রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন রুমকি। এটা কোনো খবর নয়। খবর হলো, রুমকি মায়ের কোলে চড়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এসেছেন। কারণ তাঁর কোমরের নিচের অংশ পুরোই বিকল। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পথ তাঁর সোজা ছিল না। রেদওয়ান বিজয় সে কারণেই উত্সাহী ছিলেন তাঁর জীবনকাহিনি জানতে
১৯৯৯ সালের ২৫ নভেম্বর জন্ম। পুরো নাম রাজিয়া সুলতানা রুমকি। রাজশাহীর পাঠানপাড়া এলাকায় মা-বাবা আর দুই ভাই-বোন নিয়ে তাঁদের সংসার। জন্ম থেকেই দুই পা বাঁকা রুমকির। আট বছর বয়স পর্যন্ত কোনো রকমে দাঁড়াতে পারতেন। তবে তখনো কারো সাহায্য লাগত বা কোনো কিছু ধরে দাঁড়াতে হতো। আট বছরের পর অবশ্য আর দাঁড়ানোর সুযোগ পাননি রুমকি।
স্কুলবেলা
পাঁচ-ছয় বছর বয়সে বাড়ির কাছের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু হয় রুমকির। সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে হয়। কারণ শরীর আর সায় দিচ্ছিল না। পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে অবশ্য অন্য কিছুতেই মন দিতে পারছিলেন না রুমকি। তাই মা-বাবাকে রাজি করিয়ে দুই বছর পর ২০১২ সালে আবারও লেখাপড়া শুরু করেন। এই ফিরে আসার পেছনে একটা গল্পও রয়েছে। পড়ালেখা বন্ধ থাকার সময় টেলিভিশনে এক মেয়েকে নিয়ে সংবাদ প্রচার হতে দেখেন রুমকি। সেই মেয়েটির অবস্থাও রুমকির মতোই অনেকটা। খবরে মেয়েটির সাফল্যের গল্প বলা হচ্ছিল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। কর্মসূত্রে বিদেশও সফর করতে হয় তাঁকে। রুমকি ভাবলেন, আমি তবে কেন নয়? রুমকির মনে জেদ চেপে বসে। মা-বাবাকে কিভাবে রাজি করাবেন—এ নিয়ে সারা রাত ভেবেছি। পরের দিন মা অবশ্য অল্পের মধ্যেই রাজি হয়ে যান। খুশি হন বাবা খন্দকার হাফিজুর রহমানও।
রুমকি বলছিলেন, ওই সময় বাবার চাকরি ছিল না। আবার স্কুলে ভর্তির সময়ও বাকি ছিল মাত্র এক দিন। এই অল্প সময়ের মধ্যে বাবার পক্ষে ভর্তির এক হাজার টাকা জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব ছিল। টাকার জন্য বাবা যাঁর অধীনে কাজ করতেন, তাঁর কাছে গিয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত বসে ছিলেন। সেদিন রাতে বাবা বাড়ি ফেরার আগ পর্যন্ত স্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে কি না তা নিয়ে মা-মেয়ে দুজনই ছটফট করছিলেন। রাতে বাবা টাকাটা মায়ের হাতে দেওয়ার পর আনন্দে কেঁদেই ফেলেন রুমকি। এরপর প্রতিজ্ঞা করেন, যে করেই হোক বাবার এই কষ্টের প্রতিদান দেবেন।
রাজশাহী বহুমুখী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন রুমকি। সেখান থেকে ২০১৫ সালে এসএসসি এবং রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজ থেকে ২০১৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। তাঁর মা নাজনীন বেগম বলেন, ‘স্কুল-কলেজে ক্লাস করা, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া নিয়ে বেশ ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। মেয়েকে নিয়ে দৌড়ে বেড়িয়েছি বিভিন্নজনের কাছে। মানুষ নানা কথা বলেছে। তবে কষ্ট পেলেও মনোবল হারাইনি।’ এসএসসি পরীক্ষার আগে স্কুল কর্তৃপক্ষ রুমকিকে একটি হুইল চেয়ার কিনে দেন।
