বিশেষ প্রতিবেদক
চাকরি জীবন শেষে। পেনশনের হয়রানি নিয়ে টেনশন আবদার রহমান। কি ভাবে মিলবে তার পিআরএল ও পেনশনের মঞ্জুরি কাগজ পত্র।কিন্তু ৩দিন আগেই পিআরএল মঞ্জুরির কাগজপত্র হাতে পেয়ে যান তিনি! জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে চৌগাছা উপজেলার ভাদড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক আবদার রহমান।
আবদার রহমান বলেন, গত ৩০ ডিসেম্বর অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) শুরু তার। তিনদিন আগেই ২৭ ডিসেম্বর পিআরএল মঞ্জুরির কাগজপত্র হাতে পেয়েছেন। এত সহজে পেনশনসহ যাবতীয় কাগজপত্র পেয়ে তিনি খুশি। আর এটি সম্ভব হয়েছে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলমের কল্যানে। তিনি নিজেই উপজেলা দপ্তরে গিয়ে সেখানেই অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকের হাতে মঞ্জুরির কাগজপত্র তুলে দিয়েছেন।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে যোগদানের পর থেকে এটি চালু করে তিনি। শুধু আবদার রহমান নয়, এ পর্যান্ত তিনি যশোর জেলায় মোট ১১০ জন অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এ সুবিধা পেয়েছেন। উপজেলায় বসে সহজেই মিলেছে পিআরএল ও অবসর ভাতার মঞ্জুরিপত্র।এ জন্য তাদেরকে কখনও জেলা অফিসে আসতে হয়নি। তার এই উদ্যোগকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, অতীতে এমন উদ্যোগ তারা কখনো দেখেননি। এতে শিক্ষকদের সুবিধা হয়েছে। শুধু পেনশন সুবিধা নয় তিনি জোর দিয়েছেন ছাত্র-ছাত্রীদের হাতের লেখার উপর। প্রতিদিন একটি করে নতুন ইংরেজি শব্দ শিখানোর উপর জোর দিয়েছেন তিনি। এতে ছাত্র-ছাত্রীদের ভাষার উপরে দক্ষতা আসবে বলে তিনি মনে করেন। আর এ কাজে তাকে সহযোগিতা করছে শ্রেনী শিক্ষকরা।
এ প্রসঙ্গে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম বলেন, চাকরি জীবনের শেষে শিক্ষকদের পেনশন ও পিআরএল পাওনা নিয়ে টেনশনে ভুগতে হতো। সেটি লাঘবে আমি উদ্যোগ নিয়েছি উপজেলায় গিয়ে তাদের হাতে পেনশন ও পিআরএল কাগজপত্র তুলে দিয়ে আসবো। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে আমি যশোরে যোগদান করি। যোগদানের পর থেকে এটি চালু করেছি।২০১৯ সালে ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ১১০জন শিক্ষক আবসরে গেছেন।তিনি নিয়মিত উপজেলা অফিস পরিদর্শন ও বিদ্যালয় পরিদর্শনে যান এবং সেখানেই সকল রেজিস্টার যাচাই বাছাই করে কাজ সম্পন্ন করেন। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখ অহিদুল আলম বলেন, তার পর শিক্ষকদের হাতে মঞ্জুরিপত্র তুলে দেওয়া হয়। প্রতি দুই মাস পর পর উপজেলায় গিয়ে এই কাজটি করছেন তিনি। এতে শিক্ষকদের হয়রানি বন্ধ হয়েছে। সহজেই তারা পেনশন ও পিআরএল পাচ্ছেন। তিনি বলেন, এটি অব্যাহত রাখবো। ভবিষতে অন্য জেলায় গেলেও এই সুবিধা চালু রাখবো। এটি আমার স্বপ্ন।
যে পদ্ধতিতে খুব সহজে হয় এতদিনের ভীষণ জটিল(?) এই কাজ !
