সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আজকাল খুব বেশি মানহানির ঘটনা ঘটছে। কারো হয়তো আপত্তিকর ছবি প্রকাশ করে আবার কারো সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করছে। এধরনের ঘটনা ঘটলে আদালতে অভিযোগ করতে হবে। অনলাইনে মানহানির ঘটনা ঘটলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ২০০৬ (২০১৩ সংশোধিত) এর ৫৭ ধারা অনুযায়ী মামলা হবে। পুলিশ এ ধারার অভিযোগে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারও করতে পারে। অর্থাৎ মানহানিকর বক্তব্য যদি অনলাইনের বাইরে হয় তাহলে এক ধরনের শাস্তি আর অনলাইনে হলে আরেক ধরনের শাস্তি। তাই ৫৭ ধারায় অপব্যবহারের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
সূত্র: দন্ড বিধি (penal code,1860)
অনলাইনে মানহানি হলে প্রতিকার কি
আধুনিক যুগে মানুষ সময় বাঁচাতে একে অন্যের খোঁজ খবর নেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারনে আমরা একটু বেশিই সামাজিক কিনা! সে যাই হোক আধুনিক যুগের এই সামাজিক যোগযোগ মাধ্যম বা অনলাইন মাধ্যম আজ অনেক জনপ্রিয় জনসাধারনের কাছে। ছোট থেকে বড় সকলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে। তবে এই অনলাইন মাধ্যম ব্যবহারে সুবিধার পাশাপাশি অসুবিধাও আছে। আর তা হল কারো সম্পর্কে না জেনে বিভিন্ন কথা বলা এবং সে কথা এক এক করে দুই হয়ে ছড়িয়ে যাওয়া।
এই একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ যখন সুবিধা গুলো গ্রহন করছে তখন অসুবিধা গুলোর সম্মখীন হতে হচ্ছে। অনলাইনে মানহানি, বিষয়টা খুবই লজ্জাজনক যখন কোন ব্যক্তি আপনার সম্পর্কে না জেনে যা ইচ্ছা তাই বলে যাবে, আর সে কথা গুলো যখন অন্যের কাছে বিনোদনের কোন বস্তু হবে। তবে কি এর কোন প্রতিকার নেই! অবশ্যই আছে, অনলাইনে মানহানির শিকার হলে আপনি তথ্য ও যোগাযোগ আইন ২০১৩ এর মাধ্যমে প্রতিকার পাবেন।
যখন আপনি অনলাইন মানহানির শিকার হবেন তখন আপনি আপনার এলাকার থানাতে ডিউটিরত অফিসারের কাছে অভিযোগ করবেন। প্রাথমিক পর্যায়ে পুলিশ আপনার অভিযোগটি তদন্ত করবে এবং তদন্ত করার পর যদি তার সত্যতা পাওয়া যায় তবে পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তি্র বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করবে। সেই অভিযোগপত্র পাওয়ার পর বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচারকার্য সম্পাদিত হবে। অভিযোগ প্রমাণ হলে আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দন্ডে দন্ডিত করবেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধ করে তবে অনধিক ১৪ বছর এবং সাত বছর কারাদণ্ডাদেশ পেতে পারে। এ ছাড়া অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে।
কিসে হয় মানহানি
দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানি কিসে হবে আর কিসে হবে না, তা বলে দেওয়া হয়েছে। এ ধারা অনুসারে “যে ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে বা এমন হবে জেনেও উদ্দেশ্যমূলক শব্দাবলি বা চিহ্নাদি বা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এমনভাবে কোনো নিন্দা প্রণয়ন বা প্রকাশ করে তাহলে ওই ব্যক্তির মানহানি করেছে বলে ধরা হবে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তি সম্পর্কে না জেনে তার সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি কুৎসা রটায় তবে সেটা মানহানি বলে ধরা হবে।
এমনকি মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে বললেও তা মানহানি হবে। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন মানহানির অভিযোগ আনতে পারবেন। তথ্য ও যোগাযোগ আইনে এমন কিছু ব্যতিক্রম অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যখন কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির নামে মানহানিকর কিছু বললে, লিখলে বা প্রচার করলেও মানহানি হবে না।
যেমন:
১. জনগণের কল্যাণে কারও প্রতি যদি সত্য দোষারোপকরা হয়, তাতে মানহানি হবে না।
২. সরকারি কর্মচারীর সরকারি আচরণ সম্পর্কে সৎ বিশ্বাসে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তা মানহানি হবে না।
৩. সরকারি বিষয়-সংশ্লিষ্ট প্রশ্নে কোনো ব্যক্তির আচরণ নিয়ে নিজের মত প্রকাশ করলে মানহানি হবে না।
৪. আদালতসমূহের কার্যবিবরণী প্রতিবেদন প্রকাশ করা মানহানির অন্তর্ভুক্ত হবে না।
৫. যেকোনো জনসমস্যা সম্পর্কে ও কোনো ব্যক্তির আচরণ সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করা মানহানি নয়।
৬. আদালতে সিদ্ধান্তকৃত মামলার দোষ, গুণ বা সাক্ষীদের সম্পর্কে বা অন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আচরণ সম্পর্কে অভিমত মানহানির পর্যায়ে পড়বে না।
৭. গণ-অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে কোনো মতামত প্রদান মানহানি নয়।
৮. কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে সৎ বিশ্বাসে কারও সম্পর্কে অভিযোগ করা হলে সেটিও মানহানি হবে না। যেমন: পুলিশের কাছে কারও ব্যাপারে সৎ বিশ্বাসে অভিযোগ।
৯. কোনো ব্যক্তি কর্তৃক তার বা অন্য কারও স্বার্থ রক্ষার্থে দোষারোপ করা মানহানি নয়।
১০. জনকল্যাণার্থে সতর্কতা প্রদানের উদ্দেশ্যে কারও সম্পর্কে কিছু বলা হলে, সেটিও মানহানি হবে না।
আইনের আশ্রয় কীভাবে
মানহানির অভিযোগে ফৌজদারি এবং দেওয়ানি এই দুই ধরনের মামলা মোকদ্দমা করার সুযোগ আছে। ফৌজদারি আদালতে নালিশি মামলা হিসেবে অভিযোগ করতে হয়। যে ব্যক্তি মানহানির শিকার হয়েছেন তিনি আদালতে অভিযোগ করে জবানবন্দির মাধ্যমে মামলা করতে পারবেন। আদালত অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমন জারি করবেন।
মানহানি মামলায় সাধারনত সরাসরি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় না। সমন দিলে আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তি হাজির হয়ে আইনজীবি অভিযুক্ত ব্যক্তির জামিন না চাইলে সে ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। অনলাইনে বা যেকোনো মাধ্যমে যদি মানহানির শিকার হয় কোন ব্যক্তি তবে থানায় এজাহার দায়ের করতে হবে।
অনলাইন মানহানিতে আদালতে সরাসরি মামলা দায়ের করা যায় না। মানহানির কারণে কোন ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ দাবি করে দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা করার সুযোগ পাবে। এ মোকদ্দমা দায়ের করতে হলে অবশ্যই ক্ষতিপূরণের টাকা থেকে কোর্ট ফি জমা দিতে হবে। তবে বিচারপদ্ধতি দেওয়ানি মোকদ্দমার মতোই হবে। মামলায় বাদী সত্য প্রমাণিত হলে বিবাদী থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ আদায় করতে পারবে।
Discussion about this post