নিউজ ডেস্ক
বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্রমান্বয়ে চালুর সুবিধার্থে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, স্থাপনা ও পেশার জন্য একটি কারিগরি নির্দেশনা তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছেন- জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা চীন ও অন্যান্য দেশের সংশ্লিষ্ট কারিগরি নির্দেশনাগুলো অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের জন্য এই কারিগরি নির্দেশনাটি তৈরি করেছেন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা কেন্দ্র এবং ব্যক্তি পর্যায়ে কোভিড-১৯ পরিস্থিতির সম্পূর্ণ সমাপ্তি না ঘটা পর্যন্ত যেখানে যেমন (স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ ঝুঁকি) সেখানে তেমনভাবে এই কারিগরি নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন ও প্রতিপালনের জন্য বলা হয়েছে। এই নির্দেশনার পাশাপাশি সরকারিভাবে সময়ে সময়ে ঘোষিত কঠোর, মধ্যম বা স্বল্পমাত্রার পদক্ষেপগুলোও মেনে চলতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তৈরি গাইডলাইনে ৪৭টি ক্যাটাগরিতে আলাদা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আছে- বাড়ি ও অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, অফিস স্পেস, ব্যাংক, সেলুন, কৃষিজাত দ্রব্যের বাজার ও গ্রাম্য হাট বাজার, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, মেডিক্যাল কোয়ারেন্টিন ও পর্যবেক্ষণ এলাকা, সড়ক-রেল ও নৌপথে যাত্রী পরিবহন, সিভিল এভিয়েশন, ব্যক্তিগত গাড়ি, বিদেশ থেকে ফেরা বা দূরবর্তি স্থান থেকে আগত লোকজনের জন্য স্থানান্তর যানবাহন, রিকশা ও ত্রিচক্র যান, ওয়ার্ড, গ্রাম, পাড়া বা মহল্লা, প্রতিষ্ঠান, কারখানার জন্য স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত নির্দেশনা (গার্মেন্টস, হোশিয়ারি, চামড়া ও টেক্সটাইল ইত্যাদি), নির্মাণ শিল্প, ডাক ও এক্সপ্রেস বিতরণ শিল্প, সরকারি অফিস, শিশু যত্ন কেন্দ্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বৃদ্ধ নিবাস, কারাগার, মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, প্রবীণ নাগরিক, গর্ভবতী মা, শিশু, শিক্ষার্থী, নিজ প্রয়োজনে চিকিৎসা প্রাপ্তি, পুলিশ সদস্য, কোম্পানি স্টাফ, কাস্টমস (অভিবাসন পরিদর্শন,স্বাস্থ্য এবং কোয়ারেন্টিন) কর্মচারী, কুরিয়ার সেবা, ইউটিলিটি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, বাবুর্চি, নিরাপত্তা কর্মী, স্যানিটেশন ব্যবস্থা কর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও খাদ্য পরিবেশনকারীদের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
মাঝারি ও উচ্চ ঝুঁকি এলাকার অফিসে লোকসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ
অফিস স্পেসের জন্য গাইডলাইনে বলা হয়েছে- মাস্ক, তরল হাত ধোয়ার সাবান, জীবাণুনাশক ইত্যাদির মতো মহামারি প্রতিরোধক বস্ত্র সংরক্ষণ করতে হবে। জরুরি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও সংক্রমিত জিনিসপত্র সঠিকভাবে ডিসপোজাল করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতিটি ইউনিটের/দায়িত্ব বাস্তবায়ন এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। প্রতিদিন কর্মীদের স্বাস্থ্যের অবস্থা নথিভুক্ত করতে হবে। যারা অসুস্থতা বোধ করবেন তাদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। অফিসে প্রবেশের আগে কর্মচারীদের তাপমাত্রা নিতে হবে, কেবলমাত্র সাধারণ তাপমাত্রার ব্যক্তিদের প্রবেশ করাতে হবে। অফিসে বায়ু চলাচল বাড়াতে হবে। স্বাভাবিক মাত্রায় সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনার চালাতে হবে। বিশুদ্ধ বাতাস চলাচল বাড়াতে হবে। ঘন ঘন সংস্পর্শে আসা জায়গা, যেমন- দরজার হাতল এবং লিফট ও পাবলিক টয়লেটগুলোর মতো জনসাধারণের ব্যবহার্য তল বা সারফেস নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করতে হবে।
