জাকিয়া আহমেদ
দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত অনেক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। মারাও গেছেন অনেকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোগীদের তথ্য গোপন, হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, সঠিক ও মানসম্পন্ন সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব, নন-কোভিড হাসপাতালগুলোতে কোভিড পজিটিভ রোগীর ভর্তি অথবা বহির্বিভাগে চিকিৎসার কারণেই আক্রান্তের সংখ্যা এত বেশি।
নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ তাদের এক গবেষণায় জানিয়েছে, সম্মুখসারির এ যোদ্ধাদের ২৪ শতাংশ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) পাননি। তাদের দেওয়া পিপিই’র মান এবং এর ব্যবহারের প্রশিক্ষণ না থাকায় আক্রান্ত বেশি হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) বলেছে, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মৃত্যুর দায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর এড়াতে পারে না। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এত আক্রান্ত ও মৃত্যু এ পর্যন্ত কোনও দেশে ঘটেনি।
চিঠিতে মন্ত্রীকে সম্বোধন করে বলা হয়, ‘এমন জাতীয় ক্ষতির জন্য অনেকাংশে আপনার মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর দায় এড়াতে পারে না। মন্ত্রালয় ও অধিদফতরের এহেন আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত।’
দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যান সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দিন আহমেদ। ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ এপ্রিল মারা যান তিনি।
তার মৃত্যুর পর চিকিৎসকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘ডা. মঈনের মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রথম থেকে সব প্রস্তুত বলে আসা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এখনও কতটা অপ্রস্তুত।’
বিএমএ জানিয়েছে, তাদের কাছে ২৩ জুন সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকা হিসাব অনুযায়ী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ১৪৩ চিকিৎসক। আর মারা গেছেন ৪৫ জন। নার্সের আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার ২৩ জন। মারা গেছেন ছয় জন। আর অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৫৪৮ জন, মারা গেছেন তিন জন।
চিকিৎসকদের আরেক সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিজ (এফডিএসআর) জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ৪৫ জন চিকিৎসক করোনায় মারা গেছেন। আট চিকিৎসক মারা গেছেন করোনার উপসর্গ নিয়ে। যাদের মধ্যে কেউ কেউ করোনা নেগেটিভ ছিলেন। আবার কেউ কেউ পরীক্ষাই করেনি।
এপ্রিলে একজন চিকিৎসকের মৃত্যু হলেও এরপর দিনকে দিন সে সংখ্যা বেড়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মে মাসে মারা গেছেন ৯ চিকিৎসক। তাদের মধ্যে ৩ মে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হেমাটোলজিস্ট অধ্যাপক কর্নেল (অব.) ডা. মনিরুজ্জামান, ১২ মে ইবনে সিনা হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মেজর (অব.) আবুল মোকারিম মহসিন উদ্দিন, ১৮ মে ডা. আজিজুর রহমান রাজু, ২২ মে গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. কাজী দিলরুবা খানম ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের অবসরপ্রাপ্ত সহকারী পরিচালক ডা. এম এ মতিন, ২৬ মে গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. আমিনা খান ও রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ডা. আব্দুর রহমান, ২৭ মে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মোশাররফ হোসেন, ২৮ মে ক্যাপ্টেন (অব.) ডা. এ.এফ.এম সাইদুল ইসলাম।
জুনে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া চিকিৎসকরা হলেন, ১ জুন জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. ওয়াহিদুজ্জামান আকন্দ বাবলু, ২ জুন ইউরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. মনজুর রশিদ চৌধুরী, ৩ জুন চট্টগ্রামের মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. এহসানুল করিম, ইব্রাহিম মেডিক্যাল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দীন ও ডিজি হেলথের অবসরপ্রাপ্ত ইভালুয়াটার অফিসার ডা. এ কে এম ওয়াহিদুল হক, ৪ জুন ফরেনসিক মেডিসিনের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার ডা. মুহিদুল হাসান, ৫ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এস এ এম গোলাম কিবরিয়া ও বেসরকারি পোশাক কারখানায় কর্মরত ডা. ইহসানুল কবির চৌধুরী, ৬ জুন সাভার ইপিজেডের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার (অব.) ডা. আবুল কাসেম খান, ৭ জুন স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ও পরিচালক (মেডিক্যাল সার্ভিসেস) অধ্যাপক ডা. মির্জা নাজিম উদ্দিন, ৮ জুন ডা. রাজিয়া ও ল্যাবএইড হাসপাতালের অ্যানেস্থেশিওলজি বিভাগের কনসালটেস্ট ডা. সাখাওয়াত হোসেন, ৯ জুন বরিশালের ডা. আনোয়ার হোসেন ও ইমপালস হাসপাতালের অ্যানেস্থেশিওলজি বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. জলিলুর রহমান খান, ১০ জুন মেরি স্টোপস ক্লিনিকের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার ডা. তানজিলা রহমান, ১২ জুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেডিয়াট্রিক বিভাগের অধ্যাপক ডা. গাজী জহির হাসান, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মাহমুদ মানোয়ার, জেড এইচ শিকদার মহিলা মেডিক্যাল কলেজের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ কে এম ফজলুল হক, ১৩ জুন বিআরবি হাসপাতালের আইসিইউ বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মাদ সাজ্জাদ হোসাইন, ১৪ জুন চট্টগ্রামের ডা. সাদেকুর রহমান ও ডা. নজরুল ইসলাম, ১৫ জুন বিসিআইসি’র সাবেক অতিরিক্ত প্রধান মেডিক্যাল অফিস ডা. তৌফিকুন্নেছা, ১৬ জুন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. একেএম মুজিবুর রহমান, ১৭ জুন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের সিনিয়র আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার ডা. নুরুল হক, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশরাফুজ্জামান, দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক ডা. শাহ আব্দুল আহাদ ও এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অ্যান্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. রফিকুল হায়দার লিটন, ১৯ জুন বরিশাল সদর হাসপাতালের ডার্মাটোলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এমদাদুল্লাহ খান, ২০ জুন অধ্যাপক ডা. শফিক আহমেদ, কুমিল্লার সেন্ট্রাল মেডিক্যাল কলেজের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মুজিবুর রহমান ও ইমপালস হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. বজলুর রহমান, ২১ জুন মারা যান চট্টগ্রামের নাক কান গলা বিশেষজ্ঞ ডা. ললিত কুমার দত্ত এবং ২৩ জুন নারায়ণগঞ্জের ডা. আলী আসগর মারা যান।
করোনার উপসর্গ নিয়ে মে মাসে মারা যান চার চিকিৎসক। তাদের মধ্যে ১১ মে ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আনিসুর রহমান, ১২ মে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মীর মাহবুব, ১৮ মে ডা. সারোয়ার ইবনে আজিজ, ২৫ মে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডা. সৈয়দ জাফর হোসাইন। আর জুনে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন চার জন। তাদের মধ্যে ১২ জুন চট্টগ্রামের ডা. আরিফ হাসান, ১৮ জুন চট্টগ্রামের ডা. জান্নাতুন নাঈম জিনিয়া ও ২১ জুন ডা. সুনীল কুমার সরকার ও ডা. সৈয়দ শাহনেওয়াজ মারা যান।
শুরুতে আমরা ‘ঝামেলা’ করে ফেলেছি মন্তব্য করে বিএমএ-র মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা বেশি আক্রান্ত হযেছে। কারণ তারা তখন সঠিক পিপিই, মাস্ক পায়নি। এগুলো পরা ও খোলার প্রশিক্ষণও তারা পায়ানি। শুরুর দিকে রোগীরা তথ্য লুকিয়ে চিকিৎসা নিতে এসে চিকিৎসকদের আক্রান্ত করতো। যদিও এখন সে সংখ্যা কিছুটা কমে আসতে শুরু করেছে।
এখনও নানা বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ২৬-২৭ জন চিকিৎসকের বয়স ৬০ এর বেশি। ৭০-৭৫ বছরের অধ্যাপকও রয়েছেন। প্রথম দিকে সবাই প্রাইভেট প্র্যাক্টিস বন্ধ রাখলেও সরকার থেকে বারবার বলা হলো, একইসঙ্গে চিকিৎসকরা ঘরেও বসে থাকতে পারেননি তাই তারা বিভিন্ন জায়গাতে কাজ করেছেন। তাতে করে তারা আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু এদের এক্সপোজ হওয়া ঠিক হয়নি। তাদের সবার কোমরবিডিটি ছিল, তাতে করে আর টিকে থাকতে পারেননি তারা। অপরদিকে, পাঁচ জনের মতো চিকিৎসক আইসিইউতে কাজ করেছেন। কিন্তু সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ছাড়া আর কোনও আইসিইউতে নেগেটিভ প্রেসারের ব্যবস্থা নেই। অথচ পৃথিবীর সব দেশে আইসিইউতে এ ব্যবস্থা আছে। তাড়াহুড়া করে জোড়াতালি দিয়ে আইসিইউ করা হয়েছে। ফলে সেখানে কাজ করতে গিয়ে চিকিৎসকরা আক্রান্ত হয়েছেন। এখনও যদি সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে বড় বিপর্যয় সামনে অপেক্ষা করছে।
এফডিএসআর-এর যুগ্ম সম্পাদক ডা. রাহাত আনোয়ার চৌধুরী বলেন, প্রথমদিকে পিপিই সংকট ও নিম্নমানের পিপিই ছিল, সেখান থেকে পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হলেও মাস্ক এর মান ও সরবরাহ নিয়ে মাঠ পর্যায়ের চিকিৎসকদের মধ্যে এখনও অভিযোগ রয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসকরা ওভার লোডেড মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘কোথাও কোথাও তাদের ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত ডিউটি করতে হয়। এত দীর্ঘ সময় পিপিই পরে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং এই ওয়ার্কলোড কমাতে হবে।’
Discussion about this post