মসলাজাতীয় ফসলের তালিকায় শীর্ষ ব্যবহারযোগ্য ফসলের মধ্যে হলুদ অন্যতম। কাঁচা হলুদ থেকে শুরু করে গুঁড়া হলুদের ব্যবহার ব্যাপক। নিত্য খাবার ব্যঞ্জনের রঙ করার উদ্দেশ্যেই প্রধানত এর ব্যবহার হয়ে থাকে তা নয়। শারীরিক প্রয়োজনেও হলুদের ব্যবহার হয়ে থাকে। শুধুমাত্র হলুদ দিয়েই রোগ নিরাময়ে বহুমাত্রিক ব্যবহার সম্ভব।
নিম্নে সংক্ষেপে হলুদের রোগ নিরাময়ে প্রয়োগ ও ব্যবহার তুলে ধরা হলো-
মুখের রঙ উজ্জ্বল্যে : হলুদের এক নাম ‘হরিদ্রা’; আর এক নাম ‘বর্ণ বিধারণী’। মুখের লালিত্য বজায় রাখার জন্য মসুর ডাল ও কাঁচা হলুদ বেটে দুধের সর মিশিয়ে মুখে ও হাতে মাখতে হবে। ২ ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেলুন এবং ১ মাস ধরে ব্যবহার করুন।
ব্রণ নিরাময়ে : সকালে খালি পেটে ২ টুকরো কাঁচা হলুদ ও ২টা নিমপাতা একসঙ্গে (আখের গুড়সহ) মিশিয়ে খেলে ব্রণ সেরে যায় আবার দেহের রঙও উজ্জ্বল হয়।
পেটের ক্রিমিতে : হলুদের এক নাম ক্রিমিনাশকারী। বয়সের তারতম্য অনুযায়ী ১৫-২০ ফোঁটা কাঁচা হলুদের রস ছেঁকে নিয়ে তাতে অল্প লবণ মিশিয়ে সকালে খালিপেটে ৭ দিন খেতে হবে।
প্রমেহ রোগে : প্রস্রাবের জ্বালার সঙ্গে পুঁজের মতো লালা নির্গত হলে, কাঁচা হলুদের রস ১ চা-চামচ একটু মধু বা চিনি মিশিয়ে ২-৩ সপ্তাহ খেতে হবে। এমনকি এর দ্বারা অন্যান্য প্রকার প্রমেহ রোগেরও উপশম হয়ে থাকে।
গায়ের রঙ উজ্জ্বল করতে : কাঁচা হলুদ, কমলালেবুর খোসা ও নিমপাতা একসঙ্গে পানি দিয়ে বেটে গায়ে মেখে এক ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেললে গায়ের রঙ উজ্জ্বল হয় এবং চর্ম রোগ প্রতিরোধ হবে। এটা সপ্তাহে অন্তত ৩-৪ দিন লাগাতে হবে।
শরীরের দাগ উঠাতে : গায়ে হাম বসন্ত বা চুলকানির দাগ থাকলে কাঁচা হলুদ ও নিমপাতা একত্রে বেটে কয়েক দিন লাগালে দাগ উঠে যাবে ও চামড়া ফর্সা হবে।
স্বর ভঙে : কোনো সাধারণ কারণে গলা বসে স্বর রুদ্ধ হয়ে গেলে ২ গ্রাম পরিমাণ হলুদ গুঁড়ার শরবত চিনি মিশিয়ে একটু গরম করে ১ ঘণ্টা পরপর ৪-৫ বার খেলে চমৎকার উপকার হয়।
ফোঁড়া পাকাতে ও শুকাতে : হলুদ আগুনে পুড়িয়ে পোড়া ছাই সামান্য পানিতে গুলে ফোঁড়ায় লেপে দিতে হবে। এতে ফোঁড়া পেকে গিয়ে ফেটে যাবে। এরপর গুঁড়া হলুদ সামান্য পানিতে গুলে প্রলেপ দিলে ফোঁড়া শুকিয়ে যাবে। অথবা সামান্য হলুদের সঙ্গে সামান্য চুন মিশিয়ে গরম করে চিমটি পরিমাণ ফোঁড়ার মাথায় লাগালে ফোঁড়া ফেটে রক্ত ও পুঁজ বের হয়ে ব্যথা কমে যায়।
মচকে গেলে : দেহের কোনো অংশ মচকে গেলে ১ ভাগ লবণ, ২ ভাগ চুন ও ৪ ভাগ হলুদ বাটা একত্রে ভালো করে মিশিয়ে গরম করে চোটের জায়গায় ২-৩ দিন লাগাতে হবে।
লিভার বা যকৃতের দোষে : ১ চামচ কাঁচা হলুদের রস (শিশুদের জন্য ৫-৬ ফোঁটা) সামান্য চিনি অথবা মধুসহ খেতে হবে অন্তত ১ মাস।
গলা ধরে গেলে : চিৎকার, বক্তব্য বা গান যে কোনো কারণে গলা বসে গেলে ১ গ্লাস গরম পানিতে মাত্র ২ গ্রাম হলুদের গুঁড়া ও ২ চা-চামচ চিনি মিশিয়ে শরবত করে কয়েক বার খেতে হবে।
