ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন
সভ্যতার শুরু থেকেই জ্ঞানদান ও জ্ঞান আহরণের পথ কখনও মসৃণ ছিল না। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের সময় (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৯-৩৯৯) থেকেই জ্ঞান আহরণ ও শিক্ষার পথে নানা প্রতিবন্ধকতা দেখা গেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যা কিনা জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে, সেগুলোরও নিজস্ব ইতিহাস রয়েছে। কখনও রাজনৈতিক মুভমেন্ট, ষড়যন্ত্র, আবার কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম ব্যাহত হয়।
আজ সভ্যতার অগ্রগতির বদৌলতে শিক্ষা, গবেষণা এবং প্রযুক্তির শক্তি নিয়ে আমরা উত্তর আধুনিক যুগে পৌঁছেছি। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে করোনা মহামারি দেখা দিয়েছে, তা আমাদের এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। বিশ্বের এ অসহায় অবস্থার কথা মাথায় রেখে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও বেশি বাস্তবসম্মত করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর জন্য আমাদের তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। করোনা পরিস্থিতির মতো যেকোনও সংকটের ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষা বা ই-লার্নিং যথাযথ সমাধান হতে পারে।
আসুন, শুরুতে অনলাইন শিক্ষা বা ই-লার্নিং সম্পর্কে জেনে নিই। একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়াই হলো ই-লার্নিং। ই-লার্নিং পাঠগুলোর ৮০ ভাগেরও বেশি ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। সেকারণে একে দূরবর্তী শিক্ষণ বা ডিসট্যান্স লার্নিংও ডাকা হয়ে থাকে।
ই-এডুকেশনের প্রতি মনোযোগী হওয়াটা কেন জরুরি? অবশ্যই ই-লার্নিংয়ের কিছু ভালো দিক আছে। প্রথমত, এটি শিক্ষাগ্রহণের একটি সহজ পদ্ধতি। এ প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা যেকোনও জায়গা থেকে যেকোনও কিছু শিখতে পারে। দ্বিতীয়ত, কারও যদি অন্য কাজ করতে হয় এবং পাশাপাশি পড়াশোনাটাও চালিয়ে যেতে হয়, তবে সে তার সুযোগমতো সময় করে পাঠগুলো দেখে নিতে পারে। তার ওপর কেউ যদি কোনও জটিলতায় পড়ে, তবে ভালো করে বোঝার জন্য বারবার ভিডিওগুলো দেখে নিতে পারে। মানুষ সহজেই অনলাইন শিক্ষার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।
করোনাভাইরাস আমাদের শিক্ষা খাতে বাজে প্রভাব ফেলছে। করোনাভাইরাসের আক্রমণের কারণে গোটা বিশ্ব আজ জবুথবু হয়ে পড়েছে। নিয়মিত শিডিউলগুলো ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে স্কুল, কলেজ ও অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে ১৩০টি দেশ তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা করেছে।
আমাদের দেশেও ১৫ জুন পর্যন্ত স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছুটি আরও বাড়তে পারে। ফলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে। বিশ্বজুড়ে এ পরিস্থিতি কয়েক মাস ধরে চলছে। শিক্ষকরা পাঠদান করতে পারছেন না, শিক্ষার্থীরাও শিক্ষাগ্রহণ করতে পারছে না।
সবাইকে যেহেতু বাসায় থাকতে বলা হচ্ছে, তাহলে বাড়িতে থেকেও পড়াশোনাটা চালিয়ে নেওয়া সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট আকারে অনলাইন শিক্ষা কর্মসূচি চালানো হচ্ছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, ‘জুম অ্যাপ্লিকেশন’ ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাঠদান চালিয়ে যেতে পারবে। এক্ষেত্রে বিডিআরইএন (বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্ক) দিনে ২৪ ঘণ্টাই সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অংশ নিতে পারবে, শিক্ষকের ক্লাস লেকচারগুলো নিতে পারবে এবং নিজেদের মতামতও জানাতে পারবে।
বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছে। তবে সেগুলোর বেশিরভাগই স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরনের কর্মসূচি এখনও চালু হয়নি।
