খেলাধূলা ডেস্ক
সত্যিইতো এ যেনো এক রুপকথা ! প্রতীক্ষাটা সেই ২০০১ সাল থেকে শুরু। যে ফরম্যাটই হোক না কেন, বিজয়ীর ঘরে লেখা- ‘নিউজিল্যান্ড’! দীর্ঘ ২০ বছরেরও এই লেখা বদলানো যায়নি। বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য নিউজিল্যান্ড সফর তাই চরম বিভীষিকার এক অধ্যায়। এবারও যখন দেশটি সফরে যায় মুমিনুল হকরা, তখনও হয়তো কেউ ভাবেননি ২০২২ সালের শুরুতে কী চমক অপেক্ষা করছে, আধিপত্য বিস্তার করা ক্রিকেটে লেখা হতে যাচ্ছে স্মরণীয় বিজয়। হ্যাঁ, অবশেষে এসেছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। শেষ পর্যন্ত জয় করা গেলো নিউজিল্যান্ড।
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে উপমহাদেশের দেশগুলো খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। পাকিস্তান এখানে সবশেষ জিতেছে ২০১১ সালে, ভারত ২০০৯ সালে, শ্রীলঙ্কা, ২০০৬ সালে। তবে ঘরের মাঠে টানা ১৭ টেস্টে না হারা কিউইদের এবার মাটিতে নামাল বাংলাদেশ।
আজ (বুধবার) মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট ৮ উইকেটে জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ। তাতে এই প্রথম নিউজিল্যান্ডের মাটিতে জয়ের দেখা পেলো বাংলাদেশ। টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে ৩২ ম্যাচ খেলেছে সফরকারীরা। সময়-ক্ষণ আলাদা হলেও সব ম্যাচে একই পরিণতি! হতাশায় মাথা নিচু করে হারের ব্যর্থতায় মাঠ ছাড়তে হয়েছে বারবার। এবারের সফরে প্রথম টেস্ট দিয়ে সেই আক্ষেপ-হতাশা দূর করলো মুমিনুলরা।
সহজ লক্ষ্যে খেলতে নেমে টিম সাউদি শুরুতে একটু কাঁপন ধরালেও সেটি একেবারেই গায়ে লাগেনি। সাদমান ইসলাম (৩) দ্রুত ফেরার পর জয়ের একেবারে কাছাকাছি গিয়ে আউট হন নাজমুল হোসেন শান্ত। কাইল জেমিসনের বলে স্লিপে রস টেলরের হাতে ধরা পড়ার আগে শান্ত ৪১ বলে ৩ বাউন্ডারি করেন ১৭ রান। এরপর মুশফিকের বাউন্ডারিতে আসে ঐতিহাসিক জয়ের মুহূর্ত। ৫ রানে অপরাজিত ছিলেন অভিজ্ঞ এই ব্যাটার। আর মুমিনুল ১৩ রান করে জয় নিশ্চিত করে মাঠ ছাড়েন।
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে খেলা আগের ৯ টেস্টের সবক’টিতে হেরেছিল বাংলাদেশ। ২০২২ সালের প্রথম দিন শুরু হওয়া মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট দিয়ে সেই আক্ষেপ দূর করলো মুমিনুলরা। একই সঙ্গে ব্যর্থতার বৃত্ত ভেঙে নতুন বছরে নতুন সূচনায় বাংলাদেশের ক্রিকেট।
এর আগে জয়ের ভিতটা গড়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। আরও স্পষ্ট করে বললে এবাদত হোসেন। দ্বিতীয় ইনিংসে তার দুর্দান্ত বোলিংয়ে নিউজিল্যান্ডকে মাত্র ১৬৯ রানে অলআউট করে সফরকারীরা। ফলে বাংলাদেশের জয়ের লক্ষ্য ঠিক হয়েছে ৪০ রানের।আগের দিন শেষ বিকালে নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ ভেঙে দিয়েছিলেন এবাদত। আজ (বুধবার) মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের শেষ দিনের শুরুতেও সেই পারফরম্যান্স ধরে রাখেন ডানহাতি পেসার। দিনের শুরুতেই বোল্ড করে ফেরান অভিজ্ঞ রস টেলরকে। এখানেই থামলেন না, খানিক পর আউট করেন কাইল জেমিসনকে। এরপর শুরু তাসকিন আহমেদের দাপট।