তোতলামিতে : ছোটবেলায় যাদের কথা আটকে যায়, অথবা তাড়াতাড়ি কথা বলার জন্য তোতলামি দেখা দিলে কাঁচা হলুদ ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করে ১ চামচ পরিমাণ নিয়ে ১ চামচ ঘিয়ে ভেজে সারা দিনে ২-৩ বার খেতে হবে।
অ্যালার্জি বা আমবাতে : খাদ্য বিশেষে অনেকের দেহে চাকা চাকা হয়ে ফুলে উঠে, চুলকায়, লাল বা গোলাপি রঙ ধারণ করে যাকে বলা হয় আর্টিকোরিয়া বা আমবাত। এ ক্ষেত্রে নিমপাতার গুঁড়া ১ ভাগ, কাঁচা হলুদ শুকানো গুঁড়া ২ ভাগ এবং শুষ্ক আমলকী গুঁড়া ৩ ভাগ একসঙ্গে মিশিয়ে ১ গ্রাম মাত্রায় সকালে খালি পেটে ২ সপ্তাহ খেলে শিগগিরই অসুবিধাগুলো নিরাময় হবে।
চোখ উঠলে : হলুদ থেঁতো পানিতে অর্থাৎ হলুদ গুঁড়া করে পানিতে ভিজিয়ে ছেঁকে নিয়ে ওই রসে চোখ ধুতে হবে এবং ওই রসে ছোপানো ন্যাকড়ায় চোখ মুছতে থাকলে চোখের লালাও কেটে যাবে এবং চোখ তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যাবে।
হাঁপানিতে : হলুদ গুঁড়া ১ চামচ, আখের (ইক্ষু) গুড় ১ চামচ ও খাঁটি সরিষার তেল ১ চামচ একত্রে ভালোভাবে মিশিয়ে জিহ্বা দিয়ে মাঝে মাঝে চেটে খেলে উপশম হয়ে কিছুটা আরাম হয়।
জোঁক ধরলে : কখনো জোঁকে ধরলে জোঁকের মুখে হলুদ গুঁড়া দিলে সঙ্গে সঙ্গে জোঁক পড়ে যাবে এবং রক্ত বন্ধ হবে। উল্লেখ্য, জোঁক কোনো প্রাণীর গায়ে কামড় বসানোর সময় হায়াসিন নামক হরমোন প্রয়োগ করে যাতে রক্ত বন্ধ না হয়।
অতিরিক্ত পানি পিপাসায় : অনেকের অতিরিক্ত পানি পিপাসা হয়। এক্ষেত্রে ৫-৭ গ্রাম কাঁচা হলুদ থেঁতো করে পরিমাণ মতো পানিতে ৫-১০ মিনিট সেদ্ধ করে, ছেঁকে নিয়ে সে পানিতে অল্প চিনি মিশিয়ে ১ চামচ করে মাঝে মাঝে খেলে এ সমস্যা চলে যাবে।
ফাইলোরিয়া বা গোদ রোগে : মশাবাহিত পরজীবী দ্বারা এ রোগ ছড়ায়। এক্ষেত্রে কাঁচা হলুদের রস ১ চামচ ও সমপরিমাণ আখের (ইক্ষু) গুড় মিশিয়ে প্রায় ১৫ দিন খেলে উপকার হবে।
চুলকানি নিরাময়ে : কাঁচা হলুদ বাটা ও নিমপাতা বাটার সঙ্গে কয়েক ফোঁটা সরিষার তেল মিশিয়ে গোসলের পূর্বে শরীরে লাগিয়ে একটু অপেক্ষা করে ৩-৪ দিন গোসল করলে চুলকানি চলে যাবে।
আথ্রাইটিস বা অস্থিসন্ধির প্রদাহ সারাতে : কাঁচা হলুদে আছে কারকামিন নামক রাসায়নিক পদার্থ। এ উপাদানটি প্রদাহ নিরোধক ক্ষমতার অধিকারী। প্রতিদিন সকাল বেলা আখের গুড়ের সঙ্গে কাঁচা হলুদ খেতে থাকলে ওই প্রদাহ সারতে সহায়তা করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে : আধুনিক গবেষণায় জানা গেছে, কাঁচা হলুদের কারকামিন নামক উপাদানের ক্যান্সারনিরোধী ক্ষমতা আছে। কারকামিন টিউমারের কোষকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে বাধা প্রদান করে থাকে। প্রতিদিন অন্তত ২ বা এক টুকরা কাঁচা হলুদ খেলে উপকার পাবেন।
পেটের গোলমালে : ১ টেবিল-চামচ হলুদ গুঁড়া; ১ চা-চামচ সরিষার তেল, একটি মাঝারি আকারের পেঁয়াজ ও প্রয়োজনমতো লবণ একত্রে ভাজি করতে হবে। গরম ভাতের সঙ্গে তৃপ্তি সহকারে খেতে হবে। প্রয়োজনে আরও একবার খেতে হবে। অন্য কোনো তরকারি খাওয়া চলবে না। এতেই পেটের গোলমাল চলে যাবে।
