কেওক্রাডং (Keokradong) পাহাড় বান্দরবানের রুমা উপজেলায় অবস্থিত। প্রায় ৩১৭২ ফুট উঁচু এ পর্বতকে এক সময় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মনে করা হত কিন্তু আধুনিক পদ্ধতিতে পরিমাপে বর্তমানে সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ হিসাবে এর অবস্থান পঞ্চম। কেওক্রাডং নামটি এসেছে স্থানীয় আদিবাসী মারমাদের থেকে। মারমা ভাষায় কেওক্রাডং মানে সবচেয়ে উঁচু পাথরের পাহাড়। দূর থেকে কেওক্রাডাং এর চূড়া শূন্যে মিলিয়ে আছে বলে মনে হয়। আর চূড়ায় উঠলে পাহাড় মেঘের মিতালী আপনাকে আন্দোলিত করবে মায়াবী আকর্ষনে।
কেওক্রাডং যাবার উপায়
দেশের যে প্রান্তেই থাকেন আপনাকে প্রথমে বান্দরবান আসতে হবে কেওক্রাডং যাবার জন্যে। ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে এস. আলম, সৌদিয়া, সেন্টমার্টিন পরিবহন, ইউনিক, হানিফ, শ্যামলি, ডলফিন ইত্যাদি পরিবহনের বাস বান্দারবানের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। জনপ্রতি এসব বাসের ভাড়া যথাক্রমে নন এসি ৫৫০ টাকা ও এসি ৯৫০-১৫০০ টাকা। ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান যেতে সময় লাগে ৮-১০ ঘন্টা।
ট্রেনে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম গামী সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেস, তূর্ণা নিশিতা, মহানগর গোধূলি এইসব ট্রেনে করে চট্রগ্রাম যেতে পারবেন। শ্রেনীভেদে ভাড়া ৩৫০ থেকে ১২০০টাকা। এছাড়া ঢাকা থেকে আকাশ পথে সরাসরি চট্রগ্রাম আসতে পারবেন।
চট্টগ্রামের বদ্দারহাট থেকে পূবালী ও পূর্বানী নামের দুটি বাদ বান্দারবানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। এ দুটি বাসে জনপ্রতি ২২০ টাকা ভাড়া লাগে। চট্রগ্রামের ধামপাড়া বাস স্ট্যান্ড থেকে ২০০-৩০০ টাকা ভাড়ায় বাসে করে বান্দরবান আসতে পারবেন।
বান্দরবান থেকে কেওক্রাডং
বান্দরবান শহর থেকে কেওক্রাডং যেতে হলে প্রথমে যেতে হবে রুমা বাজার। তারপর রুমা বাজার থেকে বগালেক হয়ে কেওক্রাডং। একদিনে বান্দরবান থেকে কেওক্রাডং পৌঁছানো একটু কষ্টকর হয়ে যাবে। সাধারণত পর্যটকগন প্রথমদিন বগালেকে এক রাত থেকে তার পরদিন সকালে কেওক্রাডং ভ্রমণে যায়। বগালেক দেখা ও সেখানে থাকা আপনার কেওক্রাডং ভ্রমণ আরও সুখময় করে তুলবে।
বান্দরবান থেকে রুমা বাজার এর দূরত্ব ৪৮ কিলোমিটার। লোকাল বাস কিংবা চাঁন্দের গাড়ি/জীপে করে রুমা বাজার যাওয়া যায়। বাসে যেতে হলে বান্দরবানের রুমা বাস স্ট্যান্ডে যেতে হবে। সেখান থেকে ১ ঘন্টা পর পর বাস রুমার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। জনপ্রতি ভাড়া ১২০ টাকা, সময় লাগবে ৩ ঘন্টার মত। দলগত ভাবে গেলে রুমা বাজার যেতে পারেন জীপ/চান্দের গাড়িতে করে। এক গাড়ীতে ১০-১৫ যাওয়া যায়। বান্দরবান শহরের জীপ স্টেশন থেকে ৩০০০-৪০০০ টাকা ভাড়ায় গাড়ি নিতে হবে। জীপে করে গেলে সময় লাগবে ২ ঘন্টার মত।
রুমা বাজার পৌঁছে কেওক্রাডং যাবার জন্যে প্রথমেই আপনাকে গাইড ঠিক করে নিতে হবে। গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক। গাইড সমিতির রেজিস্টার্ড গাইড আছে, তেমন কাউকে ঠিক করে নিতে হবে। গাইডের থাকা খাওয়ার খরচ আপনাকেই বহন করতে হবে। রওনা হবার আগে রুমা বাজার আর্মি ক্যাম্প থেকে কেওক্রাডং যাবার অনুমতি নিতে হবে। অনুমতির জন্যে ভ্রমণকারী সকল সদস্যের পরিচয় লিখিত কাগজে জমা দিতে হবে। এই কাজ গুলো করার জন্যে গাইড আপনাকে সাহায্য করবে। আর অবশ্যই মনে রাখবেন বিকেল ৪টার পর রুমাবাজার থেকে বগালেক যাবার অনুমতি দেওয়া হয় না। রুমাবাজার থেকে নিজেদের দরকারি জিনিস কিনে নিবেন। বগালেক ও কেওক্রাডং যাবার পথে কিছু আদিবাসী দোকান আছে, কিন্তু সেখানে আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস নাও পেতে পারেন।