পরীক্ষা ছাড়া তেমন স্কুলে যাওয়া হতো না রুমকির। তাই তাঁর প্রতি শিক্ষকদেরও তেমন ভরসা ছিল না। শিক্ষকরা বলতেন, রুমকির আসলে পড়ালেখা হবে না। কিন্তু সপ্তম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার ফল দেখে শিক্ষকরা অভিভূত হন। এর পর থেকে তাঁরা রুমকিকে উত্সাহ দিতে শুরু করেন।
এবার বিশ্ববিদ্যালয়
এইচএসসি পরীক্ষার পর ভার্সিটিতে পড়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন রুমকি। তবে কোচিং বা প্রাইভেট—কিছুই পড়েননি রুমকি। বাড়িতে বিছানায় শুয়ে-বসেই নিতে থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি। সারা দিন পড়া শেষে সন্ধ্যায় মায়ের কাছে পরীক্ষা দিতেন। সফল হবেন এমন আত্মবিশ্বাস রুমকির ছিল, তবে মায়ের বেশি আশা ছিল না। মা ভেবেছিলেন, হলে ভালো, না হলে রাজশাহী কলেজে পড়াবেন। যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় রুমকি উত্তীর্ণ হন, সেদিন আনন্দে আবারও কেঁদে ফেলেছিলেন মা-মেয়ে। পরিবারের সবাই আনন্দে মেতে উঠেছিল।
২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে রুমকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবি বিভাগে ভর্তির সুযোগ পান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরও ঠিকমতো পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। কারণ, আরবি বিভাগের ক্লাস-পরীক্ষা হয় কলাভবনের তৃতীয় তলায়। কিন্তু রুমকির মায়ের পক্ষে প্রতিদিন সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় মেয়েকে ওঠানো-নামানো কষ্টকর। তা ছাড়া সিঁড়িগুলো এমনভাবে তৈরি, যাতে হুইলচেয়ারে করে ওপরে তোলার মতো সুযোগও নেই। তাই তাঁরা বিভাগ পরিবর্তন করে বাংলা বিভাগে ভর্তির আবেদন জানান। কারণ, বাংলা বিভাগের ক্লাস নিচতলায় হয়। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রুমকির আবেদন মঞ্জুর করেছে।
মা-ই ভরসা
জন্মের পরেই বাঁকা পা দেখে পরিবারের সদস্যরা সমস্যা টের পান। ধীরে ধীরে সমস্যাটি বাড়তে থাকে। দেড় বছর বয়স থেকে শুরু হয় চিকিত্সা। টানা ছয় বছর রুমকির চিকিত্সা চলে। এর মধ্যে টানা ছয় মাস করে দুইবার পা দুটি প্লাস্টার করে রাখা হয়। কিন্তু এতে সমস্যা আরো প্রকট হয়। কোমরের নিচের অংশে ধীরে ধীরে শক্তি হারিয়ে ফেলেন রুমকি। চলাফেরার জন্য মায়ের কোল হয়ে ওঠে একমাত্র ভরসা। যখন মায়ের কোলে চড়ে স্কুলে যেতেন, তখন অনেকেই হাসাহাসি করত। তাই মায়ের বুকে মুখ গুঁজে রাখতেন। অন্যদের মতো কখনোই টেবিলে বসে পরীক্ষা দেওয়া হয়নি রুমকির। পরীক্ষা দিতে হয়েছে শুয়ে-বসে। এর জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়েছে। অনুমতির জন্য ঘুরতে হয়েছে শিক্ষকদের দ্বারে দ্বারে।
তবে রুমকি আপ্লুত। বলছিলেন, ‘জীবনে এত দূর আসতে পারব ভাবতে পারিনি। সবার ভালোবাসা ও সহযোগিতা যেভাবে পেয়েছি, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। মা-বাবা, ভাই, শিক্ষকদের ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না।’ পড়ালেখা শেষে নিজেকে শিক্ষক হিসেবে দেখতে চান রুমকি। সমাজের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন এবং তাঁর মতো আরো যাঁরা আছেন, তাঁদের জন্য কাজ করতে চান তিনি।
Discussion about this post