সুমন ভট্টাচার্য
একজন রাষ্ট্রনায়কের মৃত্যু গোটা মহাদেশকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে? কতটা প্রভাবিত করেছিল বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে?
১৯৭৫ এর পরবর্তী সময়ে মার্কিন কনসুলেটের বিভিন্ন ইন্টারনাল মেমো, যা পরবর্তীকালে উইকিলিকসের মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে, সেগুলো দেখলে পরে বোঝা যায় যে, মুজিবের নিষ্ঠুর হত্যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে কতটা আলোড়িত করতে পারে তা নিয়ে চিন্তিত ছিল ওয়াশিংটন।
যেমন ধরা যাক, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর কলকাতায় সাংবাদিক সম্মেলন করে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এবং চীনাদের বিঁধে ছিলেন কংগ্রেসের তৎকালীন দাপুটে নেতা এবং যুব কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি ও সাংসদ প্রিয় রঞ্জন দাশমুন্সি। আবার ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে, এই খবর কলকাতার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়া নিয়ে কলকাতায় মার্কিন আধিকারিকদের কাছে জানতে চায় দিল্লির মার্কিন কনস্যুলেট। এবং কলকাতার যুগান্তর পত্রিকার এই খবর, অর্থাৎ ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ নিয়ে প্রতিবেদন ভুয়ো বলে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্রকে কড়া প্রতিবাদপত্র পাঠাতে বলে দিল্লির মার্কিন দূতাবাস।
কেন ভারতবর্ষে মুজিব হত্যা নিয়ে কি ধরনের খবর প্রচারিত হচ্ছে বা কি ধরনের জনমত তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে এতটা সংবেদনশীল ছিল ওয়াশিংটন?
একটা অবশ্যম্ভাবী কারণ যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যেভাবে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল এই বঙ্গ এবং কলকাতা, তা ততদিনে মার্কিন প্রশাসনের নজরে এসে গিয়েছিল। আমাদের মাথায় রাখতে হবে গত শতকের ছয় এবং সাতের দশকে যে দুটি ঘটনা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিকে আলোড়িত করেছিল এবং আমেরিকার জন্য বড় ধাক্কা ছিল, সেই দুটি ঘটনারই অভিঘাত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গণআন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে কলকাতায় টের পাওয়া যেত।
প্রথমটি অবশ্যই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ছোট্ট দেশ ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তারপরে কমিউনিস্টশাসিত উত্তর ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে আমেরিকার লাগাতার যুদ্ধ। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে কলকাতার নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ, রুখে দাঁড়ানো এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন যদি সেই সময় মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে সংগঠিত গণআন্দোল ন এবং জনমত তৈরির অন্যতম সার্থক উদাহরণ হয়, তাহলে তারপরে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গেও কলকাতা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল।
একদিকে এই দুটি ঘটনাই যেমন তৎকালীন মার্কিন প্রশাসনের দক্ষিণপন্থী রাজনীতির চরম বহিঃপ্রকাশ ছিল, তেমনই তার বিরুদ্ধে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কিভাবে মানুষ সংগঠিত হচ্ছে বা গণআন্দোলন তৈরি হচ্ছে, তা ঢাকা এবং কলকাতা হাতে হাত মিলিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে ভিয়েতনামের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তারপরে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ, দুটিই ওয়াশিংটনের বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা ছিল। এবং ইতিহাসের অদ্ভুত সমাপতনে ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কলকাতা যেভাবে উত্তাল হয়েছিল, জনমত তৈরি হয়েছিল, কলকাতার জনমত যেভাবে সামগ্রিক ভারতবর্ষের কূটনীতি এবং রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছিল, তা ইতিহাসে আলাদা করে উল্লেখ করার মতো।
