সাখাওয়াত আল হোসাইন
রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন ফাতেমা ও তার পরিবার। তার ঘরে রয়েছে আনাস ও আবির নামে দুটি সন্তান। আনাসের বয়স নয় বছর। আর আবিরের বয়স সাত বছর। আনাস বেশ বুদ্ধিমান। সে এবার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। স্কুলের বন্ধু-বান্ধবদের সাথে ভালোই সম্পর্ক রয়েছে তার। খেলাধুলা-পড়াশোনা সব দিক দিয়ে অদ্বিতীয় আনাস।
এদিকে আনাসের ছোট ভাই আবির একটু উগ্র মেজাজের। সবসময় নীরব-একা থাকতে পছন্দ করে। কার্টুনের ভক্ত আবির স্কুল থেকে ফিরেই টিভির রিমোট নিয়ে বসে। টম অ্যান্ড জেরি, গান-বাজনা, সিনেমা নাটকসহ তার পছন্দের তালিকা অনেক দীর্ঘ।
কৌতুহলবশত একদিন বাবার মোবাইলে গেমস খেলে, তাতে আসক্ত হয়ে যায় আবির। স্কুল থেকে বাসায় ফেরেই রাত-বিরাত আনন্দ-বেদনা সবসময় কিছুই গেমস নিয়ে ব্যস্ত থাকে আবির। এখন আর কারও কথা শুনতে চায় না।
কিছুদিন আগে গেমস খেলার ফাঁকে অসুস্থ হয়ে পড়ে আবির। তাকে নেওয়া হয় চিকিৎসকের কাছে। চিকিৎসক জানিয়েছে, মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে গেছে আবির। তার দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন।
নিজের ব্যর্থতার কথা বলতে গিয়ে আবিরের মা মেডিভয়েসকে বলেন, পরিবারের কষ্ট লাঘব করতে ঢাকায় চাকরি করে আবিরকে পর্যাপ্ত সময় ও যত্ন করা হত না তার। বাহিরে অন্য ছেলেদের সাথে সঙ্গ দিয়ে খারাপ হয়ে যাবে বলে তাকে চার দেওয়ালের বাহিরে যেতে দেওয়া হত না।
দুই ছেলের বেড়ে ওঠার বিষয়ে জানতে চাইলে ফাতেমা বলেন, আনাস যখন জন্মেছে তখন তার চাকরি ছিল না। সংসারে ফাকে ফাঁকে তাকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হত। তাকে নিয়ে বিভিন্ন সময় খেলাধুলা, ঘুরাফেরা করতে নিয়ে যেতেন ফাতেমা।
ডেমরার শিশু বিদ্যানিকেতনের চতুর্থ শ্রেনীর পড়ুয়া সাব্বির হোসেন বলেন, ‘মা চাকরি করে আর বাবা থাকে বরিশাল। স্কুল আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যাপক চাপে থাকতে হয় তার। স্কুল থেকে আসলেই ধারাবাহিকভাবে প্রাইভেট টিচার পড়াতে আসে। মা-বাবার আদর যত্ন ঠিক পাচ্ছে না বলেও তার অভিযোগ।’
শিশুর বেড়ে ওঠার সময়
জন্মের পর থেকে প্রথম আট বছর শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। এ সময় শিশুর শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের পরিবর্তন হয়। এ সময়ে শিশুর মস্তিস্ক নমনীয় থাকে এবং দ্রুত বিকশিত হয়। শিশুর ভালো ও খারাপ অভিজ্ঞতাগুলো মস্তিস্কের বৃদ্ধির ওপর কড়া প্রভাব ফেলে। এই বয়সে অবহেলা বা নির্যাতন শিশুর বুদ্ধিবৃত্তি, আচরণ ও আবেগের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের চেয়ারম্যান নেহাল করিম মেডিভয়েসকে বলেন, এ সময় শিশুকে ভালো দিকে সঙ্গ দিতে হবে। শিশুর মেধা ও সৃজনশীলতা বিকাশে প্রয়োজন সঠিক, সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহন করতে হবে। তার ভুলক্রটি আবেগগুলো সংশোধন করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
শহরের শিশুদের বেড়ে ওঠার প্রতিবন্ধকতা
শহুরে পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুরা ছোটবেলা থেকেই আবদ্ধ পরিবেশে বড় হয়। তারা দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটিয়ে দেয় চার দেওয়ালের ভিতর। শহরের শিশুরা রেজাল্ট ভাল করার প্রতিযোগিতায় মানসিক অবসাদে থাকে।
