অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
করোনা সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশে গত মার্চ মাসের ১৭ তারিখ থেকে সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক হওয়া নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা সর্বত্র কমবেশি বিরাজ করছে। উন্নত দেশগুলোতে অনলাইন পদ্ধতিতে পাঠদানের সুযোগ-সুবিধা আগে থেকে বিদ্যমান থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাক্রম অনেকটাই স্বাভাবিক গতিতে চলেছে। আমাদের মতো দেশগুলোতে অনলাইন পদ্ধতিতে পাঠদানের বিষয়টি এখনো সীমিত পরিসরে শহরে বেসরকারি কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবহার করছে বলে দাবি করা হচ্ছে। তবে তাদের পাঠদান ও পরীক্ষা নেয়ার মান কতটা সন্তুষ্টজনক সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, বাকি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইন পদ্ধতি পাঠদানে অভ্যস্ত নয়, সে ধরনের প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নেই। সে কারণে বলা চলে সিংহভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই গত ৬ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। কেউ কেউ অনলাইন পদ্ধতির প্রবর্তন করতে গিয়ে প্রশিক্ষণহীনতার কারণে ছাত্রছাত্রীদের খুব একটা আকর্ষণ করতে পারেনি। আবার আমাদের শিক্ষার্থীদেরও তথাগত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে অনলাইন পদ্ধতির পাঠে মনোযোগী হওয়ার প্রবণতা খুব একটা লক্ষ করা যায়নি। সে কারণে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা করোনার এই লম্বা সময়ে বন্ধ থাকায় অভিভাবকদের মধ্যে সন্তানদের শিক্ষাজীবন নিয়ে ব্যাপকভাবে দুশ্চিন্তা লক্ষ করা যাচ্ছে। এই নিয়ে অভিভাবকরা নানা ধরনের মতামত গণমাধ্যমের সম্মুখে প্রকাশ করার চেষ্টা করছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের পাঠদান, শিক্ষা বছর, বিভিন্ন পরীক্ষা ইত্যাদির প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারছে না।
কেননা এখনো দেশে করোনা সংক্রমণ নিম্নগামী হয়েছে কিনা সেটি সম্পর্কে কোনো মহলেই নিশ্চিত হতে পারছে না। তবে করোনা সংক্রমণ এখনো যে পর্যায়ে আছে তাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাক্রম শুরু করার পর সংক্রমণের গতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কোনো মহলই উড়িয়ে দিচ্ছে না। তাছাড়া পৃথিবীব্যাপী অনেকে দেশেই করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। সে কারণে করোনা আতঙ্ক থেকে আমরা এখনো মুক্ত নই। তাছাড়া প্রতিবেশী ভারতের করোনা সংক্রমণের প্রভাব বেশ কয়েকটি রাজ্যে উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ থেকে মুক্ত হওয়ার ধারণা এখন নিতে পারছে না। যদিও অবস্থা দৃশ্যে মনে হচ্ছে সরকার, বিভিন্ন পেশাজীবী গোষ্ঠী ও সাধারণ মানুষ করোনা সংক্রমণের শুরুর সময়ের ভিত্তি এখন অনেকটাই যেন কাটিয়ে জীবন-যাপনকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। ফলে বেশিরভাগ মানুষই এখন জীবন ও জীবিকার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে এসেছেন।
কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে এখনো সরকার যেমন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, অভিভাবকরাও সন্তানদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারছে না। তবে অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে বর্তমান শিক্ষা বছরের অবস্থা নিয়ে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বুঝতে পারছে না শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হলেও শ্রেণিপাঠ, সিলেবাস, পরীক্ষা তথা শিক্ষা বছরের কার্যক্রম কীভাবে তারা সামাল দেবে কিংবা শিক্ষা বছরটি সম্পন্ন করবে? সে কারণে কেউ কেউ দাবি করছেন সিলেবাস কমিয়ে দেয়ার। কেউ কেউ সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নেয়া আবার কেউ কেউ অটোপাসের পাসের সুপারিশ করছেন। আসলে নানাজনের নানা মত থেকে তেমন গ্রহণযোগ্য মত কোনটি সেটি নির্ধারণ করা কারো পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না। কেননা শিক্ষার্থীরা আড়াই মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করার যে সুযোগ পেয়েছিল সেটি অনেকেই ভুলে গেছে। এখন সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর থেকে পঠন-পাঠন শুরু করার পরিবেশ সৃষ্টি হলে সিলেবাস শেষ করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, এটি সবাই বুঝতে পারছে। তার ওপর রয়েছে পিইসি, জেএসসি, জেডিসি, বার্ষিক এবং পরবর্তী ফেব্রুয়ারিতে এসএসসির মতো পরীক্ষা অনুষ্ঠিত করা। এখনো করোনা সংক্রমণেই সহনীয় পর্যায়ে আসার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে উল্লিখিত শিক্ষাক্রমগুলো কীভাবে শুরু ও মোটামুটিভাবে সম্পন্ন করা যাবে সে ব্যাপারেও কোনো গ্রহণযোগ্য নিরাপদ সিদ্ধান্ত নেয়া যাচ্ছে না। তারপরও সব মহলে যেহেতু এসব নিয়ে নানা ধরনের মতামত, প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তহীনতা লক্ষ করা যাচ্ছে সে কারণে কয়েকটি বিষয়ে আমি আমার মতামত তুলে ধরছি। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, অভিভাবক এবং শিক্ষকরা ভাবনাচিন্তা করতে পারেন।
প্রথমেই বলে রাখি স্কুলপর্যায়ে শিক্ষা বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত নির্ধারিত আছে। এ বছরের বাস্তবতার কারণে আমাদের শিক্ষা বছরের এ সময় কাঠামোকে অলঙ্ঘনীয় ভেবে বসে থাকা ঠিক হবে না। আমরা যদি করোনা বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি থেকেও স্কুল ও মাদ্রাসাগুলো খুলে দেয়ার অনুমতি লাভ করি তাহলে এ বছরের জন্য আমরা সাড়ে ৩ মাস সময় পাব। এর সঙ্গে আরো ৩ মাস যুক্ত করে আমরা যদি এবারের শিক্ষা বছরটিকে স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য ২০২১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত বর্ধিত করি তাহলে আমাদের হাতে যে অতিরিক্ত সময়টি পাওয়া যাবে তাতে সিলেবাস শেষ করার মোটামুটি একটা সময় পাওয়া যেতে পারে।
সেক্ষেত্রে ২০২১ সালের শিক্ষা বছরের ৯ মাসের সঙ্গে পরবর্তী ২০২২ সালের ২ মাস বর্ধিত করে শিক্ষা বছর নির্ধারণ করা যেতে পারে। এর পরের শিক্ষা বছরটি বড়জোর জানুয়ারি পরের বছরের এক মাস তথা জানুয়ারি মাসটি যুক্ত করে কমিয়ে আনা যেতে পারে। এখন সবকিছুই নির্ভর করবে আমরা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বা অক্টোবরের শুরুতে স্কুল ও মাদ্রাসাগুলো নিরাপদে খুলে দিতে পারব কিনা। যদি এমনটি করা যায় তাহলে সিলেবাস কমিয়ে কিংবা অটোপ্রমোশন দিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান দক্ষতা অর্জন থেকে দূরে রাখা বা বঞ্চিত করা মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা বাস্তব পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা বছরকে ৩ বছরের জন্য ভাগাভাগি করে এ বছরের অভাবটি যদি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা জ্ঞান-দক্ষতায় খুব বেশি পিছিয়ে পড়বে না। কিন্তু সংক্ষিপ্ত সিলেবাস বা নামেমাত্র পরীক্ষা অথবা মত প্রকাশের যে বিপর্যয় ঘটবে সেটি কাটিয়ে ওঠা জাতীয়ভাবে মোটেও সম্ভব হবে না। সে কারণে আমার প্রস্তাব হচ্ছে পরবর্তী শিক্ষা বছরগুলোকে বিন্যস্ত করে স্কুল ও মাদ্রাসা শিক্ষা কার্যক্রমকে সামনের ৩ বছর চালিয়ে নিতে হবে। এর পরে শিক্ষা বছর আপনাআপনিই আগের নিয়মে স্থির হয়ে যাবে।
