খেলাধূলা ডেস্ক
আট বছর পর আরও একবার বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা। আগামী রোববার ( ১৮ ডিসেম্বর ) লুসাইল স্টেডিয়ামের ফাইনালে দলটি খেলবে ফ্রান্সের বিপক্ষে। লিওনেল মেসি জানিয়েই দিয়েছেন, বিশ্বকাপ ফাইনালটাই হতে যাচ্ছে বিশ্বমঞ্চে তার শেষ ম্যাচ। সেই ম্যাচটা জিতেই যে বিদায়টা বলতে চাইবেন মেসি, তা আর বলতে।
মেসির জন্য ‘জানপ্রাণ’ দিয়ে দিতে চাওয়া আর্জেন্টিনাও যে ফ্রান্সকে সেদিন যে কোনো মূল্যে হারাতে চাইবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আরও এক কারণে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জেতা উচিত। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা জানালেন, দুই বছর আগে পরপারে পাড়ি জমানো ডিয়েগো ম্যারাডোনার জন্য হলেও বিশ্বকাপটা জেতা উচিত দলের।
ব্যক্তিজীবনে মাশরাফি একজন আর্জেন্টিনা সমর্থক। পছন্দের দলের ফাইনাল নিশ্চিত করার পর সাবেক অধিনায়ক তাই প্রায় ৫০০ শব্দের দীর্ঘ এক লেখা লিখলেন ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে। জানালেন আর্জেন্টিনা দলের পুরো বিশ্বকাপ যাত্রা নিয়ে ভাবনা, ফাইনালে দলের কাছে চাওয়া।
রোববার লুসাইল স্টেডিয়ামে ফ্রান্সের বিপক্ষে যখন মাঠে নামবে মেসি বাহিনী, তখন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ফাইনালটা খেলা হয়ে যাবে তার। আট বছর আগের প্রথম ফাইনালটার স্মৃতিও তখন ভালোভাবেই নাড়া দিয়ে যাচ্ছে আর্জেন্টাইন ভক্ত-সমর্থকদের মনে।
মাশরাফিরও মনে পড়ছে সেই ফাইনাল। তিনি লেখেন, ‘স্বপ্নের ফাইনাল আট বছরে দুইবার। আট বছর আগে রোজা চলছিল, সেহরির ঠিক পরেই গোৎজের গোলে হেরে রানার্সআপ হয়েছিল আর্জেন্টিনা। তখন মনে হয়েছিল আর সম্ভব না, কারণ বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠা চাট্টিখানি বিষয় না। সেখানে শুধু ভালো খেললেই হয় না,অনেক সমীকরণের সঙ্গে ভাগ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮-তে শেষ ষোলোতেই বাদ, সাত গোলের খেলায় তিনটা দিয়েও টিকে থাকতে পারলো না।’
এবার আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে এসেছিল ৩৬ ম্যাচের অপরাজিত যাত্রা নিয়ে। তবে এরপরও মেসিরা ফাইনাল খেলবেন, এমনটা বিশ্বাসই হয়নি মাশরাফির। কেন এমন মনে হচ্ছিল, সেটাও জানালেন বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক, ‘এবার সবাই যখন বলছিল টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত, আসলে মন সাড়া দেয়নি। কারণ বিশ্বকাপ অন্য জিনিস। এখানে ফাইনালে যেতে রাউন্ড সিক্সটিন থেকে ফাইনালে পৌঁছানোর ধাপই তিনটি, যেখানে নকআউট পদ্ধতি এর আগে তো গ্রুপ রাউন্ড আছেই। আশঙ্কা সত্য হয়ে প্রথম ম্যাচেই সৌদির কাছে হার, পরে সব ম্যাচই অলমোস্ট ফাইনাল। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আর্জেন্টিনা ফাইনাল খেলছে, এটা ভাবাই যায় না।’
আর্জেন্টিনা যে ফাইনালে এসেছে, তাতে বড় অবদান আছে অধিনায়ক লিওনেল মেসির। ৫ গোল করেছেন, করিয়েছেন আরও তিনটি। আর তাতেই মেসি মন জয় করেছেন মাশরাফির, প্রথম বারের মতো! তিনি বলেন, ‘আর্জেন্টিনার রোড টু ফাইনালের সব ম্যাচই দেখেছি, প্রথমবারের মতো মেসিকে যেভাবে বিশ্বকাপে দেখতে চেয়েছি, সেটা দেখে আরও ভালো লেগেছে। এখনও পর্যন্ত তিনটা অ্যাসিস্টসহ পাঁচটা গোল। এমবাপ্পের সঙ্গে একই অবস্থানে। যদি দুজনের কেউ ফাইনালে গোল না করে, অ্যাসিস্টের কারণে গোল্ডেন বুট মেসিই পাবে। আর পেনাল্টি নিয়ে যত কথা,আমার তো মনে হয় মেসির পেনাল্টি মিস নিয়েই এ যাবৎকাল সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে। নিন্দুক হতে তো জ্ঞানী হতে হয় না, হতে হয় কট্টরপন্থী।’
