র্যাংকিংয়ের ভিত্তিতে বিশ্বকাপের দল নির্বাচন করা হয়। বাংলাদেশের নারীরা র্যাংকিংয়ে রয়েছে ৫ নম্বরে।
মেয়েদের হাত ধরে ক্রিকেটে প্রথম ট্রফি
ছেলেদের ক্রিকেটে অনেক দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ জয় হয়েছে; কিন্তু দুইয়ের অধিক কোনো দেশকে নিয়ে আয়োজিত টুর্নামেন্টের শিরোপা কখনো জিততে (২০১৯ সালের আগে) পারেনি বাংলাদেশ। কয়েকবার এশিয়া কাপের ফাইনালেও খেলা হয়েছে; কিন্তু শিরোপা জয় সম্ভব হয়নি। ছেলেদের ক্রিকেটের সেই আক্ষেপ প্রথমবারের মত ঘুচিয়ে দেয় নারী ক্রিকেটাররা। ২০১৮ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত নারীদের এশিয়া কাপের সপ্তম আসরে ভারতের মত শক্তিশালী দেশকে তিন উইকেটে হারিয়ে প্রথম কোনো শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। এবং সেই শিরোপা এলো নারীদের হাত ধরে। বাংলাদেশ সেবার প্রথম উঠেছিল ফাইনালে আর ভারত সাত আসরের সবগুলোতেই খেলে ফাইনাল। ভারত আগের ৬বার ফাইনাল জিতে নিলেও প্রথমবার হেরে যায় বাংলাদেশের কাছে। সৌজন্যে-জাগো নিউজ
Discussion about this post