অফিস মিটিংয়ের সময় ও সংখ্যা কমাতেও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মিটিংয়ের সময় ঘরের তাপমাত্রা সহনশীল হলে জানালা বা দরজা খুলতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ভিডিও কনফারেন্সিং ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বরোপ করা হয়েছে। যদি নিশ্চিত কোভিড-১৯ রোগী থাকে তবে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুসারে অফিস পরিবেশ জীবাণুমুক্ত করতে হবে। সেইসঙ্গে এয়ারকন্ডিশনিং ও ভেন্টিলেশন সিস্টেম পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। মাঝারি এবং উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অফিসে স্পেসে প্রবেশ করা লোকের সংখ্যা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে কর্মীদের আলাদা আলাদা আসনে বসতে বা আলাদা পদ্ধতিতে বসার ব্যবস্থা করতে হবে। সম্ভব হলে বাড়িতে থেকে কাজ করার পদ্ধতি প্রচলন করতে হবে।
হোটেলে সীমিত জমায়েত
হোটেল খোলার আগে সুরক্ষাসামগ্রী যেমন মাস্ক, জীবাণুমুক্তকরণ সামগ্রী ইত্যাদি সংগ্রহ করতে হবে। আপৎকালীন পরিকল্পনা তৈরি করে সংক্রমিত বস্তুর ডিসপোজাল এলাকা স্থাপন করতে হবে। সব ইউনিটের জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ জোরদার করতে হবে। নির্দেশনায় কর্মীদের স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আগের নিয়মে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে। অফিসে বায়ু চলাচল বাড়ানো, হাতের সংস্পর্শে আসা দরজার হাতল, এলিভেটর ও পাবলিক টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। অতিথিদের রুমের যন্ত্রপাতি ও বাসন ব্যবহারের পর জীবাণুমুক্ত করা, লবি ও লিফটের প্রবেশপথ ফ্রন্ট ডেস্ক এবং অতিথিদের বারান্দা পরিষ্কার রাখার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়া গণশৌচাগারে লিকুইড সাবান (বা সাধারণ সাবান) রাখা, পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। অতিথি এবং পরিদর্শনকারীদের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার কথা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য ফ্রন্ট ডেস্কের লাইনে ১ মিটার দূরত্ব বজায় রাখার (লাইনে ১ মিটার দূরত্ব অন্তর অপেক্ষা করা) ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। স্টাফদের মাস্ক পরতে হবে, হাইজিনের প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। লবিতে, এলিভেটরে প্রবেশপথে, ফ্রন্ট ডেস্কে এবং এ ধরনের জায়গায় দ্রুত শুকিয়ে যায় এমন জীবাণুনাশক বা হাত জীবাণুনাশক ইন্ডাক্টিভ ডিভাইস স্থাপন করতে বলা হয়েছে। অতিথিদের মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক করে জমায়েত হওয়ার মতো কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিতে হবে।
স্বাভাবিক তাপমাত্রা সম্পন্ন ব্যক্তিদের শপিং মলে প্রবেশাধিকার
শপিং মলে যারা ঢুকবেন তাদের তাপমাত্রা মাপার জন্য মলের প্রবেশমুখে তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণকারী যন্ত্র স্থাপন করতে হবে বা তাপমাত্রা পরিমাপের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধুমাত্র স্থাভাবিক তাপমাত্রা সম্পন্ন বাক্তিদেরই মলে ঢুকতে দিতে হবে। মলের এয়ার কন্ডিশনিং ও ভেন্টলেশন সিস্টেমকে পরিষ্কার ও জীবানুমুক্ত করতে হবে। মূল্যায়ন হওয়ার আগে তা পুনরায় চালু করা যাবে না। মৃদু ও উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় শপিং মলগুলোকে তাদের বিজনেস আওয়ার সংক্ষিপ্ত করতে এবং ক্রেতার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
রেস্টুরেন্টে বড় আকারের ভোজন সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকবে
রেস্তোরাঁর প্রবেশদ্বারে তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণের সরঞ্জাম স্থাপন করতে হবে এবং কেবলমাত্র সাধারণ তাপমাত্রার ব্যক্তিদেরই প্রবেশ করতে দিতে হবে। বড় আকারের ভোজন সমাবেশ নিষিদ্ধ থাকবে। রিজার্ভেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে আগত অতিথিদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। টেবিল ও চেয়ারের সংখ্যা হ্রাস করতে হবে। গ্রাহকদের প্রত্যেকের এক টেবিল অন্তর খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রেস্তোরাঁগুলোতে এক চামচ ব্যবহারের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিবার খাবার পরিবেশনের পর টেবিলওয়্যার পরিষ্কার এবং জীবাণুমুক্ত করতে হবে। কাজের সময় গল্প হ্রাস করতে হবে এবং কাজের পরে ভিড় এড়িয়ে চলতে হবে। কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের মাস্ক পরতে হবে এবং গ্রাহকদের মাস্ক পরতে হবে। রেস্টুরেন্টে দীর্ঘক্ষণ ধরে খাওয়া চলবে না। এছাড়া পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত এবং এয়ারকন্ডিশন সংক্রান্ত আগের নির্দেশনা এখানেও বলবত থাকবে।
