সৌমিত্র শেখর
করোনাকালের গৃহবন্দিত্ব এ বছর মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয়েছে। এর অবসান কবে হবে কে জানে? ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ায়ও যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, তা হিসাব কষে বোঝানো যাবে না। এই ক্ষতি শুধু সাময়িক নয়, এ ক্ষতির প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কারণ বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয় পর্যায়ে এক ক্লাসের পড়ার সঙ্গে পরের ক্লাসের পড়ার ধাপ যুক্ত ও সম্পৃক্ত। তাই যেনতেনভাবে কোনো অধ্যায় শেষ করলে পরের শ্রেণিতে ওই অধ্যায়সংশ্লিষ্ট পড়া-বোঝা, আসলেই বোঝা হয়ে ওঠে। আর সব বইয়ের প্রায় সব অধ্যায়ই যখন এমনতরো হবে, তখন মনে হবে, লেখাপড়ার একটি স্তরই যেন বাদ গেল! এ বছর জানুয়ারির মাঝামাঝি সারা দেশে বই পৌঁছলে, হিসাব করে বলা যায়, মাত্র মাস দুয়েক লেখাপড়া হয়েছে। কিন্তু এই লেখাপড়ার গতিই ওঠেনি তখনো। অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার আগে আগে লেখাপড়ার গতি ওঠে আর তা চলে বাকি ছয় মাস। এবার সব কিছুতেই হিসাব এলোমেলো হয়ে গেছে। সোমবার (৭ জুন) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, যারা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছিল, তাদের জন্য তো এটি একটি বিপর্যয়ই! পরীক্ষার ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী সব কিছু তৈরি তাদের। কিন্তু পরীক্ষা স্থগিত! এ পরীক্ষায় তারা আবার কবে বসবে কেউ জানে না। ২০২০ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বের হলো। এবার কৃতকার্যরা স্বাভাবিকভাবেই চাইবে ভর্তি হতে। শুধু ভর্তি নয়, ভালো কলেজে ভর্তি হতে। এর জন্য একটা চঞ্চলতা কাজ করবে তাদের মধ্যে। ২০২১-এর মাধ্যমিক পরীক্ষা যারা দেবে, তাদেরও মাথায় হাত! ঘরে বসে একা একা কী আর পড়া যায়। বিশেষ করে, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় যারা পড়ছে, তাদের সমস্যা মেটানোর লোক সব ঘরে নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক—এ দুই পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ওপর উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সময় নম্বর বরাদ্দ থাকে। এ কারণে যারা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে, তাদের কাছে পরীক্ষা দুটি ‘অগ্নিপরীক্ষা’র শামিল। অবশ্য পরীক্ষাকে এভাবে না নেওয়াই ভালো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সব ছাত্র-ছাত্রী এ কথা বোঝে না। অনেকে অবশ্য বলবে, সবাই এবার সমহারে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটা একটা সান্ত্ব্তনার কথা বটে, কিন্তু মুক্তির কথা নয়।
২০২০ সালের পুরো হিসাব তো এখনো করার সময় আসেনি, ২০১৯ সাল সামনে রেখে বলি : সাধারণ, মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষা—এই তিন ধারা মিলিয়ে গত বছর উচ্চ মাধ্যমিকে সাড়ে ১৩ লাখ, মাধ্যমিকে প্রায় সাড়ে ২১ লাখ, জেএসসি ও জেডিসি মিলে সাড়ে ২৬ লাখ, প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি মিলে ২৯ লাখ পরীক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল। এ বছর এর সংখ্যা আরো একটু বাড়ারই কথা। এই হিসাবটা সামনে রেখে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ এবং দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, মেডিক্যাল কলেজগুলো, প্রকৌশল-উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি, অন্য সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বর্ষে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা হিসাবে নিলে সব মিলিয়ে দেশে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে চার কোটিতে। অবশ্য এই হিসাবে কওমি মাদরাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্ত করা হয়নি। তাদের যুক্ত করলে সংখ্যাটা আরো বাড়ে।
