রিয়াদ তালুকদার
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পরিচয়ের সূত্র ধরে ঢাকার বসবাসরত যুবক জহিরুলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তরুণী মনির (ছদ্মনাম)। কয়েক দিনের এই সম্পর্কের জেরে জহিরুলের সঙ্গে দেখা করতে রাজধানীর উত্তরায় চলে আসে ওই তরুণী। পরে দুজনের সম্মতিতেই স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে তারা একটি বাসায় থাকতে শুরু করেন; বিষয়টি জানতে পারে তাদের কয়েকজন প্রতিবেশী। তাদের ‘অবিবাহিত’ জীবনযাপনের ‘সুযোগ নিয়ে’ জহিরুলের হাত-পা বেঁধে মেয়েটিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে প্রতিবেশী কয়েক যুবক। এ ঘটনায় পরে ভুক্তভোগী বাদী হয়ে উত্তরা থানায় মামলা দায়ের করলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
বছরখানেক আগে সাব্বির নামে এক যুবকের সঙ্গে অনলাইনে পরিচয় হয় কামরুন্নাহারের (ছদ্মনাম)। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে সম্পর্ক গভীর হয়। মেসেঞ্জার এবং ইমোর মাধ্যমে ভিডিও কলে কথা বলার সময় মেয়েটির কিছু ‘ব্যক্তিগত ছবি’ স্ক্রিনশট দিয়ে রাখে ওই যুবক। পরে সেসব ছবি দিয়ে মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে সাব্বির। অভিযোগ জানানো হলে র্যাব অভিযুক্ত সাব্বিরকে গ্রেফতার করে।
এ ছাড়া গত ১০ জানুয়ারি অনলাইনে পরিচয়ের সূত্র ধরে ট্রান্সজেন্ডার এক নারী তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হন বলেও অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী সেই ট্রান্সজেন্ডার নারী বলেন, দেখা করতে যাওয়ার পর কৌশলে তাকে বাসায় ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে যৌন হয়রানি এবং নগ্ন ছবি ধারণ করার চেষ্টা করা হয়। এ ঘটনায় অভিযুক্ত তিন জনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তিনটি ঘটনারই স্থান, কাল, পাত্র ভিন্ন হলেও সবগুলোর মাধ্যম অনলাইন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক; স্বল্প সময়ের অনলাইনে পরিচয়ের সূত্র ধরে মোবাইল ফোনে হ্যারেসমেন্ট, অশ্লীল কনটেন্ট আদান-প্রদানের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইলসহ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হচ্ছেন সব বয়সী নারী-পুরুষ। এছাড়া ফেইক আইডি কিংবা আইডি হ্যাকের মতো ঘটনা তো প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অনলাইনে বিশেষ করে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে স্বল্প সময়ের পরিচয়ে, পরিচিত ব্যক্তি সম্পর্কে না জেনে বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিগত তথ্য কিংবা ছবি আদান প্রদান করে থাকে অনেকেই। আর এসব ছবিকে ঘিরে তৈরি হয় ব্ল্যাকমেইলের মতো ঘটনা। এছাড়া স্বল্প সময়ের পরিচয়ে দেখা-সাক্ষাৎ করতে গিয়েও হচ্ছে যৌন হয়রানির মতো ঘটনা। অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা চাইলেও সামাজিক মর্যাদার কথা চিন্তা করে আইনানুগ কোনও ব্যবস্থা নিতে চান না ভুক্তভোগী নারী কিংবা পুরুষ।
ভুক্তভোগী নানা বয়সীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনলাইনে পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রতিনিয়ত বন্ধুত্বের তালিকা দীর্ঘ হয় তাদের। বিভিন্ন সময় চ্যাটিং করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে নতুন করে বন্ধুত্ব হচ্ছে। কয়েক দিন চ্যাটিংয়ের পরে নিজেদের ফোন নম্বর আদান-প্রদান করে কথা বলা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে দেখা করতে যাওয়া হয়। আর তারপরই বিভিন্ন ধরনের হয়রানির শিকার।
নাম প্রকাশে এক তরুণী জানান, আমি এবং আমার পরিচিত অনেকেই স্বল্প সময়ের বন্ধুত্বের পরিচয় সূত্র ধরে হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছি, ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছি। আমি চাই না আমাদের মতো অন্য কারও সঙ্গে এ ধরনের ঘটনা ঘটুক। আমরাও এখন থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আরও সতর্ক থাকবো এবং সবাইকে একটা কথাই বলবো—যাই করবেন, আগে নিজের নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রেখে অপরিচিত কারও সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। পরিচয়ের সূত্র ধরে কেউ কোথাও যাওয়ার অফার করলো তাতেই চলে যাবেন না।
