প্রযুক্তি এখন সর্বত্র। নতুন নতুন প্রযুক্তির ডিভাইস আমাদের হাতে, ঘরে, পকেটে। এমনকি আমাদের সন্তানদের খেলার সামগ্রীও নানান ধরনের প্রযুক্তিপণ্য। মোবাইল ফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ভিডিও গেম ইত্যাদি বিভিন্ন রকম প্রযুক্তিপণ্য আমরা নিত্যদিন ব্যবহার করি এবং এই ব্যবহার উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এমনকি শিশুদের মধ্যেও এসব প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহার করে বিনোদিত হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।
যদিও সব সময় এ ব্যাপারে সচেতনতার কথা বলা হয়। ইন্টারনেট ঘাটলে এ সম্পর্কিত কয়েক হাজার আর্টিকেল পাওয়া যাবে, যেখানে এসব ডিজিটাল প্রযুক্তিপণ্য অতিমাত্রায় ব্যবহারের ঝুঁকি এবং খারাপ দিক সম্বন্ধে বলা হয়েছে। এমনকি যারা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এইসব ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে থাকে তারাও এই ডিভাইসগুলো অতিমাত্রায় ব্যবহারে আসক্ত।
আমরা এইসব ডিভাইসের খারাপ দিক সম্বন্ধে সচেতন হয়েও এর ব্যবহার কমাতে পারছি না। কেননা এইসব প্রযুক্তি পণ্য স্বাভাবিক বা গ্রহণযোগ্য ব্যবহারের কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা নেই। তাই মানসিকভাবে সচেতন হলেও আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না এই সচেতনতা বাস্তবায়নের জন্য কী করা প্রয়োজন।
আজকের নিবন্ধে প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারের এমন কিছু পরামর্শ আলোচনা করা হল, যা আপনাকে প্রযুক্তি পণ্য ব্যবহারের কার্যকর নিয়ম তৈরি করতে এবং আপনার সন্তানকে সঠিক নির্দেশনা দিতে সহযোগিতা করবে।
স্কুলের নিয়ম নীতি জানুন
সন্তানের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক নিয়ম তৈরি করতে সবার আগে তার স্কুলের নিয়ম নীতি জানার চেষ্টা করুন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্কুল বিভিন্ন রকম। এমনকি এক দেশের বিভিন্ন জেলার স্কুলের নিয়ম নীতিও ভিন্ন। কিছু স্কুল ও কলেজ ছেলে মেয়েদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনুমতি দেয়। কেননা তারা পরিবারের সাথে যোগাযোগ এবং নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তা করে।
কিন্তু অনেক স্কুল আছে যারা ছেলে মেয়েদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের অনুমতি দেয় না। তারা স্কুল কলেজের ছেলে মেয়েদের মোবাইল ফোন ব্যবহার ক্ষতিকর বলে মনে করে। অবশ্য এই বিষয়টি স্কুল এবং দেশের সার্বিক পরিবেশ ও সংস্কৃতির ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। সুতরাং ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আপনার সন্তানের স্কুলের নিয়ম নীতি সঠিকভাবে জানলে তাকে আরো বেশি সচেতন করা আপনার পক্ষে সহজ হবে।
নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিন
সন্তানের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিন। দিনের কোন সময় কতটুকু তারা ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করবে তা পরিবার থেকে নিশ্চিত করলে অনলাইন এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির নানা রকম ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। তবে আপনাকে মনে রাখতে হবে টিনএজ বয়সীরা সাধারণত ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং ইন্টারনেটের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। এমনকি তারা দিনের ২৪ ঘণ্টা ইন্টারনেটে থাকতে পছন্দ করে।
সুতরাং তাদের নিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে পরিবারে নিয়ন্ত্রিত অভ্যাস গড়ে তুলুন। পরিবারের অন্য সদস্যরা যদি নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময় ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে, তবে শিশুরাও তা দেখে উদ্বুদ্ধ হবে। এমনকি ইচ্ছা হলেও তারা পারিবারিক নিয়মের বাইরে যেতে পারবে না।
ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার চুক্তি
সন্তানের নিয়ন্ত্রিত ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে তার সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করতে পারেন। অর্থাৎ আপনার সন্তানকে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের অনুমতি দেবেন, তবে তা ব্যবহারের সুনির্দিষ্ট নিয়ম নীতি বেঁধে দিয়ে চুক্তি করতে পারেন। বিষয়টি অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলেন, মৌখিক যেকোনো চুক্তি বা নির্দেশনার চেয়ে লিখিত চুক্তি বা নির্দেশনা মানুষের মনে অনেক গভীরভাবে দাগ কাটে এবং সেই নিয়ম বা নির্দেশনার ব্যাপারে মানুষ অধিক মাত্রায় সচেতন থাকে। সুতরাং এই পদ্ধতি আপনার সন্তানের সীমিত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করবে।
নিয়ম ভঙ্গের ফলাফল নির্ধারণ করুন
শিশুরা আপনার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া নিয়ম ভাঙ্গাই শিশুদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তাই ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দিষ্ট নিয়ম জানিয়ে দেওয়ার পর তা ভঙ্গ করলে কী শাস্তি হবে সেটাও তাকে জানিয়ে দিন। অর্থাৎ নিয়ম না মানলে পরবর্তীতে তাকে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের সময়সীমা আরও কমিয়ে দেওয়ার হুমকি দিন। তবে মনে রাখবেন তাকে শাস্তি দেওয়া আপনার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, তাকে নিয়মানুবর্তী করে তোলাই আপনার লক্ষ্য।
সাথে সাথে আপনার বাড়িতে কতগুলো ডিজিটাল প্রযুক্তি থাকা উচিত তার যুক্তিসঙ্গত সংখ্যা নির্ধারণ করুন এবং কোনো ক্রমেই অযৌক্তিকভাবে বাড়িতে অতিরিক্ত ডিজিটাল ডিভাইস রাখবেন না। তাহলে আপনার সন্তান ইচ্ছা করলেও বেশি অ্যাকসেস না পাওয়ার কারণে নিয়ম ভঙ্গ করতে পারবে না।
নিজে জানুন
আপনার সন্তান অনলাইনে কী কী করে, কী কী অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠুন। সন্তান যেসব অ্যাপ্লিকেশন, গেম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে পছন্দ করে সে ব্যাপারে নিজে দক্ষ হয়ে উঠুন। তাহলে তাকে সহযোগিতা করা বা নির্দেশনা দেওয়া আপনার পক্ষে সহজ হবে।
প্রয়োজনে নিয়ম পরিবর্তন
আপনার পরিবারে যদি এমন কোনো সন্তান থাকে যে শিশুকাল অতিক্রম করে যৌবনে পদার্পণ করার মুহূর্তে অবস্থান করছে, তাহলে তার জন্য প্রয়োজনে আপনাকে নিয়ম পরিবর্তন করার মানসিকতা রাখতে হবে। কেননা এই বয়সী কিশোর কিশোরীরা পরিবারের নিয়ম ভাঙতে পছন্দ করে এবং নিজের পছন্দ ও ভালোলাগাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তারা নিজের মত চলতে চায়, নিজের নিয়ম নিজে তৈরি করতে চায়।
তাই এই বয়সী কিশোর কিশোরীর জন্য বিচক্ষণতার সাথে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের নিয়ম পরিবর্তন করতে পারেন। যেন তার মতেরও মূল্য দেয়া হয় আবার আপনার নিয়মও প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রযুক্তিপণ্য বেডরুমের বাইরে রাখুন
স্মার্টফোন, ট্যাব এবং ল্যাপটপ সব সময় বেডরুমের বাইরে রাখুন। আপনার টিনএজ সন্তান চার্জ দেওয়ার কথা বলে মোবাইল ফোন নিজের বেডরুমে রাখতে চাইবে। মনে রাখবেন, আসলে শুধু চার্জ দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়, বেডরুমে ডিজিটাল ডিভাইস রাখলে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সে এই ডিভাইসে আসক্ত হবে এবং ঘুম নষ্ট করে দীর্ঘক্ষণ স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকবে। সুতরাং এইসব ডিজিটাল ডিভাইসের চার্জার বাড়িতে এমন একটি কমন জায়গায় রাখুন যেখান থেকে সবাই চার্জ দিতে পারে।
এভাবে সবকিছু নিয়ম নীতির মধ্যে আনতে পারলে আপনার সন্তানের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার সীমিত রাখা এবং তার মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।
Discussion about this post