শিক্ষার আলো ডেস্ক
মাত্র ৬ মাস বয়সে হাম রোগে আক্রান্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি হারান তিনি। ঠিক একই বছরে মাও চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। তবুও নিজের অন্ধত্বকে পথ চলার প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কখনো প্রশ্রয় দেননি। চোখের আলো নিভে গেলেও শিক্ষার আলোর জন্য ছুটে চলেছেন অবিরাম গতিতে। এতক্ষণ বলছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী শিহাবউদ্দীন ভূঁইয়ার সংগ্রামের কথা।
নরসিংদীর শিবপুরের কালুয়ারকান্দা গ্রামে ১৯৯৭ সালে জন্ম তার। তিনবোন আর তিনভাইয়ের মধ্যে শিহাব হলো সবার ছোট। সৎ মায়ের কাছে নয় শিহাব মায়ের ছায়া পেয়েছেন বড় বোনের কাছেই। বোনের বিয়ের পর শিহাবকে আগলে রাখেন বড় ভাই। তিনি শিহাবকে বুঝিয়েছেন আটদশজনের মতোই তার জীবন, এর বাইরে কিছু নয়। ধীরে ধীরে শিহাবের সফলতায় জড়িয়ে গেলেন বড় ভাইও।
শিহাবের পড়াশোনার হাতেখড়ি কালুয়ারকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চট্টগ্রামের লোহাগড়া সাহাবীর পাইলট উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ চুকিয়ে এখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিবিজ্ঞানে অধ্যয়নরত।
এক বন্ধুর মাধ্যমে চট্টগ্রামের লোহাগড়ায় ‘সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম’ নামে একটি হোস্টেলের সন্ধান পেলেন। সেই হোস্টেলে শিহাবদের মতো মাত্র ১০ জনের থাকার ব্যবস্থা ছিল। তখন নরসিংদী থেকে চট্টগ্রামে চলে আসেন শিহাব। হোস্টেলের ঠিক পাশেই লোহাগড়া সাহাবীর পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। সেখান থেকে মাধ্যমিক শেষ করেন।
পড়াশোনার প্রতি যথেষ্ট আগ্রহ শিহাবের। পাশাপাশি খেলাধুলাসহ সব ধরনের সৃজনশীল কাজের প্রতি ছিল তার চরম ঝোঁক। পড়াশোনার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিহাবের পদচারণা সত্যিই আশ্চর্য করার মতো! নিজেদের স্থানীয় সংগঠন ‘নরসিংদী ডিজঅ্যাবল পিপলস অর্গনাইজেশন টু ডেভেলপমেন্ট’ এ ২০১৪ সাল থেকে কাজ করে আসছেন। সেই সংস্থার বর্তমানে সহসভাপতি দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
২০১৮ সালে সমাজসেবা অধিদফতর এবং ২০১৯ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল থেকেও কম্পিউটার ট্রেনিং করেন শিহাব। ঢাকার বনানীতে ইনস্টিটিউট অব হযরত মুহম্মদ (সা.) প্রতিষ্ঠান থেকে কল সেন্টারে টেলিফোন অপারেটরের ট্রেনিংও নিয়েছেন।
এছাড়াও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বেসরকারি টেলিভিশন এটিএন বাংলায় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পান তিনি। সম্প্রতি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধীনে ‘প্রতিবন্ধীদের প্রতিবন্ধকতা’ শীর্ষক এক গবেষণায় সহযোগী হিসেবে সুযোগ পান। সেই কাজের জন্য ঢাকার গাজীপুরে যেতে হয়েছে। সফলভাবে কাজও শেষ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পড়াশোনা নিয়ে চিন্তায় ছিলেন। বিশেষ করে পরীক্ষার সময় ভোগান্তি পোহাতে হত শ্রুতিলেখক নিয়ে। এসব সমস্যার সমাধানে এগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা ‘থার্ড আই’ সংগঠনকে। শ্রুতিলেখক ছাড়াও পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং বইয়ের অডিও রেকর্ড ব্যবস্থা করে দেয় তারা।
শিহাব বলেন, “প্রতিবন্ধীদের জীবন সহজ করে দেওয়া যাবে এমন চিন্তায় সময় কাটে। স্বপ্ন দেখি মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার। স্বার্থপরের মতো ভাবনা নেই, বরং নিজের জীবনকে অন্যের ভালো থাকায় নিয়োজিত করার মাধ্যমেই আমার প্রকৃত সুখ”।
ভালো থাকুক এইসব শিহাবরা যারা সবসময় অন্যের ভালো থাকাটাকে মূল্যায়ন ও সম্মান করতে জানেন এবং তাদেরকে নিয়ে ভাবেন।
Discussion about this post