খেলাধূলা ডেস্ক
দেশে কিংবা বিদেশে, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট ক্রিকেটে কখনও জয়ের দেখা পায়নি বাংলাদেশ। সাফল্য বলতে ঘরের মাঠে পাওয়া ড্র। নিউজিল্যান্ডের মাটিতে গিয়ে সেই ড্র করাটাও যেন দূরের মরীচিকা। সেই বাংলাদেশই এখন জাগিয়েছে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট জয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের বে ওভালে সিরিজের প্রথম টেস্টের চার দিন শেষে চালকের আসনে রয়েছে বাংলাদেশই। ম্যাচের চতুর্থ দিন শেষে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ ৫ উইকেটে ১৪৭ রান। তাদের লিড এখন ১৭ রানের, হাতে আছে আর ৫টি উইকেট।
বুধবার ম্যাচের শেষ দিনে নিউজিল্যান্ডকে দ্রুত অলআউট করে দিয়ে সেই লক্ষ্য তাড়া করতে পারলেই ইতিহাসগড়া জয় পেয়ে যাবে বাংলাদেশ। আর এজন্য দরকার বোলিংয়ে আরও একটি ভালো সেশন। যা এনে দেবে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেও বাংলাদেশের প্রথম জয়।
বাংলাদেশের আশা ছিল প্রথম ইনিংসে দেড়শ রানের লিড নেওয়ার। অল্পের জন্য তা হয়নি। তবে বছরের প্রথম টেস্টে রেকর্ড গড়ে বড় লিডই পেয়েছে বাংলাদেশ দল। স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের চেয়ে ১৩০ রান বেশি করে থেমেছে বাংলাদেশের প্রথম ইনিংস। নিজেদের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ওভার ব্যাটিংয়ের রেকর্ড গড়েছে মুমিনুল হকের দল।
আগের দিন ৬ উইকেটে ৪০১ রান নিয়ে খেলা শেষ করেছিল বাংলাদেশ। আজ এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও ৫৭ রান। মেহেদি হাসান মিরাজ ৪৭ ও ইয়াসির আলি রাব্বি ২৬ রান করলে ৪৫৮ রানে অলআউট হয় সফরকারীরা। বিদেশের মাটিতে এই প্রথম বাংলাদেশের প্রথম আট ব্যাটার ৫০+ বল খেলার রেকর্ড গড়লো।
মঙ্গলবার দিনের শুরুতেই সাজঘরে ফিরে যেতে পারতেন মেহেদি হাসান মিরাজ। সাত বলের ব্যবধানে দুইবার রিভিউ নিয়ে নিজের উইকেট বাঁচান তিনি। প্রথমে রাচিন রবীন্দ্র ও কাইল জেমিসনের ওভারে লেগ বিফোর আউট দেওয়া হয় মিরাজকে। দুইবারই রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান মিরাজ।
শুরুতেই দুইবার বেঁচে যাওয়ার পর ইয়াসির ও মিরাজ দেখেশুনে পার করে দেন দিনের প্রথম ঘণ্টা। উইকেটের খোঁজে থাকা নিউজিল্যান্ড ১৬০ ওভার হতেই নিয়ে নেয় তৃতীয় নতুন বল। তাতেও মেলেনি সাফল্য। ইয়াসির-মিরাজ দৃষ্টিনন্দন কিছু শট খেলে বাংলাদেশের লিড ১০০ পার করে দেন।
মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে অতিরিক্ত সূর্যতাপের কারণে একপর্যায়ে সানগ্লাস নিয়ে ব্যাটিং করতে হয়েছে মিরাজকে। তবে সেটিও ঘেমে যাওয়ায় চার বলই ফেরত দিতে হয়েছে ড্রেসিংরুমে। সাবলীল ব্যাটে ফিফটির আশা জাগিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাকে তা করতে দেননি টিম সাউদি।
মিরাজকে উইকেটের পেছনে ক্যাচ বানিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে লম্বা সময় পর সাফল্যের দেখা পান সাউদি। আউট হওয়ার আগে ৮ চারের মারে ৮৮ বলে ৪৭ রান করেন মিরাজ। তার বিদায়ে ভাঙে ৭৫ রানের সপ্তম উইকেট জুটি। এরপর আর ১৩ রান তুলতেই অলআউট হয় বাংলাদেশ।
ইয়াসির রাব্বির ব্যাট থেকে আসে ৮৫ বলে ২৬ রান। নিউজিল্যান্ডের ট্রেন্ট বোল্ট ৪, নেইল ওয়াগনার ৩, টিম সাউদি ২ ও কাইল জেমিসন নেন ১টি উইকেট।
১৩০ রানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নেমে শুরুটা বেশ ভালোই করেছিল নিউজিল্যান্ড। ইনিংসের প্রথম ৮ ওভারে স্কোরবোর্ডে যোগ করে ফেলে ২৫ রান। তবে নবম ওভারেই ১৪ রান করা লাথামকে বোল্ড করে দেন তাসকিন আহমেদ। আউট হওয়ার আগে কিউই অধিনায়ক করেন ১৪ রান।
এরপর আক্রমণে এসে দারুণ বোলিং করতে থাকেন এবাদত। ইয়ং-কনওয়ের বেশ ভালো পরীক্ষা নেন তিনি। দুইবার ইয়ংয়ের ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল স্লিপ অঞ্চল দিয়ে সীমানায় চলে যায়। একবার তার থাই প্যাডে লেগে বল জমা পড়ে লিটন দাসের গ্লাভসে। সেটিতে রিভিউ নিয়ে হতাশ হয় বাংলাদেশ।
তবে ইনিংসের ২৫তম ওভারে আর হতাশ হতে হয়নি। এবাদতের করা সেই ওভারের দ্বিতীয় বলে কনওয়ের বিরুদ্ধে লেগ বিফোরের জোরালো আবেদন করে বাংলাদেশ। তবে সাড়া দেননি আম্পায়ার। রিভিউ নেয় বাংলাদেশ। রিপ্লে’তে দেখা যায় বল প্যাডে আঘাত হানার আগে লেগেছে ব্যাটের ভেতরের কানায়।
কিন্তু প্যাডে আঘাত হানার পর গালি অঞ্চলের দিকে উড়ে যাওয়া বল সামনের দিকে ঝাঁপিয়ে তালুবন্দী করেন সাদমান। ফলে লেগ বিফোর না হলেও, ক্যাচ আউট পেয়ে যায় বাংলাদেশ। ফলে দলীয় ৬৩ রানে ভাঙে দ্বিতীয় উইকেট জুটি। কনওয়ের ব্যাট থেকে আসে ১৩ রান।
এক ওভার পর আরেক ওপেনার উইল ইয়ংকে বোকা বানিয়েছিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ। কিন্তু তার ব্যাটের ভেতরের কানায় লাগা বলটি গ্লাভসে নিতে পারেননি উইকেটরক্ষক লিটন। ফলে ৩১ রানে জীবন পেয়ে যান প্রথম ইনিংসে ৫২ রানের ইনিংস খেলা ইয়ং।