যকৃত ও হৃৎপিন্ডকে রক্ষা করতে : গবেষণায় জানা গেছে, হলুদের রয়েছে রক্ত জমাটবিরোধী উপাদান, যা রক্তনালির ভেতরের রক্ত জমাট বাধাদান করে। তাই হলুদ ব্যবহারে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
কোলস্টেরল কমাতে : হলুদ রক্তের কোলস্টেরলের মাত্রা কমাতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। যাদের কোলেস্টেরলের মাত্রা খুব বেশি তারা অবশ্যই প্রত্যহ সকালে দুই টুকরো কাঁচা হলুদ খাবেন।
ব্যাকটেরিয়া বিস্তারে বাধা সৃষ্টি : ত্বকের কোনো রকম ঘা বা ক্ষতে ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করলে সেখানে হলুদের প্রলেপ দিলে হলুদ ব্যাকটেরিয়ার চারদিকে শক্ত আবরণ সৃষ্টি করে, যা এদের বৃদ্ধি ও বংশবিস্তার করতে বাধা দান করে। হলুদের ব্যাকটেরিয়া নিরোধী গুণাবলির জন্য ক্ষতস্থান ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হতে রক্ষা পেয়ে থাকে।
খাদ্য পরিপাক ও অন্ত্রের পরজীবী বিনাশ করে : হলুদ পিত্তকে সহজেই পিত্তরস নিসরণে উদ্দীপ্ত করে। পিত্তরস নিঃসরণে সহায়তা করার মাধ্যমে হলুদ খাদ্য পরিপাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, হলুদ প্রোটোজোয়া নামক এককোষী পরজীবীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
বাইরের আক্রমণ থেকে পচনশীল বস্তুকে রক্ষা করে : মাছ, মাংস ও শুঁটকি জাতীয় বস্তুকে প্রক্রিয়াজাত করার পূর্ব সময়ে হলুদ ও লবণ মিশিয়ে নিলে টাটকা ও বিশুদ্ধ রাখা যায়। বিশেষ করে মাছ ও গোশত শুঁটকি করার প্রাক্কালে হলুদ ও লবণ মিশিয়ে রোদে শুকাতে দিলে মাছি ডিম পাড়ে না।
সুতরাং হলুদ বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যবহার ও খেলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে।
সাবধানতা : লিভারে যাদের সমস্যা আছে বা লিভারের রোগ হওয়ার ঝুঁকি আছে তারা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী হলুদ খাবেন। বেশি হলুদ গ্রহণ তাদের জন্য ক্ষতিকর। ল্যাক্টোস ইনটলারেন্ট হলে দুধের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে খাওয়া যাবে না। সে ক্ষেত্রে দুধ বাদ দিয়ে মধু, সয়া দুধ অথবা শুধু হলুদ অল্প পরিমাণে খাওয়া যাবে। দুরারোগ্য কোনো লিভারের অসুখ হলে হলুদ যতটা পারা যায় এড়িয়ে চলতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ত্বকে সহ্য না হলে হলুদের ব্যবহার বাদ দিন। একাধারে দীর্ঘদিন কাঁচা হলুদ না খেয়ে মাঝে মধ্যে বিরতি দিতে হবে। পরিমাণমতো হলুদ খেতে হবে। অতিরিক্ত হলুদ স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়।
কৃষিবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম*
*রীতা হোমিও হল, পালপাড়া (জামে মসজিদ সংলগ্ন), বাজিতপুর বাজার, বাজিতপুর, কিশোরগঞ্জ
Discussion about this post