বিনোদন ডেস্ক
যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবৈষম্য আন্দোলন তুঙ্গে থাকার সময় বড় পর্দার নিয়মিত মুখ ছিলেন। চলচ্চিত্রে বর্ণবৈষম্য দূর করায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে অস্কারে সেরা অভিনেতা হয়েছেন। হলিউডে কালোদের পথিকৃৎ সেই সিডনি পটিয়ার আর নেই। শুক্রবার (৭ জানুয়ারি) তিনি চলে গেছেন চিরঘুমে। ৯৪ বছর বয়সে নিভে গেলো তাঁর জীবনপ্রদীপ।
অস্কারজয়ী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা সিডনি পটিয়ারের মৃত্যুর খবর ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে নিশ্চিত করেছে বাহামার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আটলান্টিক মহাসাগরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপপুঞ্জে এই সার্বভৌম দেশে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন তিনি। ১৯৭৩ সালে দেশটির স্বাধীনতা অর্জনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন গুণী মানুষটি।
শুক্রবার ফেসবুক লাইভে বাহামার প্রধানমন্ত্রী ফিলিপ ডেভিস বলেন, ‘আমাদের পুরো বাহামা শোকাহত। তবে শোক প্রকাশের মধ্যেও আমরা একজন মহান বাহামিয়ানের জীবনকে উদযাপন করছি। মানুষ হিসেবে তার চরিত্রের শক্তি, উঠে দাঁড়ানোর স্পৃহা এবং যেভাবে তিনি জীবনযাত্রার পরিকল্পনা করে সঠিক পথ পাড়ি দিয়েছেন তা অবিস্মরণীয়। টমেটো ক্ষেতে বেড়ে উঠে কৈশোরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ওয়েটার হতে চলে গিয়ে লেখাপড়া শিখেছেন এবং সংলাপ ও ভাবনার অভিব্যক্তি সাজিয়ে অনুভূতির প্রকাশে কর্মজীবনকে আলোকিত করেছেন।’
২০০৯ সালে সিডনি পটিয়ারকে আমেরিকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘মেডেল অব ফ্রিডম’ দেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি বলেন, ‘উৎকর্ষতা ও সরলতার চমৎকার উদাহরণ ছিলেন সিডনি পটিয়ার। তাঁর প্রতিভা ছিল স্বতন্ত্র। তিনি দেখিয়েছেন, চলচ্চিত্রের প্রভাব আমাদের একতাবদ্ধ করেছে এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের জন্য দুয়ার খুলে দিয়েছেন।’
২০০০ সালে সিডনি পটিয়ারের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন আমেরিকান টিভি ব্যক্তিত্ব অপরাহ উইনফ্রে। তিনি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনে বলেন, ‘আমি বলবো মহান একজনের প্রস্থান হলো। তিনি ছিলেন বড় মনের মানুষ। আমার হৃদয়ে তাঁর জায়গা থাকবে চিরকাল।’
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান হিসেবে অস্কার, এমি ও টনি অ্যাওয়ার্ড জয়ী অভিনেত্রী ভায়োলা ডেভিস বলেন, ‘সিডনি পটিয়ারের কাজ আমার জীবনকে কীভাবে আমূল বদলে দিয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না।’
আরেক কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেত্রী হুপি গোল্ডবার্গ ‘টু স্যার, উইথ লাভ’ ছবির টাইটেল গানের কথা শেয়ার করেছেন। তিনি বলেন, ‘সিডনি পটিয়ার আমাদের দেখিয়েছেন কীভাবে তারার কাছে পৌঁছাতে হয়।’
১৯২৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের মিয়ামিতে জন্মেছিলেন সিডনি পটিয়ার। তবে বেড়ে ওঠেন বাহামা দ্বীপপুঞ্জে। তাঁর বাবা-মা ছিলেন সাধারণ কৃষক। তারা টমেটো চাষ করে বিক্রির জন্য আমেরিকায় যেতেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগে সিডনি পটিয়ারের জন্ম হওয়ায় বাহামার মতো আমেরিকান নাগরিকত্বও পান তিনি। ১৫ বছর বয়সে মিয়ামিতে ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে বাহামা ছাড়েন। এর পরের বছর পাড়ি জমান নিউ ইয়র্কে। সেখানে পকেট খরচ মেটাতে থালা-বাসন পরিষ্কারের কাজ করেন। এছাড়া অল্প সময় ছিলেন সেনাবাহিনীতে। অভিনয়ের ওপর লেখাপড়ার জন্য যোগ দেন আমেরিকান নিগ্রো থিয়েটারে। ১৯৪৯ সালে মঞ্চের গণ্ডি পেরিয়ে রুপালি পর্দায় যাওয়ার মনস্থির করেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের ব্যস্ত তারকা হয়ে ওঠেন সিডনি পটিয়ার। তিনিই হলিউডে জাতিগত বেড়াজাল ভেঙে দিয়েছেন। একইসঙ্গে উপহার দিয়েছেন বৈচিত্র্যময় কাজ।
