সন্তানের সাথে মায়ের সম্পর্ক চিরন্তন। জন্মের পরপরই শিশু তার মাকে চিনতে পারে। শিশুর বয়স ২ মাস হলে সে চিনতে পারে তার বাবাকে। একটি শিশু মায়ের পরেই যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি অনুভব করে তিনি হলেন বাবা। মায়ের পাশাপাশি বাবাও শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে রাখেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
বাবার কাছে তার সন্তান নির্ভরতা খোঁজে। বাবার কণ্ঠস্বর, চেহারা, শরীরের গন্ধ ইত্যাদি মিলিয়ে সবকিছু প্রতিটি সন্তানের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে। সন্তানের পরিপূর্ণ বিকাশে যা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করে। সন্তানের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার প্রথম আইডল হিসেবে কাজ করে তার বাবা। একটি শিশু প্রথম থেকেই তার বাবাকে সার্বক্ষণিক অনুসরণ করে। সন্তানদের দিকে বাবার একটু নজর, তাদের কথাবার্তায় বন্ধু হয়ে মিশে যাওয়া, তাদের কাজের ক্ষেত্রে পরামর্শ দেওয়া- সন্তানের মনে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়। বাবার সাথে সুসম্পর্কের কারণে সন্তানের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ঘটে খুবই দ্রুত ও অনেক সুদৃঢ়ভাবে।
বাবা হিসেবে সন্তানের সাথে সুদৃঢ়, সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে একজন বাবার কিছু ভূমিকা রয়েছে। এমনই কিছু পদ্ধতি বা উপায় সম্পর্কে আজ ধারণা দিতে চেষ্টা করব যা সন্তানের সাথে বাবার একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহজ করে। আপনার সন্তানের পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। সে হয়তো গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তার বাবার জন্য। বাবাকে পরীক্ষার রেজাল্ট দেখিয়ে, তবেই সে ঘুমাতে যাবে। এ সময় বাবা হিসেবে উৎসাহ বা প্রশংসাসূচক বাক্য সন্তানকে পরবর্তী কাজটি আরো ভালো ভাবে করতে উৎসাহ দেবে। ছেলে বা মেয়ে যে-ই হোক না কেন, একজন বাবার প্রধান দায়িত্বই হলো উভয়ের প্রতি সমান দৃষ্টিভঙ্গি রাখা বা উভয়কেই সমান চোখে দেখা। কোনো অবস্থাতেই ছেলে বা মেয়ের ভেদাভেদ করা উচিত নয়। মেয়ে সন্তান হলে মা দেখবে, ছেলে সন্তান হলে বাবা দেখবে- এমন ধ্যান-ধারণা কিছুতেই রাখা উচিত নয়। মেয়ে সন্তান হলেও তার সাথে বন্ধন দৃঢ়ভাবেই তৈরি করতে হবে বাবার। সন্তানকে সাথে নিয়ে যদি আপনি একটি ভালো কাজ করেন, এই কাজটি আপনার সন্তানকে ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে তুলবে নিঃসন্দেহে। কারণ শিশুবেলায় সন্তান প্রতিনিয়ত তার বাবাকে অনুসরণ করতে থাকে। বাবার ভালো বা মন্দ কাজ, তার কথাবার্তা, চলাফেরা সে অনুসরণ করে। তাই সন্তানের সামনে এমন কোনো কাজ করা উচিৎ নয় যা আপনার তার মনে পরবর্তীতে খারাপ প্রভাব ফেলবে। প্রতিটি বাবাই তার শিশুর যত্নে মায়ের মতো ভূমিকা রাখলে শিশু নিজের প্রতি বাবার ভালোবাসার টান খুব সহজেই অনুভব করতে পারে। শিশুর কাপড় বদলানো, তার সাথে খেলা, তার পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে যত্নশীল হওয়া, গান শোনানো, গল্প বলা ইত্যাদি কাজে বাবার অংশগ্রহণ শিশুর মনোজগতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন একটা বাচ্চা কতটুকুই বা বোঝে। কিন্তু শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি, পরিবার পরিজন, সমাজ শিশুর মননে বেশ প্রভাব বিস্তার করে। শিশুরা শরীরের স্পর্শ খুব সহজেই অনুভব করতে পারে। শিশুকে জড়িয়ে রাখা, মাঝে মাঝে ঘুম পাড়ানো ইত্যাদি ছোট ছোট নিত্যদিনের কিছু স্বাভাবিক কাজই বাবা হিসেবে শিশুর সাথে বন্ধন খুব সহজেই তৈরি করে দেয়। প্রকৃতির নিয়মে শিশু একসময় বাবার কাছাকাছি হয়। সন্তানের বেড়ে ওঠা, বাবার সঙ্গ, বাবার পরামর্শ তার জীবনের