সেই জন্যেই মুজিব হত্যার পরে কলকাতায় কিভাবে প্রতিক্রিয়া তৈরি হচ্ছে বা ভারতবর্ষে জনমত কোন দিকে যাচ্ছে তাই নিয়ে গভীর চিন্তিত ছিল মার্কিন প্রশাসন। উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া কেবল বা অন্য আদান-প্রদান দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, ওয়াশিংটন ভাবছিল ভারতবর্ষের সেই সময়ের প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেস এবং কংগ্রেস প্রভাবিত সংবাদমাধ্যমগুলো কিভাবে আমেরিকার বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করছে, তার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সেই জন্যেই মুজিব হত্যার প্রতিবাদে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছে, কলকাতার যুগান্তর পত্রিকায় এই খবর প্রকাশের পরে কলকাতা, দিল্লি এবং ওয়াশিংটনের মার্কিন বিদেশ দফতরের আধিকারিকদের মধ্যে ক্রমাগত বার্তার আদান-প্রদান হয়েছিল। এবং শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটনের নির্দেশে দিল্লি কলকাতার মার্কিন দূতাবাসকে বলে, যুগান্তরকে কড়া প্রতিবাদ পত্র পাঠানোর জন্য।
এই সবকিছুই আসলে বলে দেয় যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যা গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিকে কতটা আলোড়িত করেছিল এবং পৃথিবীর দুই শক্তিকেন্দ্র ওয়াশিংটন এবং মস্কো কিভাবে সমস্ত ঘটনাপ্রবাহকে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছিল। গত শতকের সাতের দশকে কংগ্রেসের তরুণ তুর্কি নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি যেভাবে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকে কেন্দ্র করে মার্কিন গুপ্তচর সংস্থা সিআইয়ের দিকে আঙুল তুলেছিলেন, তা যে ভারত তথা দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ায় আমেরিকার ভাবমূর্তিকে আরো খারাপ করবে, তা নিয়ে অন্তত ওয়াশিংটনের কোনও সংশয় ছিল না!
কলকাতা এবং ভারতবর্ষের প্রতিক্রিয়া, ভারতবর্ষের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এবং সংবাদমাধ্যমগুলো কিভাবে মুজিব হত্যাকে দেখছে, তা নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ এবং মার্কিন সরকারের শশব্যস্ততা নিয়ে এত শব্দ ব্যয় করলাম কেন? আসলে বোঝানোর জন্য যে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা এবং মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশ হলেও ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসন হিসেবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি, গোটা পৃথিবীতে কতটা আলোড়ন তুলেছিল।
ওয়াশিংটন এবং মস্কো, গত শতকের সাতের দশকের দুই শক্তিকেন্দ্র ঢাকার যেকোনো ঘটনা বা ‘মুভমেন্ট’ নিয়ে কতটা আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য রাখত, তা বোধ হয় মুজিবের হত্যাই আরেকবার প্রমাণ করেছে। আমাদের মনে রাখতে হবে বঙ্গবন্ধু হত্যার ঠিক আগের দিন গভীর রাতে যখন ষড়যন্ত্রীরা নিজেদের মধ্যে বৈঠক করছিল, তখন অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রী ফারুক সেনাবাহিনীর সদস্যের ক্ষ্যাপাতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, মুজিবুর রহমানকে হত্যা করলে বাংলাদেশের যে নতুন সরকার তৈরি হবে, সেই প্রশাসন ইসলামিক রাষ্ট্র গঠন করবে। তার মানে শুধু একটা অভ্যুত্থান বা সেই অভ্যুত্থানের জন্য রাষ্ট্রপতিকে হত্যা নয়, গোটা দেশের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেওয়া। ফারুকের প্রতিশ্রুতি, সেনাবাহিনীর একজন জুনিয়র অফিসারের উচ্চারিত শব্দ আসলে বলে দেয় বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র কত গভীরে ছিল এবং কেন আর কি কি কারণে কারা মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশ থেকে, বা আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ এর বাংলাদেশে বারে বারে সামরিক শাসন, বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের তৈরি করে যাওয়া সংবিধানকে পরিবর্তনের চেষ্টা আসলে বলে দেয় ৭৫ এর ১৫ আগস্ট দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ দিন ছিল এবং স্বাধীন বাংলাদেশের স্রষ্টা হিসেবে মুজিবুর রহমান কেন আইকনিক রাজনৈতিক আর ভিয়েতনামের কিংবদন্তি নেতা হো চি