অনলাইন ডেস্ক
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আমরা সবাই কম বেশি করোনায় সংক্রমিত এবং নেতিবাচক ভাবে প্রভাবিত। এসময় বড়দের মতো ছোটরাও অনেক শারীরিক ও মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই চলুন আপনার সন্তানের শারীরিক ও মানসিক যত্নের কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক-
ক) রোল মডেল- একজন মানুষের জীবনে অনেক রোল মডেল বা অনুকরণীয় আদর্শ থাকতে পারে তবে তার প্রথম, তাৎপর্যপূর্ণ মডেল হচ্ছে তার বাবা-মা। তাই প্রায়ই বলি বা শুনে থাকি যে, ‘ছেলেটা তার বাবার মতো বুদ্ধিমান হয়েছে, মার মতো গুণবতী হয়েছে, বা রাগী, বা ঝগড়াটে হয়েছে…’
বাচ্চারা ছোটবেলা থেকেই বাবা, মার আচরণ দেখা অথবা অনুকরণের মাধ্যমে শিখে থাকে। আপনার যদি প্রবণতা থাকে যে কোন সমস্যা মোকাবেলায় রেগে যাওয়া, হতাশ হওয়া, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করা, কান্নাকাটি করা তাহলে আপনার সন্তানের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা দিবে। আর আপনি যদি ‘প্রবলেম সলভিং এপ্রোচ’ অবলম্বন করেন, যেমন হতে পারে করোনার মতো চ্যালেঞ্জ অথবা আরো অন্য চ্যালেঞ্জকে শান্ত ভাবে মেনে নিয়ে, সবদিক বিবেচনা করে, সার্বিক উপায়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার অভ্যাস গড়ে তুলেন তাহলে অনেকটাই সমস্যা থেকে বের হওয়া সম্ভব হবে। এতে আপনার সন্তানেরও করোনা মোকাবেলা করার জন্য একই ব্যবস্থা নেয়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে।
ভালো রোল মডেলের জন্য দরকার চেষ্টা, ভালো চিন্তা ও কাজ করার অভ্যাস এবং নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ রাখা। আপনি সুস্থ থাকলে আপনি সন্তানদের প্রতি মনোযোগী হয়ে, তাদের শারীরিক, মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারবেন। আপনাকে হয়তো ঘরের কাজ, অফিসের কাজ, ছেলেমেয়েদের বাড়তি যত্ন, করোনার নিত্য নতুন তথ্য ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন থাকেন, এবং শংকিত হওয়াটা স্বাভাবিক। তাই যখনই উদ্বিগ্ন হবেন কারো সাথে শেয়ার করুন, এতে মন হালকা হবে এবং সমস্যা সমাধানের অনেক উপায় হয়তো খুঁজে পাবেন। চেষ্টা করবেন পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যালেন্সড ডায়েট, মেডিটেশন, ব্যায়াম, গান শোনা, বই পড়া, নাটক দেখা, সিনেমা দেখা, বাগান করা অথবা নতুন কিছু করা যা আপনার শরীর ও মনকে প্রফুল্ল রাখবে।
খ) রুটিন মেনে চলা- পরিবারের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট রুটিন রাখুন, তারা কখন ঘুমাবে এবং ঘুম থেকে উঠবে, খাবারের সময়, পড়ার সময়ের রুটিন এতে যার যার কাজ সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয় এবং অনেক কাজ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আপনি তাদের ছবি আঁকা, বিভিন্ন ছড়া, গল্প বলা ও শেখানো, ব্লক তৈরি করা অথবা ইমাজিনারি খেলার মাধ্যমে তাদের ব্যস্ত রাখতে পারেন। স্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদের তাদের বয়স ও আগ্রহ অনুসারে তাদের ফ্রি টাইমের জন্য আর্টস, ক্রাফটস, অনলাইনে নাচ, গান শেখা, ডায়েরি, ব্লগ বা গল্প লেখা, বিভিন্ন ভাষা শেখা, ‘জুম’ বা ‘স্কাইপে’র মাধ্যমে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, বিভিন্ন অনলাইন কোর্স এবং নানা সৃজনশীল কাজে উৎসাহ দিতে পারেন।
‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’ সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছে যে, বড়দের ৩০ মিনিট এবং ছোটদের ১ ঘণ্টা শারীরিক কার্যাবলিতে যুক্ত থাকতে, তাই তাদের রুটিন করে বিভিন্ন ব্যায়াম করতে উৎসাহিত করুন। এছাড়া প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের রিলাক্সেশন মিউজিক শুনে বা মেডিটেশন করে তারা তাদের মন ও শরীরকে ভালো রাখতে পারবে।
প্রতিদিনের যে রুটিন তৈরি করুন না কেন সবসময় চেষ্টা করবেন আপনার সন্তানদের সাথে ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটাতে এবং রুটিনে বৈচিত্র্য আনতে, এতে একঘেয়েমি দূর হবে যেমন, হঠাৎ ফ্যামিলি পিকনিক বা একসাথে খেলা যেমন লুডু, ক্যারাম ইত্যাদি। ভবিষ্যতে কি হবে সেটার দুশ্চিন্তা না করে আপনি নিজেকে এবং আপনার সন্তানকে আজকের দিনকে উপভোগ করার ও আজকের দিনের কাজ গুলোকে মনোযোগ দিয়ে করার অভ্যাস করান এতে অনেক দুশ্চিন্তা কমে আসবে।
গ) দায়িত্ববোধ বাড়ানো- স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় পরিবারের বড়দের এখন অনেক বেশি কাজের দায়িত্ব নিতে হচ্ছে। তাই চেষ্টা করুন আপনার সন্তানের বয়স অনুযায়ী ছোট ছোট কাজের দায়িত্ব দিতে। যেমন, খাবারের পর সে তার নিজের প্লেট পরিস্কার করা, ফুলের টবে পানি দেওয়া, টিনেজরা ছোট ভাই বোনদের কিছুটা দেখাশোনা করা, রান্নাতে সাহায্য করা, তাদের নিজেদের ঘর, বাড়িঘর গোছানো ও পরিস্কার রাখা। করোনার সময়ে এই যুদ্ধটা আমাদের সবার তাই সন্তানদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার বোধ তৈরি হওয়া জরুরি। যখন কোন কাজ করবে তাদের প্রশংসা করুন এতে তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং পরিবারের প্রতি তাদের দায়িত্ববোধ বাড়বে।
ঘ) দুশ্চিন্তার বাক্স ও জার্নালিং- দুশ্চিন্তা লাঘব করার ক্ষেত্রে লেখা একটি শক্তিশালী মাধ্যম। লেখার মাধ্যম হিসেবে দুশ্চিন্তার বাক্স ও জার্নালিং লেখা নিয়ে আলোচনা করবো।
১. দুশ্চিন্তার বাক্স- বড়দের মতো ছোটরাও রাতে ঘুমানোর সময় আগে কি হয়েছিলো বা ভবিষ্যৎ/ আগামীকাল কি হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে। যার ফলে মন খারাপ করে থাকে এবং রাতে ঘুমাতে পারে না। তাই করোনার এই অনিশ্চয়তার বা অন্য চ্যালেঞ্জের সময়ে যদি আপনার সন্তানের মধ্যে অনেক মন খারাপ বা ঘুমের অসুবিধা হয় তবে ‘দুশ্চিন্তার বাক্স’ পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারেন। এটি ৩-১২ বছর বয়সের শিশুর জন্য বেশি কার্যকর। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় অথবা রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ৫-১০ মিনিট ধরে এই প্রক্রিয়া করতে পারেন। আপনি এবং আপনার সন্তান ঠিক করবেন দুশ্চিন্তার বাক্সটি কেমন হবে, হতে পারে এটি টিফিন,টিস্যু বা যেকোন বাক্স। একটি কাগজে আপনার সন্তান তার দুশ্চিন্তা/ মন খারাপের কথা ড্রয়িং করবে বা লিখবে এবং এই বিষয়ে আপনারা দুজন কথা বলবেন, অতপর লেখাটি দুশ্চিন্তার বাক্সে রাখবেন। সবশেষে আপনি এবং আপনার সন্তান বাক্সটি কোন নিরাপদ জায়গায় রাখবেন তা ঠিক করবেন। তবে তা বেডরুমে না রাখাই ভালো। লেখা বা ড্রয়িংয়ের মাধ্যমে সে তার মন থেকে চিন্তা বের করে সেটি দুশ্চিন্তার বাক্সে রাখবে, এতে করে সে তার দুশ্চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখবে। এই প্রক্রিয়া নিয়মমাফিক প্রতিদিন করতে হবে যতোদিন না তার সেই ভয়/রাগ/কষ্ট/ দুশ্চিন্তা দূর হয়। যখন তার সমস্যা দূর হয়ে যাবে তখন সন্তানকে সাথে নিয়ে সে কাগজ ছিঁঁড়ে ফেলুন।