এখন প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই নিজেদের ওয়েবসাইট রয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে রয়েছে। ফলে তাদের ই-লার্নিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা কঠিন কিছু না। করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে চীনের উহানে যখন লকডাউন জারি ছিল, সেখানে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাসাতেই ক্লাস করানোর উদ্যোগ নিয়েছে। শিক্ষকের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে পেরেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় চীনে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
জেজিয়াং ইউনিভার্সিটি তাদের সব শিক্ষার্থীকে ই-লার্নিংয়ের আওতায় আনতে যাচ্ছে। বিদেশি শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ পাচ্ছেন। এমনকি কিছু কোর্স বিশ্বের সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি কোর্স হাব আয়োজন করে, যা ৪ হাজার মানুষকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে। ডিং টক জেজিইউ নামের একটি অ্যাপস তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি ই-কমার্স কোম্পানি আলিবাবা’র সঙ্গেও কাজ করেছে। অ্যাপসটি প্রায় ১ লাখ মানুষকে আকৃষ্ট করেছে।
সমস্যা হলো অনেক শিক্ষক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ নন। ফলে জেজিইউ মধ্য ফেব্রুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৫ হাজার ৯০০ শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানটি সুবিধাবঞ্চিত ৫ হাজার শিক্ষার্থীকে দূরশিক্ষণ কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে অর্থও বিনিয়োগ করছে। এছাড়া, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সঙ্গে চুক্তি করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য কম মূল্যে ইন্টারেনট প্রদান করা হয়েছে। অধিকন্তু, শিক্ষার্থীরা লেকচারটি প্রথম দফা বুঝতে ব্যর্থ হলে তারা পুনরায় কোর্সটির লেকচার চালাতে পারছে।
স্মার্ট ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জেজিইউ অনলাইন শিক্ষা শুরু করেছে। অনলাইন শিক্ষা প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি বড় পরিসরে প্রযুক্তিভিত্তিক স্মার্ট ক্লাসরুম প্রতিষ্ঠা করে। সম্প্রতি তারা ২০০টি স্মার্ট ক্লাসরুম গড়ে তুলেছে। এই ক্লাসরুমকে ভিডিও শিক্ষার জন্য শিক্ষকের ক্লাস নেওয়া ও তা অনলাইনে সরাসরি প্রদর্শন সহজ হয়েছে।
অনলাইন শিক্ষার মতো গবেষণাভিত্তিক শিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশ্বের অনেক অজানা রহস্যের কথা আমরা জানতে পারছি মেধাবী ও নিবেদিত গবেষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে। মানুষ শুধু তথ্যপ্রযুক্তিতে নয়, ওষুধ খাতেও শ্রেষ্ঠতা অর্জন করছে।
প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু যেদিন দেশের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা নতুন আবিষ্কার নিয়ে হাজির হবে, সেদিনই সত্যিকার উৎকর্ষ সম্ভব হবে। অবশ্য, এখন আশার ক্ষীণ আলো দৃশ্যমান হচ্ছে। বেশ কয়েকজন মেধাবী মানুষ এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভেন্টিলেটর এবং করোনাভাইরাস শনাক্তের কিট উদ্ভাবন করেছেন। এই উদ্যোগগুলোকে স্বাগত জানাই এবং আমরা আশা করি ভবিষ্যতে এমন আরও বেশি উদ্যোগ নেওয়া হবে।
অনলাইন শিক্ষায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা যেকোনও স্থান থেকে যেকোনও সময় অংশগ্রহণ করতে পারে, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু এই পদ্ধতিতে শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি আবশ্যক। ক্লাসরুমে যেভাবে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা সহযোগিতা করেন, অনলাইন শিক্ষাতেও একই ধরনের সহযোগিতা ও সহায়তা প্রয়োজন ও প্রত্যাশিত।
আসুন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে প্রতিশ্রুতি করি তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলা গড়ে তুলি।
লেখক: অধ্যাপক ও আইটি বিশেষজ্ঞ। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য এবং বাংলাদেশ কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালক।
Discussion about this post