পুলিশ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্প সময়ের পরিচয় সূত্র ধরে অনেকেই দূর-দূরান্তে চলে যান দেখা করার জন্য। এভাবে অনেকেই ফাঁদে পড়েছেন, প্রতারণার শিকার হয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। আবার এমন ইস্যুতে হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাও ঘটেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনলাইনে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচিত হওয়া দোষের কিছু নয়। কিন্তু কারও সম্পর্কে না জেনে তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া ঠিক নয়। পরিচিত ব্যক্তির সম্পর্কে না জেনে দেখা করতে গিয়ে অনেকেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ ধরনের হয়রানির শিকার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সম্পর্ক স্থাপন এবং দেখা-সাক্ষাতের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অনলাইনে প্রতারণা, নির্যাতন কিংবা হয়রানির ঘটনার বিষয় যখন পুলিশের সহায়তা চাওয়া হয়, তখন অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরাই বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতায় পড়েন। থানা থেকেও সেই ধরনের সহায়তায় বঞ্চিত হন তারা। মামলা করতে গেলেও অনেক সময় ভুক্তভোগী নারীকেই উল্টো ব্লেইম দেওয়া হয়। আর এসব কারণেই বেশিরভাগ মানুষ প্রতারিত হলেও এসব বিষয় হাইড রাখেন। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও সতর্ক হতে হবে। সাইবার বিষয়ক যেকোনও মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
পুলিশ সদর দফতরের সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন ল’ ফুল ইন্টারসেকশন সেলের এআইজি মীর আবু তৌহিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা ফেসবুক মেসেঞ্জার, ইমেইল এবং ফোনের মাধ্যমে অনেক ধরনের অভিযোগ পেয়ে থাকি। অভিযোগ জানালেও আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে রাজি হন না অনেকেই। তবে আমরা প্রতিনিয়ত মোটিভেট করে যাচ্ছি। অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাদের সঙ্গে পরিচয় হোক না কেন, সেসব বিষয়ে যেন তারা আরও সচেতন থাকেন, এটাই পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়। পরবর্তী সময়ে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হতে হয়, এমন কোনও ছবি বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারও কাছে যেন দেওয়া না হয় সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকারও পরামর্শ দেন তিনি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি অভিযানে আমরা দেখতে পেয়েছি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী কিংবা পুরুষের সঙ্গে প্রথমে সখ্য গড়ে তোলে একটি চক্র। পরে দেখা সাক্ষাতের কথা বলে তাদের নির্ধারিত জায়গায় নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করা হতো। অনেকেই ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আসতো না। মূলত টাকার কারণেই এই চক্রটি অনলাইনে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে নারী কিংবা পুরুষদের জিম্মি করে। এই চক্রটি কাছ থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। সে অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।
একই ধরনের চক্রের কথা উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক। তিনি মনে করেন, এসব বিষয়ে প্রতিরোধে পরিবারকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই সম্পর্কগুলো ভার্চুয়ালি সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। যদি এই পরিচয়ের সূত্র ধরে কোনও বিষয়ে সহায়তা কিংবা চাকরির মতো বিষয়গুলো অফার করে থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সম্পর্কে জেনে-বুঝে পরবর্তী ধাপগুলোতে এগোনো উচিত। অতি উৎসাহে অনেকেই হয়রানি এবং নাজেহাল হচ্ছে।
Discussion about this post