২) লেখা বা জার্নালিং– টিনএজরা করোনার এই সময়ের সমস্যা, দুশ্চিন্তা, কষ্টের কথা লিখতে পারে। টেক্সাস ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর জেমস বিশ বছর ধরে গবেষণা করে দেখেছেন যে, মনের কষ্টের কথা লিখতে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো থাকা যায়। তাই তিনি এই গবেষণার ভিত্তিতে ‘রাইটিং টু হিল’ নামে একটি বই লিখেছেন। তাই আপনার সন্তানদের এই সময়ে লিখতে বা জার্নালিং করতে উৎসাহিত করতে পারেন।
ঙ) আবেগ চিহ্নিত করা- চাপ বা দুশ্চিন্তার লক্ষন বা প্রকাশ ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। এই সময়ে আপনার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেশি মন খারাপ করে থাকা, অতিরিক্ত রাগ প্রদর্শন, ভীত থাকা, স্কুলে না যেতে পেরে একাকীবোধ করা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। টিনএজদের হরমোনের পরিবর্তনের কারণে তাদের আবেগ দ্রুত পরিবর্তিত হয় তাই বাবা মার সাথে মতবিরোধ হবার সম্ভাবনা থাকে বেশি। তাই আপনার সন্তানদের সাথে এমন একটি মানসিক সম্পর্ক তৈরি করুন যাতে তাদের মন ভালো ও খারাপ দুটোই আপনার সাথে শেয়ার করতে পারে। সন্তানদের বয়স অনুযায়ী তাদের আবেগ বুঝুন। তাদেরকে বেশি সময় দিয়ে নিরপেক্ষভাবে তাদের কথা শুনুন, আবেগ মূল্যায়ন করুন, তাদের কষ্টগুলোকে তাদের জায়গা থেকে বোঝার চেষ্টা করুন। এভাবে আপনার সন্তান আপনার সাথে কথা শেয়ার করবে এবং একাত্মবোধ করবে।
চ) খোলামেলা আলোচনা করা- আপনার সন্তানেরা করোনা ভাইরাস সম্পর্কে কতটুক জানে তা নিয়ে আলোচনা করুন, তাদের করোনা সংক্রান্ত কিছু জানার ইচ্ছা থাকলে তা প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করুন। আপনার সন্তানের বয়স অনুযায়ী তাদের প্রশ্নের উত্তর দিন। তবে নিজ থেকে খুব বেশি তথ্য না দেওয়াই ভালো, এতে করে তাদের মধ্যে ভয়ের উদ্রেক হতে পারে। কিন্ত অতিমাত্রায় খবর দেখা, আপনার ও আপনার সন্তানদের মধ্যে উদ্বিগ্নতা তৈরি করতে পারে। তাই নির্দিষ্ট সময় করে দিনে ১/২ বার করোনা সম্পর্কিত নিউজ দেখুন বা পড়ুন।
ছ) ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করা- আশাবাদী, ইতিবাচক চিন্তা আমাদের শরীর ও মনকে সুস্থ রাখে। তাই পরিস্থিতি যতই খারাপ হোক না কেন আপনি আপনার এবং সন্তানদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব জাগ্রত করুন, এতে তারা করোনা পরিস্থিতিকে অনেকটা মোকাবেলা করতে শিখবে। আপনি আপনার সন্তানকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অভ্যাস করান এবং আশ্বস্ত করুন সে নিরাপদে আছে এবং আরো বলতে পারেন, যদিও করোনা সংক্রান্ত অনেক নেতিবাচক ঘটনা ঘটছে কিন্ত এটা একদিন দূর হয়ে যাবে। অনেক দেশের গবেষক, বিজ্ঞানীরা এর টিকা আবিস্কারের চেষ্টা করছেন, চিকিৎসার নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন।
চলুন আমরা আমাদের এবং সন্তানদের মধ্যে ‘আমরা করবো জয়’ এই ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করি এবং সেই অনুযায়ী সর্বোত্তম সতর্ক ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
‘আমরা করবো জয়, আমরা করবো জয়,
আমরা করবো জয়, নিশ্চয়,
এই বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়,
আমরা করবো করোনা জয়, নিশ্চয়।’
লেখক, ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট, এনএইচএস, যুক্তরাজ্য।
Discussion about this post