ইতিবাচক গুণাবলিকে দৃঢ় করে। শিক্ষক, আত্মীয়, বন্ধুদের কাছ থেকে নেওয়া পরামর্শও কাজে লাগে, কিন্তু এসময় সন্তানের প্রতি বাবার দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক হলে সন্তান হতোদ্যম হয়ে পড়ে। সাধারণত সে মায়ের পাশাপাশি বাবা ছাড়া আর কোথাও নির্ভরতা খুঁজে পায় না। অনেক বাবাই সন্তানের প্রতি এ দায়িত্বটি পালন করতে পারেন না। কাজের চাপে, রুটি রুজির চিন্তায়, সংসার সামলে বাবার তার সন্তানের দিকে মনোযোগ দিতে পারার সুযোগ থাকে কম। তাছাড়া যেসব পরিবারে মা-ও চাকুরিজীবী, সেক্ষেত্রে তো বাবাকে সন্তানের জন্য কিছুটা হলেও সময় বের করে নেওয়া উচিত। শিশুরা যেন নিজের সব কথা বাবার সাথে শেয়ার করতে পারে এমন সম্পর্ক গড়ে তোলা খুবই প্রয়োজন একজন বাবার। শিশুর পছন্দমতো খাবার বা খেলনা কিনে দেওয়াই বাবার একমাত্র কর্তব্য নয়। শিশুদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ সময় বাবার অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে। বাচ্চার খেলার সঙ্গী হওয়া, তার সাথে অলস দুপুর কাটানো, অফিস থেকে ফিরে এসে প্রথমেই বাচ্চার খবর নেয়া, তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এসব কিছুই শিশুর গড়ে ওঠার পিছনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বাচ্চা মানুষ, ভুল তো করবেই। তাই বলে বেশি বকা-ঝকা করতে যাবেন না। কোনো দোষ করে ফেললে তাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলুন। তার ভুলের কারণে কী কী খারাপ হয়েছে বা হতে পারে তা বোঝানোর চেষ্টা করবেন। ভবিষ্যতে যেন এমন ভুল আর না করে সেই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলুন। বিনা কারণে সন্তানকে ধমকানো বা শারীরিক নির্যাতন কোনো অবস্থাতেই ঠিক নয়। শিশুর কোমল মনে এগুলো দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। তাই একজন সচেতন বাবা হিসেবে কোনো ভাবেই সন্তানের দুষ্টুমি বা অতিরিক্ত কান্নাকাটিতে বিরক্ত না হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবেলা করা উচিত। শিশুদের দুষ্টুমি সাময়িক। তাই অকারণে এসব ব্যাপারে মেজাজ খারাপ করা একদমই ঠিক নয়।
শিশুদের কোনো কাজে বাধা দেওয়া উচিত নয়। সন্তানের কী করতে ইচ্ছে হয় সেটা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করার উচিত। কাজটি যদি যথাযথ বলে মনে না হয়, তাহলে সন্তানকে বোঝানোর চেষ্টা করতে হবে। সন্তান যেন বাবা মায়ের আড়ালে কিছু করার চেষ্টা না করে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। “বাবাকে বললেই বাবা নিষেধ করবে” এমন চিন্তা-ভাবনা যেন বাচ্চারা পোষণ না করে সেজন্য বাবাদের অনেক বেশি সচেষ্ট হতে হবে। একজন বাবা হিসেবে নিজের জীবনের অতৃপ্তি কোনোভাবেই শিশুর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শিশুর ওপর চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। প্রতিটি বাচ্চারই নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকে, এর প্রতি গুরুত্ব দেয়া উচিত। বাবাকে সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে এবং অনেক উদার হতে হবে। নিজে কী চাই সেটা না দেখে বাচ্চা কী হতে চায়, কী করতে চায় সেই দিকটিই ভালভাবে খেয়াল রাখতে পারলে শিশুরা বাবার কাছে খুব সহজেই তাদের ইচ্ছে আর সুপ্ত প্রতিভাগুলো মেলে ধরতে পারবে।
একজন শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বাবা–মা উভয়েরই সমান দায়িত্ব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মা যেমন একটু বেশি ভূমিকা নেন, তেমনি কিছু জায়গায় বাবার দায়িত্বও অনেকাংশে বেড়ে যায়। তাই শিশুর বাবার উচিৎ সন্তানের সাথে এমন এক বন্ধন তৈরি করা যা পরবর্তী জীবনে তার বেড়ে উঠায় ছায়াসঙ্গী হয়ে সর্বদা সাহায্য করবে।
Discussion about this post