এ শিশুদের অধিকাংশ পিতা-মাতাই হয়ে থাকেন কর্মজীবী। ফলে বেশিরভাগ সময় একাকিত্বে ভোগে এ শিশুরা। শহরের প্রায় শিশুরই সময় কাটে প্রযুক্তির উপর। এতে সহজেই শিশুরা মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে জানিয়ে নেহাল করিম মেডিভয়েসকে বলেন, ‘সন্তানকে প্রচুর সময় দিতে হবে। শিশুকে খোলামেলা সামাজিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার জন্য তাগিদ দিতে হবে। এক্ষেত্রে মা বাবাকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।’
শিশুর পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা
অনেক পরিবারে প্রতিদিন মা-বাবার ঝগড়ার প্রত্যক্ষদর্শী বেশির ভাগ শিশুর মধ্যে পরবর্তীতে ব্যক্তিত্বের অস্বাভাবিকতাও দেখা যায়। সমাজে মানিয়ে চলতে অসুবিধা হয় তাদের। গর্ভকালে যেসব মা নির্যাতনের শিকার হন বা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন, তাঁদের সন্তান জন্মের পর নানা জটিলতায় ভোগে।
মাতৃগর্ভে থাকার সময় যেসব মা মানসিক আঘাতের শিকার হন, সেই শিশুরা সহজেই মানসিক চাপে ভেঙে পড়ে জানিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও লেখক অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘পিতামাতা যদি সুস্থ থাকে তাহলে শিশুরাও সুস্থ হবে।’শিশুর মানসিক বিকাশে মা-বাবার ভালোবাসা ও সান্নিধ্যের কোনো বিকল্প নেই। পিতামাতাকে ছোট খাটো সাইকোলজিস্টের ভূমিকা পালন করতে হবে।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, পারিবারিক কলহের মধ্যে বেড়ে ওঠা বা মাকে নির্যাতিত হতে দেখা শিশুদের জীবনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে তারা হয় বিশেষভাবে অরক্ষিত ও অসহায়। এসব শিশু পরবর্তীকালে হিংস্র, ঝুঁকিপূর্ণ বা অপরাধমূলক আচরণ করতে পারে। বিষণ্নতা বা তীব্র দুশ্চিন্তায় ভোগার ঝুঁকিতেও পড়তে পারে এসব শিশু।
নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও বিনোদন কেন্দ্র
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে শিশুদের জন্য নেই পর্যাপ্ত খেলার মাঠ ও বিনোদন কেন্দ্র। শিশুদেরকে সামাজিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার ব্যাপরে তাগিদ দিতে। শিশুদের জন্য অঞ্চল ভিত্তিক বয়সভেদে খেলার মাঠ ও বিনোদন কেন্দ্র তেরি করতে হবে জানিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব মেডিভয়েসকে বলেন, ‘শিশুদেরকে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য স্কুলের পাশাপাশি খেলার মাঠ ও বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করতে হবে।’
শিশুদের জন্য আলাদাভাবে সরকারকে ভাবতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বিনোদন কেন্দ্র, খেলার মাঠ তৈরি করা হয়। কিন্তু শিশুদের জন্য সুনির্দিষ্ঠভাবে করা হয় না। শিশু যাতে খোলামেলা পরিবেশে বেড়ে ওঠার জন্য সরকারকে সময়োপযোগী উদ্যোগ নিতে হবে।
শিশুকে যাতে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্ধি না রাখা যায়। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আবাসিক এলাকা নির্মাণ করার পাশাপাশি শিশুদের জন্য খেলার মাঠ ও বিনোদন কেন্দ্র তৈরি করে দিতে হবে। প্রত্যেকটি ফ্লাইওভারের নিচে শিশুদের জন্য খেলাধুলার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।
মানসিক রোগে আক্রান্ত শিশুর পরিসংখ্যান
মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৮ দশমিক ৪ ভাগই মানসিক রোগে আক্রান্ত। এছাড়া এ বয়সী শিশুদের ৩ দশমিক ৮ ভাগ মানসিক প্রতিবন্ধী, ২ ভাগ মৃগিরোগে আক্রান্ত এবং শূন্য দশমিক ৮ ভাগ মাদকাসক্ত।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি চারটি শিশুর মধ্যে তিনটি শিশু মানসিক নির্যাতনের এবং প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে দুটি শারীরিক শাস্তি ভোগ করেছে।
Discussion about this post