বাহাউদ্দিন ইমরান
ভুল বিচারে কারাগারে থাকার কিংবা সাজা খাটার উদাহরণ অনেক। বারবার প্রশ্নও উঠেছে সেসব ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের। কিন্তু সে বিষয়ে রাষ্ট্র কোনও উদ্যোগ না নিলেও এগিয়ে এসেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সম্প্রতি হাইকোর্টের এক রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়েছে, ভুল বিচারের জন্য ভুক্তভোগী যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষতিপূরণ বা যথাযথ পুনর্বাসনের আদেশ চাইতে পারেন।
যে মামলার সূত্র ধরে হাইকোর্ট ক্ষতিগ্রস্তের জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়ার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দিলেন সেটি ছিল, ২০০৫ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকার শাজাহানপুর থানার একটি মামলা। এর আগে একই বছরের ৯ এপ্রিল ঢাকার শাজাহানপুর ওভারব্রিজের নিচে কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশ থেকে ব্যাগসহ শংকর নামে একজনকে আটক করে স্থানীয় জনতা। তার ব্যাগে পাওয়া যায় এক শিশুর কাটা মাথা। পরদিন শংকরকে নিয়ে ভাওয়ালের শালবনে গিয়ে কঙ্কাল উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় একই বছরের ১০ এপ্রিল শাজাহানপুর থানায় মামলা হয়। তবে শিশুটির নাম-পরিচয় জানা যায়নি।
এছাড়া ২০০৯ সালের ১৩ এপ্রিল চাঁদপুর থেকে জাকিরকে গ্রেফতার করা হয়। এ মামলায় ২০১৬ সালের ২১ মার্চ মো. আনোয়ার হোসেন ওরফে মো. রাজিব ওরফে গোলাম রব্বানি ওরফে শংকর চন্দ্র দেবনাথ এবং মো. জাকির হোসেনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ঢাকার বিচারিক আদালত।
পরে আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে আসে। একইসঙ্গে দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করেন। ওই মামলার শুনানি শেষে গত ৬ জানুয়ারি রায় দেন হাইকোর্ট। এতে আসামি দুজনকে খালাস দেওয়া হয়। এরপর রায়ের ২১ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয় গত ২৯ মে।
হাইকোর্টের রায়ে আসামিদের খালাস দেওয়ার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রে থাকা ৩৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৯ জনই পুলিশ বিভাগের। ১ নম্বর সাক্ষী (বাদী) এক পুলিশ সদস্য। তবে তার বক্তব্যকে সমর্থন করতে অন্যরা আদালতে আসেননি। আর এই সাক্ষীও আট বছর পর জেরার মুখোমুখি হন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, ৮–১০ বছর বয়সী নাম না জানা এক বালককে হত্যার ঘটনা প্রমাণে তারা লুকোচুরি খেলা খেলেছেন।
আদালত আরও বলেন, অভিযোগপত্রে থাকা পুলিশ সদস্যরা কেন ১ নম্বর সাক্ষীর বক্তব্য সমর্থনে সাক্ষ্য দিতে আসেননি, সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রায়ের কপি পুলিশ মহাপরিদর্শকের কাছে পাঠাতে বলা হলো।
রায়ের একটি অংশে আদালত বলেছেন, দীর্ঘ ১৬ বছর আগে গ্রেফতার হওয়া আনোয়ার ওরফে শংকর ও জাকির হোসেন ৬ বছর ধরে কনডেম সেলে। তারা এ মামলায় বিচার-বিভ্রাটে ভুক্তভোগী, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। এটি উপযুক্ত মামলা যেখানে যথাযথ ফোরামে ক্ষতিপূরণ বা যথাযথ পুনর্বাসনে আদেশ চাওয়া যায়।
ভুল বিচারে ক্ষতিগ্রস্তের প্রতিকারের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভুল বিচারে সাজা খাটলে রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া যাবে বলে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। তবে কোন পদ্ধতিতে কত টাকা ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে এর কোনও নির্দিষ্ট মানদণ্ড আইনে নেই। তবে আদালতের রায় অনুসারে কেউ ভুল বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সে বা তারা আইন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়ে আবেদন করতে পারবে। কিন্তু আইন কিংবা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তথা সরকার যদি ক্ষতিপূরণ প্রদান না করে তবে হাইকোর্টের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা দায়েরের সুযোগ থাকবে।
ভুল বিচারে ক্ষতিগ্রস্তের প্রতিকারের বিষয়ে ক্রিমিনাল জুরিসপ্রুডেন্স ব্যবস্থায় এর আগে কখনও এমন নজির ছিল না, তাই হাইকোর্টের উক্ত রায়কে যুগান্তকারী বলেও যোগ করেন তিনি।
রায় প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জে আর খান রবিন বলেন, রায়টি যুগান্তকারী। এর ফলে ভুল বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার পথ উন্মোচিত হলো, রায়টি নজির হয়ে থাকলো।
Discussion about this post