এবার এই সাড়ে চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য যদি প্রতিদিন গড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য চার শ্রেণিঘণ্টা বরাদ্দ রাখা হয়, তাহলে প্রতিদিন ১৮ কোটি শ্রেণিঘণ্টা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরেট লেখাপড়ার সময় নষ্ট হচ্ছে! এই ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দিনে শুধু চার শ্রেণিঘণ্টাই বিদ্যালয়ে বা মহাবিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে না, অনেকেই বাড়ির শিক্ষক বা বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়ের বাইরে শিক্ষকের কাছেও লেখাপড়া করে। তাদের হিসাবটা করলে যে অঙ্ক পাওয়া যাবে, তা আমাদের মধ্যে আতঙ্ক জাগাবে নিশ্চয়ই। টেলিভিশনে সরকারের পক্ষ থেকে ক্লাস নেওয়ার আয়োজন করা হয়েছে; অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে বেশ কিছু বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়; বেসরকারি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ও অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করেছে; গ্রাম ও শহর থেকে কোনো কোনো শিক্ষক নিজেরাই অনলাইনে অধ্যায়ভিত্তিক আলোচনা করছেন। সব মিলিয়ে ভালো।
কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এ নস্যি! কোনো কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের করা ভিডিও এতটাই কাঁচা ও যেনতেনভাবে করা, সেগুলো দেখা আবার ছাত্র-ছাত্রীদের সময় নষ্টের পর্যায়েও পড়ছে। অর্থাৎ যে সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পুরোদমে লেখাপড়া চালু থাকার কথা, সে সময় চলছে খুবই অপরিকল্পিত শিক্ষা কার্যক্রম, কোথাও বা তা অসম্পূর্ণ। সবচেয়ে দুঃখের কথা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন সম্পূর্ণভাবে স্থবির। অনলাইনে পড়ানোর চেষ্টাটাও করেনি তারা, বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়গুলো যেটা করছে। কোনো একটা জরিপ করেই বলে দেওয়া হয়েছে, অনলাইনে পড়ানো চলবে না। তাহলে কী চলবে, সেটা তারা বলে না। কিন্তু চলতে তো হবে! তার কোনো ইশারা নেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে। সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ই চুপ করে আছে। এ ব্যাপারে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অগ্রণী ভূমিকায় আসতে পারত। কিন্তু সেখানেও ভূতুড়ে রাতের নীরবতা!
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের যদি হিসাব করি, তাহলে টানা বন্ধের দিক থেকে আজ পর্যন্ত সেটা তৃতীয় পর্যায়ে আছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সময় টানা ১৪৪ দিন বন্ধ আর প্রথম পর্যায়ে হলো মুক্তিযুদ্ধকালের পুরো বছর। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এবার দ্বিতীয় পর্যায়টা অতিক্রান্ত হবে। কিন্তু থামার জন্য প্রস্তুতি কী? অভিভাবকদের সামনে বলার মতো দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগও নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্তর্গত দপ্তর বা অফিসগুলো যদি অভ্যন্তরীণ বৈঠক করে এগিয়ে না থাকে, তাহলে শুরু করতেও কিন্তু তাদের সময় লেগে যাবে। দু-একটি উন্মুক্ত আলোচনার খবর পাওয়া যাচ্ছে বটে; কিন্তু তাতে মন্তব্য আসছে, সিদ্ধান্ত নয়। করোনা পরিস্থিতি ও অভিভাবকদের আস্থা—দুটিকে বিবেচনা করলে মনে হয়, আগস্টের প্রথম সপ্তাহের আগে অর্থাৎ ঈদুল আজহার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলেও চালু করা কঠিন হবে। এর মধ্যে ক্যালেন্ডারের দিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জুলাই ২০২০ সেমিস্টার শুরু হয়ে যাবে; প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষার মাত্র তিন মাস (সাধারণত নভেম্বরে শুরু হয়) হাতে থাকবে; মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের (২০২১) নির্বাচনী পরীক্ষার সময় এসে যাবে। আর তামাদি হয়ে থাকা এ বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানের কথা না-ই বা তুললাম!
করোনার এই সময়ে কর্তৃপক্ষ শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালুর ব্যাপারে পরিকল্পনা নিতে পারে। তাদের পরিকল্পনার কথা অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা অবগত হলে মানসিকভাবে অনেকটাই চাঙ্গা হবে তারা। এখন গৃহবন্দি থেকে থেকে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর চাপ পড়ছে। একঘেয়ে হয়ে পড়েছে প্রায় সব কিছু। এ থেকে পরিত্রাণের পথ আগে থেকেই খুঁজতে হবে। বিশেষ করে, প্রতিদিন শিক্ষায় যেহেতু ১৮ কোটি শিক্ষাঘণ্টা ক্ষতি হচ্ছে, তার যতটা রাশ টেনে ধরা যায়, এখন থেকেই সংশ্লিষ্টদের তা ভেবে রাখতে হবে।
লেখক : সৌমিত্র শেখর, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post