মোছাব্বের হোসেন
সবকিছু ঠিক থাকলে শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা হবেন আশুতোষ নাথ। অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেন তিনি। পূর্ণ বৃত্তিসহ আশুতোষ পিএইচডি করতে যাচ্ছেন ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস বোস্টনে। বিষয় মেডিসিন অ্যান্ড সিনথেটিক অরগানিক কেমিস্ট্রি।
ছোটবেলায় অভাব আর অর্থকষ্ট খুব কাছ থেকে দেখেছেন। স্নাতক হয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে, চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ থেকে। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূরত্ব যত, একসময় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা কি তার চেয়েও বেশি দূরে মনে হতো আশুতোষের কাছে?
অভাবের সংসার
আশুতোষ নাথের জন্ম চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির এক প্রত্যন্ত গ্রামে। কিন্তু সেখানে জীবনসংগ্রামে টিকতে না পেরে বাবা মিলন নাথ পাড়ি জমান খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে। সেখানেও জীবন সহজ ছিল না। একটা ভ্রাম্যমাণ ধানভাঙা মেশিন নিয়ে ঘুরে ঘুরে যা আয় হতো, সেটুকুই ছিল সম্বল।
সংসারে ৫ সন্তান। আশুতোষ সবার ছোট। তাঁর আগের ১ ভাই ও ৩ বোনের কেউই উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। সবার ছোট আশুতোষের ওপর বাড়তি ভালোবাসা ছিল বড় ভাই পরিতোষ নাথের। জামা সেলাইয়ের কাজ করতেন তিনি। আয়ের একটা বড় অংশই ব্যয় করতেন আশুতোষের পড়ালেখার পেছনে।
বড় ভাইয়ের এই ত্যাগ আশুতোষকে সামনে এগিয়ে যেতে সবচেয়ে বড় উৎসাহ দেয়। সে কথাই বলছিলেন তিনি, ‘ভাইয়ের জন্যই আমার সেরাটা দিয়ে পড়াশোনা করতে চেষ্টা করেছি।’
কখনো বাবা, কখনো ভাইকে কাজে সাহায্য করতে গিয়ে পড়াশোনায় মন দিতে পারেননি। তবু ভালো কিছু করার তাগিদ থেকেই মানিকছড়ির রানী নিহার দেবী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিকে জিপিএ-৪.১৯ আর মানিকছড়ি গিড়ী মৈত্রী কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৪.৫০ পেয়ে বিজ্ঞান বিভাগে পাস করেন।
কম্পিউটারে কাজের শুরু
স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরোনোর পর আশুতোষের জীবনে আরেক সংগ্রাম শুরু হয়। আশুতোষ বলেন, ‘বড় ভাই পড়াশোনার খরচ দিতেন। কাজের সন্ধানে তিনি গেলেন দুবাই। কিন্তু সেখানে খুব একটা সুবিধা করতে না পেরে দেশে চলে আসেন। এরপর খরচের ভয়ে আমি আর ভালো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সাহস করিনি।’
চট্টগ্রামের সরকারি হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজে রসায়ন বিভাগে স্নাতকে ভর্তি হলেন। তবু খরচ জোটানো কঠিন। শহরের চকবাজারে কম্পিউটারের দোকানে কাজ নেন তিনি। লেখা কম্পোজ করা ও গ্রাফিকসের টুকটাক কাজ—এ থেকে যা আয় হতো, তা দিয়ে নিজে চলতেন, বাড়িতেও কিছু পাঠাতেন। এমনি করে চলছিল দিন।
তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় ২০১৪ সালে অফিস অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে চাকরির জন্য আবেদন করেন। ২০১৬ সালে এই চাকরি পেয়ে চলে আসেন ঢাকায়। যা বেতন পান, তা দিয়ে সংসার চলে না। রাত জেগে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেন তিনি। কেননা কম্পিউটারে দরকারি দক্ষতা ছিল তাঁর।
আশুতোষ বলেন, ‘ছাত্র অবস্থায় এসব কাজ শিখেছিলাম। ২০১৮ সালেই আমি এই কাজ করে ২ লাখ টাকার বেশি টাকা আয় করি। কাজের পাশাপাশি পড়াশোনাও চলতে থাকে।’
স্নাতকে ৩.১৬ সিজিপিএ নিয়ে পাস করেন। স্বপ্ন ডানা মেলে। ঠিক করলেন, ঢাকা কলেজে রসায়নে স্নাতকোত্তর করবেন। ভর্তি হয়ে তিন দিন ক্লাসও করেছিলেন। এই সময় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) রসায়নে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলো। ভাবলেন, একবার চেষ্টা করেই দেখি।
চেষ্টায় সুফল মিলল। ভাইভা দিয়ে বুয়েটে সুযোগ পেয়ে গেলেন আশুতোষ। ক্যাম্পাসটা অফিসের পাশে হওয়ায় পড়ালেখাতেও সুবিধা হয়েছিল। ৩.০৮ সিজিপিএ নিয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করেন তিনি।
আশুতোষের মতো এত পরিশ্রমী আর বিনয়ী ছাত্র কম দেখেছি। সে যে পর্যায় থেকে উঠে এসে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ বৃত্তি পেয়ে পিএইচডির সুযোগ পেয়েছে, তা আমার দেখা সেরা সংগ্রামের গল্প। সব সময় সে আমার সঙ্গে কাজ করেছে। কাজের মধ্যে ফাঁকি দেখিনি। যতটা সুযোগ পেয়েছে, সে কাজে লাগিয়েছে। আশুতোষ সবার জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
মো. ওহাব খান, অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ ,বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
গবেষণায় ঝোঁক
বুয়েটে পড়ার সময়ই মূলত গবেষণায় তাঁর ঝোঁক তৈরি হয়েছিল। এ সময় আন্তর্জাতিক তিনটি জার্নালে তাঁর গবেষণাপত্র প্রকাশ পায়। আশপাশের সবাইকে তখন দেখছেন বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে। আশুতোষ এবার নিজেকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিক করে আবেদন করা শুরু করেন বিশ্বের নানা প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বছরের মার্চের শেষ দিকে ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটস বোস্টন তাঁর কাগজপত্র যাচাইবাছাই করে কয়েক দফায় ভার্চ্যুয়াল ভাইভা নিয়ে পিএইচডি গবেষক হিসেবে আবেদন গ্রহণ করে।
আশুতোষ বলেন, ‘সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়। কখনো কল্পনা করিনি এই পর্যন্ত আসতে পারব। তবে আমার একাগ্রতা, লেগে থাকা, বড় স্বপ্নই আমাকে সাহায্য করেছে। ভিসা পেয়ে গেছি। এ বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে আমার ক্লাস শুরু হবে। আর আমি আগস্টের মধ্যেই আমার স্ত্রী গান্ধী দেবীসহ যুক্তরাষ্ট্রে যাব বলে আশা করছি।’
জানালেন, এরই মধ্যে সেখানে তিনি শিক্ষা সহকারী হিসেবে খণ্ডকালীন চাকরিও পেয়ে গেছেন। বলছিলেন, ‘আমার একাডেমিক রেজাল্ট হয়তো ভালো নয়। কিন্তু জার্নালে প্রকাশিত আমার গবেষণাপত্রগুলো সাহায্য করেছে। বুয়েটে আমার সুপারভাইজার অধ্যাপক মো. ওহাব খান সবচেয়ে বেশি সহায়তা ও সমর্থন দিয়েছেন। তাঁর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।’
Discussion about this post