করোনা শুরু হওয়ার পর শহরাঞ্চলে স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের অনলাইন, সংসদ টিভি, টিভির পাঠদান ইত্যাদিতে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করার জন্য যেসব উদ্যোগ নিয়েছিল তাতে কিছুটা হয়তো সংযুক্তি ঘটেছে। তাছাড়া অভিভাবকদের প্রচেষ্টাতেও শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে বইপুস্তকের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার্থী এবং বিদ্যালয় একেবারেই বিচ্ছিন্ন থেকেছে। ফলে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা অনেকটাই লেখাপড়া থেকে দূরে রয়েছে। এ অবস্থায় আমি মনে করি শিক্ষার্থীদের অন্তত বইপুস্তকের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য একটি বিশেষ ধরনের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ব্যবস্থাটি হলো সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে পরীক্ষার উত্তরপত্র এবং প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে দেবে। প্রশ্নপত্র গতানুগতিক না হয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাওয়া হবে বিষয়ে বিভিন্ন অধ্যায় বা পাঠের ওই অংশটুকু পড়ে তুমি কী বুঝতে পেরেছ বা এর সমস্যার সমাধান তোমার ভাবনায় কী হতে পারে, তা তুমি ওই অংশটি পাঠ করে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করবে। এ ধরনের প্রশ্ন শিক্ষার্থী ঘরে বসে বই পড়ে উত্তর নিজের মতো করে লেখার চেষ্টা করবে।
বিকালের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তরপত্র সংগ্রহ করার মাধ্যমে বিষয় শিক্ষক মূল্যায়নের চেষ্টা করবেন। এভাবে প্রতিটি বিষয়েরই পরীক্ষা শিক্ষার্থীরা বাড়িতে বসে বই পড়ে দেয়ার চেষ্টা করলে অন্তত বইয়ের অধ্যায়ও পাঠগুলোর সঙ্গে তাদের কিছুটা হলেও সংযুক্তি ঘটবে। তবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী পর্যন্ত এভাবে করোনাকালের এ সময়ে বিশেষ ধরনের পরীক্ষায় অংশ নিতে পারে। আমার ধারণা এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা প্রতিটি প্রশ্নের জন্য বইয়ের নির্দিষ্ট অধ্যায় বা পাঠে অংশবিশেষ পড়ে নিজেদের বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটাতে পারে। অভিভাবকদের প্রতি শিক্ষকদের অনুরোধ থাকবে তারা যেন শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেয়ার সময় অযাচিতভাবে সাহায্য করতে চেষ্টা না করেন। এই পরীক্ষার ফলাফল তাদের জন্য কোনো সার্টিফিকেট দেবে না হয়তো, কিন্তু শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন বই থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর বইয়ের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্তি ঘটিয়ে নিজের বিষয়ের জ্ঞানগত দক্ষতা পাঠ্যবইয়ের সহায়তা নিয়ে যাচাই করার সুযোগ পাবে। এতে তাদের জন্য তেমন কোনো ভিত্তিকর হবে বলে আমি মনে করি না। তবে প্রশ্নপত্র প্রণয়নে বিষয় শিক্ষকরা যেন প্রথাগত প্রশ্ন প্রণয়ন না করে সুনির্দিষ্ট অধ্যায়, পাঠ বা পরিচ্ছেদের অংশে বর্ণিত বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের ভাবনা-চিন্তা, মতামত তেমনভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে সেটি মূল্যায়ন করতে সচেষ্ট থাকেন। এর জন্য শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার সময়ও যেন দিনের একটা বড় অংশজুড়ে থাকে। যাতে তারা প্রশ্ন এবং বই পড়ে বিষয়টা বুঝে লিখতে পারে। আশা করি শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে পারে।
লেখক: মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।
Discussion about this post