রুমাবাজার থেকে বগালেকের দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। অনুমতি নেবার পর রুমাবাজার থেকে ল্যান্ডক্রুজার জীপ বা চান্দের গাড়ী ভাড়া করতে হবে। এক গাড়িতে ৮-১৫ জন যাওয়া যায়। এইসব কাজে গাইডের সাহায্য নিতে পারেন। গাইডকে আপনাদের কি প্রয়োজন তা বুঝিয়ে বললে সাধারণত সেই সব কিছুর ব্যবস্থা করবে। রুমা থেকে বগালেক পর্যন্ত ল্যান্ডক্রুজারের রিজার্ভ ভাড়া ১৮০০ টাকা, চাঁদের গাড়ী ভাড়া ২০০০ টাকা। আপনাদের সদস্য সংখ্যা কম থাকলে অন্য কোন গ্রুপ পেলে তাদের সাথে কথা বলে একসাথে একটা গাড়ি ঠিক করে নিতে পারেন। অথবা টিকেট কেটে লোকাল গাড়িতে যেতে পারবেন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এক ঘন্টা পর পর লোকাল চাঁদের গাড়ি যাওয়া আসা করে। বগালেক পর্যন্ত লোকাল ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা।
বগালেক পৌঁছে সেখানের আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হবে। সেই রাত বগালেকে থেকে পরদিন খুব সকালে রওনা দিলে ৩-৪ ঘন্টা পায়ে হেঁটে(ট্রেকিং) কেওক্রাডং এর চূড়ায় পৌঁছতে পারবেন। বগালেক থেকে কেওক্রাডং এই পুরো রাস্তা হেঁটে যেতে হবে। মোটামুটি বেশ কিছু খাড়া পাহাড় পার হতে হবে। চাইলে সেইদিন কেওক্রাডং থেকে পরদিন বগালেক হয়ে রুমা বাজার তারপর বান্দরবান পৌঁছতে পারবেন। নয়তো সেইদিন কেওক্রাডং থেকে নেমে বগালেকে এসে রাতে থেকে তারপর দিন রুমা হয়ে বান্দরবান পৌঁছতে হবে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় এক রাত কেওক্রাডং পাহাড় চুড়ায় থাকা। বাংলাদেশের পঞ্চম উঁচু পাহাড় থেকে সুর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত নয়।
নোটঃ বর্তমানে রাস্তা ভালো থাকলে গাড়ি দিয়েই কেওক্রাডং পর্যন্ত যাওয় যায়। তবে যাওয়া যাবে কিনা তা নির্ভর করবে রাস্তা ঠিক আছে কিনা তার উপর।
কেওক্রাডং গাইড ভাড়া
গাড়ি দিয়ে যাওয়া ও আসা – ১ দিন | ১,০০০ টাকা |
গাড়ি দিয়ে যাওয়া ও আসা – ২ দিন | ১,৬০০ টাকা |
গাড়ি দিয়ে কমলাবাজার/বগালেক তারপর হেঁটে কেওক্রাডং যাওয়া ও আসা – ২দিন | ২,০০০ টাকা |
গাড়ি দিয়ে কমলাবাজার/বগালেক তারপর হেঁটে কেওক্রাডং যাওয়া ও আসা – ৩দিন | ২,৬০০ টাকা |
কেওক্রাডং থাকা ও খাওয়া ব্যবস্থা
কেওক্রাডং যদি রাত কাটাতে চান তাহলে কেওক্রাডং এর চূড়ার কাছেই আদিবাসী কটেজ আছে। গাইডের মাধ্যমে আগে থেকেই কথা বলে রাখতে পারেন অথবা গিয়ে সেখানে কথা বলে থাকতে পারবেন। এক রুমের কটেজে কয়েকজন থাকতে হবে। জনপ্রতি ১০০-১৫০ টাকা ভাড়া। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা আদিবাসী ঘরেই করতে হবে। সাধারণত ১০০-২০০ টাকার খাবার প্যাকেজ পাওয়া যায়। ভাত, ডিম, আলুভর্তা, পাহাড়ি মুরগি দিয়েই হয় খাবারের আয়োজন। এই জন্যে আগে থেকেই বলে রাখতে হবে কি খাবেন ও কত জন খাবেন। পৌঁছেই খাবার খেতে চাইলে যাবার সময়ই গাইডের সাহায্যে বলে রাখতে পারবেন।
কেওক্রাডং ভ্রমণ টিপস
১ .ট্রেকিং এর জন্যে ভালো গ্রিপের জুতা ব্যবহার করতে হবে।
২.আপনার ব্যাগপ্যাক এর ওজন যত কম রাখতে পারবেন ট্রেকিং ততই সহজ হবে।
৩. বগালেকে ও কেওক্রাডং এ বিদ্যুৎ নেই, সোলার পাওয়ার সিস্টেম থাকলেও মোবাইল চার্জ দেয়ার জন্যে সাথে করে পাওয়ার ব্যাংক নিতে পারেন।
৪. ট্রেকিং এর সময় সাথে পর্যাপ্ত পানি রাখুন। পানি শেষ হয়ে গেলে কোন ঝিরিতে
বোতল ভরে নিন।
৫.সাথে কয়েক প্যাকেট স্যালাইন বা গ্লুকোজ নিয়ে নিন।
৬. সব মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, টেলিটক ও রবির নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়।
৭. বগালেকে গোসল করার সময় সতর্ক থাকুন, গভীরতা অনেক।
৮. আদীবাসী মানুষের জীবন যাত্রা সমতলের মানুষের মত নয়, তাদের অসম্মান হয় এমন কিছু করবেন না।
৯. বান্দরবান থেকে বগালেক পুরো রাস্তাই পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা, ভ্রমণে সতর্ক
থাকুন।
১০. রুমা বাজার থেকে অবশ্যই আর্মি ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিতে হবে, বাগলেক
আর্মি ক্যাম্পে রিপোর্ট করতে হবে। কেওক্রাডং ক্যাম্পেও তাই।
Discussion about this post