শৈশবে স্ট্রং টাওয়ার এফসির হয়ে খেলতেন মোহাম্মদ কুদুস। তার সেই সময়কার স্মৃতি আজও স্থানীয়দের মনে অমলিন। জুনিয়র লেভেলে একবার পাওয়ারলাইনস এফসি ক্লাবের বিপক্ষে এক হাইপ্রোফাইল ম্যাচে খেলার পর সতীর্থরা ১১ বছর বয়সী কিশোর কুদুসকে তার দুর্দান্ত পারফরমেন্সের জন্য কাঁধে তুলে হইহই করেছিল। ঐ বয়স থেকেই খেলার সময় সারা মাঠে প্রভাব বিস্তার করতেন কুদুস, নিজ লক্ষ্যে থাকতেন অটুট। সেদিন নব্বই মিনিটের ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে গুনে গুনে ছয়টি গোল দিয়েছিলেন মোহাম্মদ কুদুস! যদিও শক্তিশালী প্রতিপক্ষও সমান সংখ্যক গোল দেওয়ায় ম্যাচটি ড্র হয়েছিল।
সেদিনের পারফরমেন্সের পর থেকে এখন পর্যন্ত মোহাম্মদ কুদুসের খেলোয়াড়ি দক্ষতার কথা ভুলতে পারেননি তার এলাকার মানুষেরা। স্ট্রং টাওয়ার ক্লাবের ম্যানেজার জশুয়া আয়োবা আউয়াহ বলেন, “আমি কুদুসকে প্রথম খেলতে দেখি রাস্তায়, আর দেখার সাথেসাথেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে এই ছেলের মধ্যে প্রতিভা আছে।” জশুয়াই প্রথম মোহাম্মদ কুদুসকে এই ক্লাবে নিয়ে আসেন এবং তার বর্তমান সাফল্যের প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন!
“আমি তাকে আমার অনুশীলন মাঠে চলে আসার আমন্ত্রণ জানাই এবং প্রথম দিন থেকেই সে অসাধারণ খেলেছে। আমি তাকে ‘বিশ্বসেরা’ উপাধি দিয়েছিলাম, ওই সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১০ বছর, কিন্তু তার দক্ষতা ছিল একেবারে চোখে পড়ার মতো”, বলেন জশুয়া।
বই আর ফুটবল যখন একই সাথে
নিমার মতো একটি ঘিঞ্জি-বস্তির মতো এলাকা থেকে উঠে এসে জাতীয় দলের তারকা হওয়া এবং আয়াক্সের মতো ক্লাবে খেলার যাত্রাপথটা সহজ ছিল না মোহাম্মদ কুদুসের জন্য। নিমা রাজধানী আক্রার আশেপাশে অবস্থিত এমন একটি এলাকা যা ছিল মাদক কারবারি, অপরাধ গ্যাং ও নানা ধরনের অনৈতিক কার্যক্রমের আখড়া। এই এলাকায় জন্ম নেওয়া যেকোনো শিশুকেই ‘খারাপ সঙ্গ’ বলে আখ্যা দেওয়া হতো।
পূর্ব ঘানার রাইট টু ড্রিম একাডেমিতে যাওয়া-আসা করতেন মোহাম্মদ কুদুস। এই একাডেমির পরিচালক কিং ওসেই গিয়ানের ভাষ্যে, “মোহাম্মদ কুদুস আফ্রিকার পরবর্তী প্রজন্মের উজ্জ্বল প্রতিনিধি যিনি নিজের মূল্য বোঝেন এবং তা রক্ষা করার জন্য লড়াই করতেও জানেন।”
এছাড়া, শিক্ষা ও ফুটবলকে একই সাথে ব্যবহার করার কারণেই সমাজের একেবারে নিচুতলা থেকে উঠে এসেও আপন আলোয় উদ্ভাসিত হতে পেরেছেন মোহাম্মদ কুদুস। তরুণ কুদুসের মধ্যে যেমন ছিল ফুটবল প্রতিভা, তেমনই ক্লাসরুমে পড়ালেখায়ও ছিলেন বেশ মেধাবী। ফলে ‘বুকস অ্যান্ড বুটস’ নামক একটি এনজিওর সহযোগিতায় নিমায় ফুটবল ও পড়ালেখা দুটিই চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় তার পক্ষে।
এই এনজিওটি মূলত দারিদ্র, মাদক ও টিনেজ প্রেগন্যান্সির সমস্যায় জড়িয়ে পড়াদের টার্গেট করে এবং ফুটবলকে ব্যবহার করে শিশুদের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করে।
“মোহাম্মদ কুদুস একেবারেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের একজন খেলোয়াড় ছিলেন না, কিন্তু তার মধ্যে দক্ষতা আছে বোঝা যাচ্ছিলো। নিমার রাস্তায় নিজের ভাই-বন্ধুদের সাথে সে খেলতো। যারা তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে তারা তার প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। এরপর রাইট টু ড্রিম এর একজন স্কাউটও আমার কাছে তার নাম প্রস্তাব করে এবং কুদুসের অভিভাবকের সাথে কথা বলার অনুমোদন চায়”, বলেন বুকস অ্যান্ড বুটস এর সিইও আম্পোফো-আংকরাহ। আর এভাবেই রাইট টু ড্রিম একাডেমিতে এসে পৌঁছান মোহাম্মদ কুদুস। একেবারেই ভিন্ন পরিবেশ হলেও খুব দ্রুত নতুন পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন কুদুস।
রাইট টু ড্রিম একাডেমির দক্ষতা উন্নয়ন বিভাগের কোচ ওমান আবদুল রবি বলেন, “প্রথম দিন এখানে পা রেখেই দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছিল কুদুস। যেভাবে সে বল নিয়ে দৌড়াচ্ছিল, তার প্রতিটি টাচে বোঝা যাচ্ছিল যে তার মধ্যে প্রতিভা আছে।”
একাডেমিতে ছয় বছর কাটানোর সময়কালে কুদুস নিজের মনপ্রাণ উজাড় করে খেলেছেন। খেলার ধরনে বৈচিত্র্যতা থাকার সুবাদে মিডফিল্ড এবং কখনো কখনো উপরের দিকে উঠে এসেও খেলেছেন তিনি। এর বাইরে নিজের সতীর্থদের কাছেও তারকা বনে গিয়েছিলেন কুদুস।
একাডেমির পরিচালক গিয়ান নিজেও ঘানার জাতীয় দল এবং ইংলিশ ক্লাব ফুলহ্যামের হয়ে খেলেছেন। নিজের খেলোয়াড়ি অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বুঝেছিলেন যে কুদুসের মধ্যে যোগ্যতা, সামর্থ্য ও পরিশ্রমের অপূর্ব মিলন রয়েছে- আর সে কারণেই তার তত্ত্বাবধানে আজকের মোহাম্মদ কুদুসকে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে।
গোল্ডেন বয়!
