বিশেষ প্রতিবেদক
করোনার তান্ডবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে প্রাইমারী থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরের কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। এর উপর শিগগিরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে না বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এই অবস্থায় পরম অনিশ্চয়তায় পড়া শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের সামনে অনলাইনে পড়ালেখা চালু রাখা ছাড়া বিকল্প কোনো সুযোগ নেই।
গতকাল সোমবার গণভবন থেকে রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মতবিনিময়কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান, করোনাভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। তিনি বলেছেন, ‘যখন করোনার প্রকোপ থাকবে না, তখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। আমরা এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলব না। অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল-কলেজ সবই বন্ধ থাকবে, যদি করোনাভাইরাস অব্যাহত থাকে। যখন এটা থাকবে না, তখনই খুলব।’
ইতোমধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রাকপ্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণির ক্লাস সম্প্রচার করছে। শুরু হয়েছে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য অনলাইন ক্লাস।কিশোর বাতায়নের মাধ্যমে নেয়া হচ্ছে কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির অনলাইন ক্লাস। এই কার্যক্রম সর্বমহলে প্রশংসিত হলেও সংসদ টিভি সবজায়গায় দেখা না যাওয়া এবং ইন্টারনেটের অনুপস্থিতি ও ধীরগতি ইত্যাদি কারণে পুরোপুরি সফল হতে পারছেনা। তার পরও অনলাইন মাধ্যম ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই বলে মানছেন অনেকেই। বেশ কিছু স্কুল-কলেজও স্বউদ্যোগে অনলাইনে ক্লাস প্রচার করছে।শিক্ষামন্ত্রণালয় সকল কলেজসমূহকে অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রম চালানোর নির্দেশ দিয়েছে । ফেসবুক পেজ, মেসেঞ্জার, ওয়েবসাইট বা ফোন করে নিজ নিজ স্কুল কর্তৃপক্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ আরো বাড়ানোর জন্যও বলেছে কর্তৃপক্ষ ।
এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের যাতে ভয়াবহ সেশনজটে পড়তে না হয় সে জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়কে অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রম চালানোর আহবান জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
ইউজিসির এ আহবানে সাড়া দিয়েছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় এ আহবানে সাড়া দেয়নি। কমিশনের সর্বশেষ তথ্য মতে, সারাদেশে ৯৫টি বেসরকারি ও ৪৬টি সরকারি— মোট ১৪১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-কার্যক্রম চলমান থাকলেও ৬৫টিতে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি সরকারি ও ৫২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বাকি ৭৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইনে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করেনি।
এ প্রসংগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ বলেন, ‘সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেতারেও ক্লাস সম্প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ক্লাস শেষে বাড়ির কাজ দেওয়া হচ্ছে। আর এসব ক্লাস যাতে সব শিক্ষার্থী দেখে এ জন্য শিক্ষকদের যোগাযোগ করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা অফিসাররা তা সমন্বয় করবেন। অর্থাৎ স্কুল বন্ধ থাকা সময়ে আমরা অনলাইনে পড়ালেখা অব্যাহত রাখতে চাই। স্কুল খোলার পর ঐচ্ছিক ছুটিগুলো কমানোর পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে।’
করোনার প্রাদুর্ভাবে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। এমনকি নতুন সময়সূচিও প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এসএসসি ও সমমানের ফল প্রকাশও অনিশ্চিত। যদি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্কুল ও কলেজ বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে প্রাথমিকের প্রথম ও দ্বিতীয় সাময়িক এবং মাধ্যমিকের ষাণ্মাসিক পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। স্থগিত করতে হবে উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষাও। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন পড়ালেখা বন্ধ রাখলে সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া ছাড়া ভিন্ন পথ খোলা থাকবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা গত সপ্তাহে ভার্চুয়াল মিটিং করেছিলাম। এখন আবারও বসতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়া যাবে না। তবে গণপরিবহন চালু হলে এবং অফিস খুললে ভিন্ন উপায়ে এসএসসির ফল প্রকাশ করা সম্ভব হবে। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসেই ফল জানবে। এমনকি অনলাইনে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি প্রক্রিয়াও শুরু করা সম্ভব হবে।’
আন্ত শিক্ষা বোর্ডের এই সভাপতি বলেন, ‘দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলে শিক্ষাব্যবস্থা সংকটের মধ্যে পড়বে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে আমাদের বিকল্প ভাবতে হবে। বন্ধের মধ্যে টেলিভিশনে ক্লাস সম্প্রচার করা হচ্ছে। স্কুল খুললে ঐচ্ছিক ছুটি কমানোর চিন্তাভাবনা চলছে। সিলেবাস নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। অর্থাৎ যখনই স্কুল খুলুক না কেন আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’
বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও গ্রিন জেমস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যক্ষ ড. জি এম নিজাম উদ্দিন বলেন, “আগামী মে-জুনের ‘ও’ এবং ‘এ’ লেভেল পরীক্ষা এবার হবে না। এর পরিবর্তে স্কুল বেইসড অ্যাসেসমেন্ট করা হবে। আমাদের স্কুলগুলোর প্রত্যেক শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষাও জুনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সেটাও এখন অনিশ্চয়তায় পড়েছে। তবে বেশির ভাগ স্কুল অনলাইনে গুগলের মাধ্যমে লাইভ ক্লাস নিচ্ছে, হোম ওয়ার্ক ও অ্যাসাইনমেন্ট দিচ্ছে। সেটার একটা মূল্যায়ন হতে পারে। অনেক স্কুলই অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে সব স্কুলের পক্ষে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়াটাও সম্ভব নয়, যা একটি বড় সমস্যা।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বসব। দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকলে সেশনজট ইস্যু আসবে। হয়তো একটা সেমিস্টার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ জন্য সাপ্তাহিক ও অন্যান্য ছুটির দিনে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রাখার বিষয়ে আমরা ভাবছি। আমরা অনলাইনে ক্লাস নিতে বলেছি, কিন্তু পরীক্ষা নিতে নিষেধ করেছি। কারণ অনলাইনে পরীক্ষার দোহাই দিয়ে সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না।’
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষাকার্য় ক্রম সচল রাখতে এবং টিভি ও অনলাইনে প্রচারিত ক্লাসে মনযোগী হতে শিক্ষার্থীদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
Discussion about this post