স্বপ্নের মতো এক টেস্ট পার করলো বাংলাদেশ। যে নিউজিল্যান্ডে কেবল হতাশার ছবি ফুটে উঠেছে, সেখানে স্বাগতিকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে খেলেছে। আর এই পথচলায় বোলিংয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবাদত। আগের দিনের ৪ উইকেট নিয়ে পঞ্চম দিন শুরু করে দ্বিতীয় বলেই ৫ উইকেট পূরণ করেন এই পেসার। অভিজ্ঞ টেলরকে বোল্ড করে ক্যারিয়ারে প্রথমবার ৫ উইকেটের দেখা পান তিনি। যা ২০০৩ সালের পর প্রথম বাংলাদেশি পেসার হিসেবে এই অর্জনের খাতায় নাম তোলেন এবাদত। ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট সিরিজ খেলতে নামা টেলর ১০৪ বলে ২ বাউন্ডারিতে করেন ৪০ রান।
মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের বে ওভালে এবাদতের ম্যাজিক শেষ হচ্ছিল না। আবারও বাংলাদেশকে আনন্দের উপলক্ষ এনে দেন তিনি। এবার তার শিকার জেমিসন। মিড উইকেটে শরিফুল ইসলামের হাতে দুর্দান্ত ক্যাচ হয়ে ফেরার আগে রানের খাতা খুলতে পারেননি কিউই পেসার।
এবাদত একের পর এক উইকেট নিচ্ছেন, তাসকিনও যোগ দিলেন সেই উৎসবে। টেলরের সঙ্গে পঞ্চম দিন শুরু করা রাচিন রবীন্দ্রকে তুলে নিলেন তিনি। চমৎকার ডেলিভারিতে উইকেটকিপার লিটন দাসের গ্লাভসে ক্যাচ বানান কিউই ব্যাটারকে। ফেরার আগে ৪৯ বলে ৩ বাউন্ডারিতে ১৬ রান করেছেন তিনি।
তাসকিনের উইকেটের ক্ষুধা কমেনি। খানিক পর তুলে নেন টিম সাউদির উইকেট। ক্লিন বোল্ড করে কিউই ব্যাটারকে রানের খাতা খুলতে দেননি বাংলাদেশি পেসার। এরপর মেহেদী হাসান মিরাজ শেষটা মুড়ে দেন ট্রেন্ট বোল্টকে (৮) বদলি ফিল্ডার তাইজুল ইসলামের হাতে ক্যাচ বানিয়ে।
বল হাতে দুর্দান্ত এবাদত ২১ ওভারে ৪৬ রান দিয়ে পেয়েছেন ৬ উইকেট। এমন বোলিংয়ের পর ম্যাচসেরার পুরস্কার তার হাতেই মানায়। তাসকিন ১৪ ওভারে ৩৬ রান খরচায় নেন ৩ উইকেট। আর মিরাজ ২২.৪ ওভারে ৪৩ রানে পেয়েছেন ১ উইকেট।
২১ ওভারে ৪৬ রানে ৬ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশের সেরা বোলার ইবাদত। বাংলাদেশের কোনো পেসার প্রায় ৯ বছর ও ৪৭ টেস্ট পর টেস্টে ৫ উইকেটের স্বাদ পেলেন। দেশের বাইরে টাইগার কোনো পেসারের সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে পেসারদের দ্বিতীয় সেরা।সবাইকে ছাপিয়ে এবাদতই ম্যাচ সেরা !
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
নিউজিল্যান্ড: ৩২৮ ও দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৩.৪ ওভারে ১৬৯ (উইল ইয়ং ৬৯, রস টেলর ৪০, রাচিন রবীন্দ্র ১৬, টম ল্যাথাম ১৪, ডেভন কনওয়ে ১৩; এবাদত হোসেন ৬/৪৬, তাসকিন আহমেদ ৩/৩৬, মেহেদী হাসান মিরাজ ১/৪৩)।
বাংলাদেশ: ৪৫৮ ও দ্বিতীয় ইনিংসে (লক্ষ্য ৪০ রান) ১৬.৫ ওভারে ৪২/২ (নাজমুল হোসেন শান্ত ১৭, মুমিনুল হক ১৩*, মুশফিকুর রহিম ৫*, সাদমান ইসলাম ৩; কাইল জেমিসন ১/১২, টিম সাউদি ১/২১)।
ফল: বাংলাদেশ ৮ উইকেটে জয়ী।
ম্যাচসেরা: এবাদত হোসেন।
সিরিজ: দুই ম্যাচের সিরিজ বাংলাদেশ ১-০তে এগিয়ে।
Discussion about this post