মিনের এর সঙ্গেই তাঁর নামও উচ্চারিত হতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পৃথিবীতে দুই মহাশক্তিধর দেশ আমেরিকা এবং রাশিয়া, রাজনীতির ৬৪ খোপে যে গুটি চালাচালি করছিল, সেখানে বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে স্বাধীন করা সব হিসেবকে উল্টে দিয়ে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিল। মুজিবুর রহমান শুধু জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বকে উল্টে দিয়েছিলেন, এটা সহজ কথা। আসলে কামাল আতাতুর্কের পরে গোটা মুসলিম বিশ্বের কাছে তিনি এক নতুন রোল মডেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে রোলমডেল ১৯৭৫ পরবর্তী সময় পর্যন্ত স্থায়ী হলে মুসলিম বিশ্বের চেহারাটা কেমন হতো, আমরা তা জানি না। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনীতি কোনদিকে বইতো, তাও বলা সম্ভব নয় এবং সেই কারণে যখন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে শাসন করেন এবং একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চালানোর অঙ্গীকার করেন তখন গোটা বিশ্বকে তা মন দিয়ে শুনতে হয়। কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক যখন আর নিজের পুরনো অবস্থানে নেই, গোটা মুসলিম বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের টানাপড়েন চলছে, তখন বাংলাদেশে হাসিনার সরকার মুজিবের আদর্শকে ধরে রাখতে পারলে এক আলোকবর্তিকা বা লাইট হাউজ হিসেবে গণ্য হবে।
একজন রাষ্ট্রনায়কের হত্যা, যিনি আবার সেই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাও বটে, আসলে সেই ভূখণ্ডকে কতটা প্রভাবিত করতে পারে, তা বোধ হয় তাঁর মৃত্যুর ৪৭ বছর বাদেও বাংলাদেশকে দেখলে অনুধাবন করা যায়। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে আফ্রিকা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বিভিন্ন সদ্যোজাত গণতন্ত্রে বিভিন্ন জননেতাকে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়েছে বা হত্যা করানো হয়েছে। অনেক সময় বড় রাষ্ট্রের ইশারায় অন্য কোনও শক্তি হয়তো সেই হত্যাকে সংঘটিত করেছে। কারণ তা না হলে হয়তো সেই রাষ্ট্রনায়ক যেভাবে তার মহাদেশের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতেন, আলোড়িত করতেন, তা বৃহৎ শক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াত।
দক্ষিণ আমেরিকার চিলিতে সমাজতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে সরিয়ে পিনোচেতকে বসানোর ঘটনা লাতিন আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা এবং এখনো শুধু চিলি নয়, দক্ষিণ আমেরিকার যেকোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসে বারবার আলেন্দের পরিবর্তে পিনোচেত বসানোর উদাহরণ বা রেফারেন্স ফিরে ফিরে আসে। আজকের ওয়াশিংটন নিসংশয়ে গত শতকে দক্ষিণ আমেরিকায় করা তার রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক ভুলকে নিয়ে চিন্তিত এবং হয়তো সংশোধনের জন্য ব্যস্তও। ঠিক তেমনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে মুজিব হত্যা এমন একটি ঘটনা যা পরের ৫ দশক ধরে শুধু এই উপমহাদেশ নয়, গোটা এশিয়ার রাজনীতিকে আলোড়িত করেছে।
মুজিবকে যে হত্যা করা হতে পারে, এই বিষয়ে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার তৎকালীন প্রধান আরএন কাউ যে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলেন বা ইন্দিরা প্রশাসন যে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা থেকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমস্ত রকম ব্যবস্থা রেখেছিল, তাও বহু চর্চিত বিষয়। কিন্তু বিশ্ব রাজনীতির দাবা খেলায় এমন ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকে, যা সময়কে বদলে দেয়। কি করে আমরা ভুলে যাব যে ইন্দিরা বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন, মুজিবকে বাঁচাতে সদা তৎপর ছিলেন, সেই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকেও তো আততায়ীর গুলি ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল।
লেখক: পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
Discussion about this post