মেসি ছাড়াও আর্জেন্টিনার বাকি সদস্যরা দারুণ পারফর্ম করছেন। সে কারণেই মাশরাফি দলকে নিয়ে আশা দেখছেন। বললেন, ‘আর্জেন্টিনার এই দলটার সবচেয়ে ভালো দিক হলো, দলের সবাই জানে মেসি সেরা, কিন্তু মেসির সেরাটার জন্য কেউ বসে থাকছে না। হিগুয়েন, আগুয়েরো ঘুরে শেষমেশ একজন স্ট্রাইকার (আলভারেজ) পেলো, যে আসলে দরকারের সময় গোল করেছে। ডি পল তো মেসির না শুধু, পুরো দলেরই ভ্যানগার্ড। প্রথম ম্যাচ বাদে রোমেরো, ওটামেন্ডি ঠিকঠাক নিজেদের কাজ করে যাচ্ছে। আর ২১ বছর বয়সী ফার্নান্দেজ তো এবার বিশ্বকাপের সেরা তরুণ খেলোয়াড়ের অন্যতম দাবিদার। আর সবাইও খুব খারাপ করেনি।’
কোচ লিওনেল স্ক্যালোনিকে নিয়েও প্রশংসার তুবড়ি ছুটিয়েছেন সাবেক বাংলাদেশ অধিনায়ক। তিনি বলেন, ‘এত কিছুর পর একজনের কথা না বললেই না, সে হলো লিওনেল স্কালোনি। বয়স কম কিন্তু দারুণ একজন সাহসী মানুষ। প্রথম ম্যাচের পর মূল দলের বাহিরে গিয়ে এভাবে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এত বড় টুর্নামেন্টে কিছু তরুণদের ওপর আস্থা রাখা এবং তাদের থেকে সেরাটা বের করে আনা এক কথায় অসাধারণ। ভিন্ন ভিন্ন ম্যাচে ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাট, যা শুরুতে মনে হয়েছে এত চেঞ্জ করছে কেন, পরে আসলেই আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা দারুণভাবে সেটার সাথে মানিয়ে পারর্ফম করে ম্যাচ জিতিয়ে এনে স্কালোনিকে আরও সাহসী করে তুলছে। শুধু দুইটা ম্যাচের উদাহরণ দেই- নেদারল্যান্ডসের সাথে নামলো পাঁচ ডিফেন্স নিয়ে হাফ টাইমে করে ফেললো চার, ঠিক পরের ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার সাথে নামলো চার ডিফেন্স নিয়ে হাফ টাইমে করলো পাচ। এই যে খেলার ভেতরেই ফরমেশন চেঞ্জ করা তাও হাফ টাইমে, অপোনেন্টেকে রিয়াকশনের সময় না দেওয়া, দারুণ কিছু মুভ তার থেকে দেখা গিয়েছে। ইনফ্যাক্ট অস্ট্রেলিয়ার সাথেও ৫০ মিনিটে হুট করেই চার ডিফেন্স থেকে পাঁচটা করে দেওয়া এবং তার জন্য খেলোয়াড়দের মানসিক প্রস্তুত করা, সময়ের জন্য অপেক্ষা না করে, নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করে এতো প্রো-অ্যাকটিভ থাকা আসলেই অসাধারণ।’
তবে ফাইনালে আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। তাদের কাছে হেরেই গেল বিশ্বকাপে শেষ হয়েছিল আকাশি-সাদাদের আশা। এবারও কিলিয়ান এমবাপেরা আছেন দারুণ ফর্মে। এমন ফলের কাছে হারলেও আর্জেন্টিনার বীরত্ব কমবে না, মত মাশরাফির। তবে বিশ্বজয়ের আশাটাও ছাড়ছেন না তিনি। তার চাওয়া, মেসির জন্য তো বটেই, ম্যারাডোনার জন্য হলেও জেতা উচিত আর্জেন্টিনার।
মাশরাফির ভাষ্য, ‘একটা ম্যাচ বাকি, সব ঠিকঠাকভাবে মিললে হয়তো কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছাবে, আর না হলে আরও একবার ফাইনালে হেরে রানার্সআপ। তবে তাতে আর্জেন্টিনার এই বীরত্বে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়বে না। ফ্রান্স অলরেডি দেখিয়েছে তারা কেন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। একজন আর্জেন্টিনা দলের চরম ভক্ত হিসেবে চাই এ বিশ্বকাপ জিতুক, সবার চাওয়া হয়তো মেসির জন্য, আমারও খুব ভিন্ন না, তবে তার আগে জিততে চাই শুধুই আর্জেন্টিনার জন্য যে দলকে ভালোবেসেছি স্রেফ আর স্রেফ একজনকে দেখে- দিয়েগো আর্মান্দো ম্যারাডোনা।’
Discussion about this post