যশোর জেলায় মোট ১২৯২টি স্কুলে আট হাজার শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। এসব শিক্ষকের মধ্যে কারা পেনশন এবং পিআরএল পাবেন তার একটি তালিকা করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ী শিক্ষকদের জন্ম তারিখের ভিত্তিতে পেনশন এবং পিআরএল প্রদান ঠিক করা হয়। এরপর পেনশন কিংবা পিআরএলে যাওয়ার কমপক্ষে দু’ মাস পূর্বে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে তার পেনশন কিংবা পিআরএলের তারিখ জানিয়ে পত্র দেয় শিক্ষা অফিস। একইসঙ্গে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করা হয়। শিক্ষকদের দেয়া চিঠিতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে আবেদন করতে অনুরোধ করা হয়। শিক্ষকদের কাছ থেকে আবেদন পাওয়ার পর উপজেলা শিক্ষা অফিস জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পেনশন কিংবা পিআরএল প্রদানের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। সর্বশেষ, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার প্রতি দু’মাস অন্তর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে উপস্থিত হয়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীকে পেনশন কিংবা পিআরএলের আদেশ সংক্রান্ত পত্র হস্তান্তর করেন। ফলে, জেলা অফিসে এসে অহেতুক হয়রানি থেকে রক্ষা পাচ্ছেন শিক্ষকরা। এই পদ্ধতি ইতোমধ্যে শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে সাড়া ফেলেছে। হয়রানি এবং তদবিরের হাত থেকে রেহাই পাওয়ায় সংশ্লিষ্টরা খুব খুশি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে সদরে ৫জন এবং ২০১৮ সালে যশোর জেলায় ১০৫ জন শিক্ষককে পিআরএল ও পেনশন দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে অভয়নগরে ৬জন, কেশবপুরে ৮জন, চৌগাছায় ১২জন, ঝিকরগাছায় ১৫জন, বাঘারপাড়ায় ৫জন, মণিরামপুরে ১৮জন, শার্শায় ১৪জন ও সদর উপজেলায় ২৭জন। উপকারভোগী চৌগাছার আড়ারদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক আবদুর রাজ্জাক বলেন, পাওনা পেনশনের টাকা উত্তোলন নিয়ে টেনশনে ছিলেন। উপজেলা শিক্ষা অফিসে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে জানানো হয় ৩১ ডিসেম্বর জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা অহিদুল ইসলাম নিজে এসেই পেনশন মঞ্জুরি কাগজ তুলে দিবেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সবকাজ সম্পন্ন করে ওই দিনই উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকেই পেনশন মঞ্জুরি হাতে তুলে দেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।তিনি এই কার্যক্রমের নাম দিয়েছেন পেনশন ও পিআরএল শিক্ষকদের দোরগোড়ায় প্রদান ক্যাম্প।
তিনি জানান, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিজে এসে পেনশনের মঞ্জুরির কাগজপত্র দিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিরল। শিক্ষকতা জীবনে এই প্রথম দেখলাম উপজেলায় বসে পেনশন, পিআরএল কাগজপত্র পাওয়া যায়। চৌগাছার বেড়গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক গোলাপী রানীও কোন ঘুষ ছাড়াই সহজেই উপজেলায় বসে পিআরএল কাগজ পেয়েছেন। এজন্য তিনি শিক্ষা কর্মকর্তাকে ধন্যবাদও জানিয়েছেন।
তার দাবি, চাকরি জীবনের শেষে পিআরএল ও পেনশনের ভাতার টাকা উত্তোলন নিয়ে সবাই টেনশনে থাকে। নানাভাবে হয়রানির শিকারও হয়। কিন্তু বর্তমান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার উদ্যোগে সেই টেনশন ও হয়রানিমুক্ত হয়েছেন শিক্ষকরা।
যশোর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার অভূতপূর্ব এই উদ্যোগ কি অন্য জেলায়ও নেয়া যায়না? অন্যান্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাগণ কি এই নিয়ম অনুসরণ করতে পারেননা ? প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কি এর আলোকে একটি বিশেষ আদেশ জারি করে প্রচন্ড হয়রানি ও মনোকষ্ট থেকে বৃদ্ধশিক্ষকগণকে রেহাই দিতে পারেননা? পারেননা উপজেলাস্তরের কিছু দূর্নিতীবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ঘুষবণিজ্য চিরতরে বন্ধ করতে? নি:সন্দেহে লক্ষ লক্ষ শিক্ষকের প্রাণের দাবী এটি।
Discussion about this post