দ্বিতীয় সেশনের বাকি সময়টা নির্বিঘ্নেই পার করেন ইয়ং ও রস টেলর। তৃতীয় সেশনেও বোলিংয়ে দাপট দেখায় বাংলাদেশ। কিন্তু ফিল্ডিং ও রিভিউ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখায় অপরিপক্কতা। ইয়ংয়ের থাই প্যাডে লাগা বলে কট বিহাইন্ড এবং টেলরের মাঝ ব্যাটে লাগা বলে লেগ বিফোরের রিভিউ নেয় বাংলাদেশ। দুইটির একটিতেও মেলেনি সফলতা।
শুধু রিভিউ বিভ্রাটই নয়, ফিল্ডিংয়েও হ-য-ব-র-ল অবস্থা করে টাইগাররা। ইনিংসের ৪২তম ওভারে মিরাজের বলে তুলে মেরেছিলেন টেলর। ডিপ মিড উইকেটে সহজ ক্যাচের সুযোগ ছিল সাদমান ইসলামের সামনে। কিন্তু বলের ফ্লাইট বুঝতে না পেরে সেটি ছেড়ে দেন সাদমান, ১৭ রানে বেঁচে যান টেলর।
এরপর ৫০তম ওভারে আসে রান আউটের সুবর্ণ সুযোগ। পয়েন্টের দিকে ঠেলে দিয়ে দ্রুত রানের জন্য ছুটেছিলেন ইয়ং-টেলর। কিন্তু মাঝ পিচ পর্যন্ত গিয়ে দুজনই ফিরে যান যার যার ক্রিজে। ততক্ষণে বল সাদমানের হাত ঘুরে বোলার এবাদতের হাতে চলে যায়। কিন্তু এবাদত সেটি স্ট্যাম্পে লাগাতে ব্যর্থ হন। ফলে ৩১ রানে আবার সুযোগ পান কিউই অভিজ্ঞ ব্যাটার।
ইনিংসের ৫২তম ওভারে বাংলাদেশের ১৩০ রানের লিড ছাড়িয়ে যায় নিউজিল্যান্ড। এর পরপরই তাদের ওপর দিয়ে বয়ে যায় এবাদত ঝড়। প্রথম ইনিংসে ৫২ রান করা ইয়ং দ্বিতীয় ইনিংসে এগুচ্ছিলেন সেঞ্চুরির দিকে। কিন্তু ৫৪তম ওভারের দ্বিতীয় বলে তাকে সরাসরি বোল্ড করে সাজঘরে পাঠিয়ে এবাদত। ইয়ংয়ের ১৭২ বলের ইনিংস থামে ৬৯ রানে।
ঠিক পরের বলেই নতুন ব্যাটার হেনরি নিকলসের বিপক্ষে লেগ বিফোরের জোরালো আবেদন করেন এবাদত। তবে সাড়া দেননি আম্পায়ার। তাতে কী! ওভারের চতুর্থ বলে ভেতরে ঢোকা ডেলিভারিতে নিকলসের স্ট্যাম্প ছত্রখান করে দেন এবাদত, সঙ্গে সঙ্গে দেন ইনিংসে নিজের তৃতীয় স্যালুট।
এক ওভারে দুই উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ শিবিরে আনন্দের নহর বইয়ে দিয়েই থামেননি এবাদত। নিজের পরের ওভারে টম ব্লান্ডেলকে লেগ বিফোরের ফাঁদে ফেলেন তিনি। রিভিউ নিয়েও উইকেট বাঁচাতে পারেননি ব্লান্ডেল। নিকলসের মতো তিনিও খুলতে পারেননি রানের খাতা।
এবাদতের এই দুই ওভারের আগুনে ২ উইকেটে ১৩৬ রান থেকে ৫ উইকেটে ১৩৬ রানের দলে পরিণত হয় নিউজিল্যান্ড। তবে এরপর আর বিপদ ঘটতে দেননি রস টেলর ও রাচিন রবীন্দ্র। দিন শেষে টেলর ৩৭ ও রাচিন ৬ রানের অপরাজিত রয়েছেন।
শেষ সেশনে আগুনঝরা স্পেলে ৭ ওভারে দুই মেইডেনের সাহায্যে ১৫ রান খরচায় ৩ উইকেট নিয়েছেন এবাদত। সবমিলে এখন পর্যন্ত তার বোলিং ফিগার ৩৮ রানে ৪ উইকেট। যা টেস্ট ক্রিকেটে তার সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড।
source – jago news
Discussion about this post