রাইট টু ড্রিম একাডেমিতে কুদুসের অসংখ্য প্রিয় স্মৃতির মধ্য থেকে দ্বিতীয় ডিভিশনের একটি ম্যাচের স্মৃতি বিশেষভাবে মনে করেন গিয়ান।
তিনি বলেন, “ঘানার নিচের ডিভিশনের খেলাগুলোতে অনেক প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে খেলা হয়। এখানে যদিওবা বল মিস হয়, কিন্তু ওই খেলোয়াড়কে মিস করা যাবে না। কুদুসের বয়স তখন মাত্র ১৬ বছর, তা সত্ত্বেও সে ওই প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে সমান তালে পাল্লা দিয়ে দৌড়াত, বল নেওয়ার চেষ্টা করতো এবং কখনো হাল ছেড়ে দিত না। টিনেজ বয়সে তার এই দিকটিই ছিল বেশ চোখে পড়ার মতো।”
নিজের ১৮তম জন্মদিন পেরোতে না পেরোতেই কুদুস ডাক পেলেন ড্যানিশ ক্লাব এফসি নরশাইলান্ডের কাছ থেকে এবং তাদের নবম কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেক হলো তার। এক মৌসুম খেলে তিনি ১১টি গোল করেছিলেন।
ডেনমার্কে আঠারো মাস কাটানোর পর ২০২০ সালে মাঝামাঝি সময়ে আয়াক্সের যোগ দিয়ে নিজের স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে যান মোহাম্মদ কুদুস। আয়াক্সে আসার পর সব দিক থেকেই মর্যাদা বেড়েছে কুদুসের।
২০২০ সালে ইতালির তুত্তোস্পোর্ট সংবাদপত্র ইউরোপে খেলা ‘মোস্ট ইমপ্রেসিভ ইয়ংস্টার’ হিসেবে কুদুসকে ‘গোল্ডেন বয় অ্যাওয়ার্ড’ এর জন্য মনোনীত করে।
আয়াক্সে প্রথম দুই মৌসুম ইনজুরির জন্য ঠিকঠাক মাঠে নামতে না পারলেও। এখন তিনি সম্পূর্ণ ফিট এবং ক্যারিয়ারের সেরা খেলাটাই খেলছেন। নতুন ম্যানেজার আলফ্রেড শ্রুডার তাকে নাম্বার নাইনের পজিশনে খেলাচ্ছেন। এরই মধ্যে এই মৌসুমে ১০ গোল ও দুটি অ্যাসিস্ট করেছেন কুদুস।
কুদুসের খ্যাতি এতদূর ছড়িয়ে গেছে যে লিভারপুলের কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ তাকে ‘অসাধারণ খেলোয়াড়’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। এমনকি ফরাসি কিংবদন্তি থিয়েরি অরিও তার খেলা দেখে মুগ্ধ।
একজন পথ প্রদর্শক, একজন আদর্শ
মোহামদ্দ কুদুস ঘানার লাখো তরুণের জন্য এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা। তার মতো অবস্থানে যারা রয়েছেন তাদেরকে নতুন এক জীবনের স্বপ্ন দেখান তিনি।
কুদুসের চাচা বলেন, “কুদুস শুধু আমাদের পরিবারের নয়, সে সবার। যখন আপনি নিমায় আসবেন, দেখবেন সবাই তাকে ‘নিমার গর্ব’ বলে ডাকে। আমরা সবাই খুব খুশি যে সে এবারের বিশ্বকাপে ঘানার প্রতিনিধিত্ব করছে।”
কুদুস তার অঞ্চলের শিশুদের জন্য বড় অনুপ্রেরণা। অনেকেই তাকে আদর্শ হিসেবে দেখেন। কাওউকুডি পার্কে খেলতে আসা নয় বছরের শিশু রামাদান ওসমানের কণ্ঠে যেন সেই একই সুর ও প্রত্যয়, “আমি নাম্বার টেন, আমি হবো পরবর্তী মোহাম্মদ কুদুস!”
সূত্র: আল-জাজিরা
Discussion about this post