সেলুনে সিটের ব্যবধান দেড় মিটারের কম হতে পারবে না
এসব দোকানেও তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণের সরঞ্জাম স্থাপন করতে হবে ও স্বাভাবিক তাপমাত্রার মানুষকে দোকানে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। বায়ু চলাচল ও এয়ার কন্ডিশনের ক্ষেত্রে আগের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নির্দেশনা বলবত থাকবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জীবাণুমক্ত থাকার বিষয়ে আগের নির্দেশনাই থাকবে। সেলুনে ভিড় কমিয়ে রিজার্ভেশন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। সিট ব্যবধান ১.৫ মিটারের কম যেন না হয়। কাস্টমারদের নিরাপদ দূরত্ব এবং সংস্পর্শ ব্যতিরেকে পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। কর্মীদের কাপড় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। মাস্ক ও অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার বাধ্যতামূলক।
কৃষিজাত দ্রব্যের বাজার ও গ্রাম্য হাট-বাজারে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে
গ্রাম্য হাট-বাজারগুলোক বড় মাঠে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরিচালনার পদ্ধতি অব্যাহত রাখতে হবে। প্রতিটি বাজারের প্রবেশমুখে তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র বা তাপমাত্রা পরিমাপের ব্যবস্থা রাখতে হবে। স্বাভাবিক তাপমাত্রার মানুষের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। বদ্ধ বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে। বাজারের মূল ব্যবসা কেন্দ্রগুলোকে (যেমন কসাইখানা, প্রক্রিয়াজাত কেন্দ্র) কোয়ারেন্টিন ও সুরক্ষিত রাখতে হবে। বন্য প্রাণীর বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। বাজার পরিষ্কার রাখতে হবে এবং প্রতিদিনের আবর্জনা পরিষ্কার করে ফেলতে হবে। পাবলিক টয়লেটগুলো অবশ্যই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং জীবাণুমুক্ত করতে হবে এবং হাত ধোয়ার জন্য সাবান কিংবা লিকুইড হ্যান্ডওয়াশের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
প্রতিদিন বাজার বন্ধের পর সেখানকার মেঝে এবং অন্যান্য ব্যবহৃত সরঞ্জাম, বাস কাউন্টার ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করতে হবে। গ্রাহকগণ তাদের বিল সম্ভব হলে স্ক্যানিং-এর মাধ্যমে পরিশোধ করবে এবং অবশ্যই কেনাকাটার সময় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বিক্রেতা ও ক্রেতা সবাইকে মাস্ক পরতে হবে।
পার্কে একজনের কাছাকাছি আরেকজন যেতে পারবে না
প্রতিটি পার্কের প্রবেশমুখে তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্র বা তাপমাত্রা পরিমাপের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং শুধুমাত্র স্বাভাবিক তাপমাত্রার মানুষের প্রবেশাধিকার থাকবে। বারবার পার্কের বিভিন্ন জায়গা যেমন বসার স্থান, গণশৌচাগার, ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি, ময়লার ঝুড়ি পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করতে হবে। গণশৌচাগারগুলো সবসময় পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। পরিমাণ মতো হ্যান্ডওয়াশ ও সাবান সরবরাহ করতে হবে। বিজ্ঞান-ভিত্তিক ও যুক্তিসঙ্গত সময়ে পার্কের খোলা ও বন্ধের সময় ঠিক করতে হবে এবং আগমনকারী দর্শনার্থীদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নগদে টিকিটের বিক্রয় কমিয়ে আনতে হবে এবং স্পর্শ ছাড়াই টিকিট ক্রয় এবং অনলাইন টিকিট ক্রয় এবং কোড পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে। ।
ভিড়ের কারণ হতে পারে এমন কাজ এবং কর্মসূচি স্থগিত করতে হবে এবং অনুমতিপ্রাপ্ত সংখ্যক দর্শনার্থীদের সেবা দেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
Discussion about this post