১৯৫৮ সালে ‘দ্য ডিফায়েন্ট ওয়ানস’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে অস্কারে সেরা অভিনেতা শাখায় মনোনয়ন পান সিডনি পটিয়ার। তখন এটি ঐতিহাসিক অর্জন হিসেবে দেখা হয়েছিল। ওই বছর বাফটা পান তিনি। ১৯৬৩ সালে ‘লিলিস অব দ্য ফিল্ড’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য অস্কারে সেরা অভিনেতার পুরস্কার জেতেন। এতে তাকে দেখা গেছে কাজের লোকের ভূমিকায়। জার্মান নারী যাজকদের মরুভূমিতে উপাসনালয় তৈরিতে সহযোগিতা করে লোকটি।
হলিউডে সিডনি পটিয়ার অভিনীত আরও কয়েকটি ছবি ধ্রুপদী হয়ে আছে। এ তালিকায় রয়েছে ‘নো ওয়ে আউট’ (১৯৫০), ‘দ্য ব্ল্যাকবোর্ড জঙ্গল’ (১৯৫৫), ‘অ্যা রেইজিন ইন দ্য সান’ (১৯৬১), ‘অ্যা প্যাচ অব ব্লু’ (১৯৬৫), ‘হিট অব দ্য নাইট’ (১৯৬৬), ‘টু স্যার, উইথ লাভ’ (১৯৬৭), “গেস হু’স ইজ কামিং টু ডিনার” (১৯৬৭)।
‘হিট অব দ্য নাইট’ ছবিতে কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তার চরিত্রে খুনের তদন্ত চলাকালে বর্ণবাদকে মোকাবিলা করেছেন। এজন্য বাফটা ও গোল্ডেন গ্লোবে মনোনয়ন পান তিনি। “গেস হু’স ইজ কামিং টু ডিনার”-এ তার বাগদত্তার চরিত্র ছিল শ্বেতাঙ্গ নারীর। এর দৃশ্যধারণের সময় যুক্তরাষ্ট্রে ১৭টি রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ বিয়ে অবৈধ ছিল। ছবিটি মুক্তির একমাস আগে সেই আইন বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট।
১৯৭৪ সালে সিডনি পটিয়ারকে সম্মানসূচক নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করেন ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। ১৯৯২ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা হিসেবে আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার পান তিনি।
সত্তর দশকের শেষের দিকে নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান চালু করেন সিডনি পটিয়ার। এরপর বেশকিছু চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘স্টার ক্রেজি’ (১৯৮০), ‘হাঙ্কি পাঙ্কি’ (১৯৮২), ‘ফাস্ট ফরওয়ার্ড’ (১৯৮৫), ‘গোস্ট ড্যাড’ (১৯৯০)।
শুধু পথিকৃৎ কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতা নন, সিডনি পটিয়ার ছিলেন মানব দরদি ও কূটনীতিক। ১৯৯৭ সালে জাপানে বাহামার দূত হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। একজন বাহামিয়ান নাগরিক হিসেবে তিনি একটি স্বতন্ত্র নাইটহুডের যোগ্য ছিলেন। কিন্তু তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বাসিন্দা এবং বাহামিয়ান বংশোদ্ভুত হওয়ায় বাহামিয়ান সরকার সম্মানসূচক পুরস্কার দিয়েছে।
২০০২ সালে সিডনি পটিয়ারকে সম্মানসূচক অস্কার দেয় অ্যাকাডেমি অব মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সেস কর্তৃপক্ষ। একই আসরে সেরা অভিনেতা শাখায় অস্কার জেতেন আরেক কৃষ্ণাঙ্গ তারকা ডেনজেল ওয়াশিংটন। অস্কারে কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের গুরুত্ব দেওয়ার পথ তৈরিতে তাঁর ভূমিকা ছিল ব্যাপক।
চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালে বাফটা ফেলোশিপে ভূষিত হন সিডনি পটিয়ার। তবে ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে লন্ডন গিয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। তাই ভিডিওতে যোগ দেন।
ব্যক্তিজীবনে দু’বার বিয়ে করেন সিডনি পটিয়ার। ১৯৫০ সালে হুয়ানিটা হার্ডির সঙ্গে ঘর বাঁধেন। ১৫ বছর পর সেই বিয়ে ভেঙে যায়। ১৯৭৬ সালে কানাডিয়ান অভিনেত্রী জোয়ানা শিমকাসকে বিয়ে করেন তিনি। দুই সংসারে তার ছয় কন্যাসন্তান আছে। তাদের মধ্যে সিডনি টামিয়া পটিয়ার একজন টিভি অভিনেত্রী।
তথ্যসূত্র: বিবিসি
Discussion about this post