ড. এম এ মাননান
কলেজে পড়ার সময় দেখতাম ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় বড় ভাইয়েরা মাসে মাসে সেমিনার করেন এবং সেখানে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের কথা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চনার কথা বলেন আর বলেন ‘মুজিব ভাই’ কীভাবে আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে জেল-জুলুমের শিকার হচ্ছেন। মাত্র ভর্তি হয়েছি। মন দিয়ে শুনতাম।
বোঝার চেষ্টা করতাম, যদিও বৈষম্যের বিষয়গুলো ভালো করে বুঝতাম না। এটুকু ভালো করে বুঝতাম যে, মুজিব ভাই শিক্ষার কথা বলতেন, ছাত্রদের ভালো করে লেখাপড়া করার জন্য উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিতেন। তবে তখনও বুঝে উঠতে পারিনি সেই মুজিব ভাই ছিলেন কত বড় শিক্ষানুরাগী, শিক্ষার উন্নয়নে নিবেদিত আর শিক্ষকহিতৈষী। বুঝেছিলাম অনেক পরে।
আর বুঝেছিলাম বলেই তরুণ বয়সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করার মাত্র ১৯৬ দিনের মাথায় পঁচাত্তরের আগস্টের সেই ভয়াল দিনে সেই শিক্ষানুরাগী মানুষটির কথা শোনার জন্য আবেগ-উদ্বেলিত হৃদয়ে অপেক্ষা করছিলাম কখন ভোর হবে আর রওনা দেব ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের দিকে। রওনা দেয়া আর হয়নি। সব আশা-ভরসা হারিয়ে গিয়েছিল সেদিন ভোররাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কে জাতির পিতার আপন গৃহে।
তিনি আমাদের মাঝে নেই, আছে তার কর্ম। শিক্ষা জগতে তিনি যে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন তা জানাতে হবে এ প্রজন্মকে, পরের প্রজন্মকে আর সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে তার শিক্ষাভাবনা ও শিক্ষাদর্শন। ৫৫ বছরের ছোট্ট জীবনে ১১ বছরের বেশি সময় কারান্তরালে থাকা বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা এ মহান ব্যক্তিটি, পরবর্তী সময়ে জাতির পিতা, আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হলে শিক্ষাক্ষেত্রে তিনি কী করবেন।
তার প্রমাণ মেলে পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরপরই শিক্ষাক্ষেত্রে তার বিভিন্ন উদ্যোগের সমারোহে। স্বাধীনতার আগেই পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি বুঝেছিলেন, শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া জাতির ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ করা যাবে না; টেকসই উন্নয়নের জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী বক্তৃতায় তিনি শিক্ষায় বিনিয়োগকে সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ হিসেবে অভিহিত করতেন। স্বাধীনতা-পূর্ব ভাবনার আলোকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে প্রথমেই নজর দিলেন জাতির ভিত্তিমূলের দিকে।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরে গণপরিষদে গৃহীত আর ১৬ ডিসেম্বরে কার্যকর করা দেশের প্রথম সংবিধানের পাতায় খোদিত করে দিলেন শিক্ষার ভবিষ্যৎ। সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে তুলে ধরা হয়েছে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়সহ শিক্ষাসম্পর্কিত সুস্পষ্ট নির্দেশনা। তার সরাসরি তত্ত্বাবধানে একঝাঁক বিশিষ্ট নাগরিক আর শিক্ষাবিদের সমন্বয়ে গঠিত সংবিধান প্রণয়ন কমিটিসহ খসড়া সংবিধানের পর্যালোচনা কমিটি তৈরি করে দিল বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান, যা বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবে।
১৯৭২ সালের জুলাই মাসে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শনের প্রতিফলন। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে আর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ও পরামর্শে প্রণীত জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে নির্ধারণ করে দেয়া হয় সংবিধানের চার মূলনীতির আলোকে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলি। এর মধ্য দিয়ে প্রশস্ত হয় ঔপনিবেশিক আমলে শিক্ষা বিস্তারের পথে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাগুলো নিরসন করে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্গঠন করার পথ। ব্যক্ত হয় শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক রূপান্তরের প্রত্যাশা।
ভারত বিভাগের পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র সৃষ্টির পর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির আগ পর্যন্ত আটটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হলেও সেগুলো ছিল পাকিস্তান সরকারের তল্পিবাহক। ফলে সেসব প্রতিবেদনে দেখতে পাওয়া যায় জনমানুষের সমাজ-সংস্কৃতি আর মৌলচেতনাবিরোধী অবস্থান। আর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এবং তারই চিন্তাচেতনার আলোকে গঠিত খুদা কমিশন জাতিকে উপহার দিয়েছিল এমন একটি প্রতিবেদন, যার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল জাতির প্রত্যাশা আর বঙ্গবন্ধুর শিক্ষাদর্শন ও শিক্ষাভাবনা।
সোনার বাংলা গড়ার জন্য যেরকম সোনার মানুষ তিনি চাইতেন, সেরকম মানুষ গড়ার জন্য, নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করে সব নাগরিককে শিক্ষিত করে তোলার জন্য তিনি শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন অনেক বেশি। তিনি চেয়েছিলেন, প্রতিটি শিশুর চিত্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতার সুস্পষ্ট বোধ প্রোথিত হোক, তারা সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠুক, প্রত্যেকের মধ্যে সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধিত হোক।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যদি না ঘটত আর পঁচাত্তর-পরবর্তী অগণতান্ত্রিক সামরিক সরকার যদি বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে গঠিত খুদা কমিশন বাতিল করে না দিত এবং দেশটাকে পাকিস্তানের ভাবাদর্শের জিঞ্জিরে নিক্ষিপ্ত করার অপপ্রয়াস না নিত, তাহলে বাংলাদেশকে কখনও পেছনে ফিরে তাকাতে হতো না। দীর্ঘ সময় পর হলেও বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা শেখ হাসিনার হাতে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা প্রাণ ফিরে পেয়েছে; অন্তর্ভুক্তিমূলক, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু যেমন বুঝেছিলেন তেমনি তার যোগ্য উত্তরসূরি জ্যেষ্ঠ কন্যাও বুঝেছেন যে সততা, নৈতিকতা আর সামাজিক মূল্যবোধের আলোকমণ্ডিত শিক্ষায় আলোকিত করে প্রত্যেক নাগরিককে গড়ে তুলতে না পারলে আদর্শ জাতি যেমন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না, তেমনি এ দেশকে দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে কখনও বের করে আনা যাবে না, অর্থনৈতিক মুক্তিও মিলবে না।
সংবিধান প্রণয়নের পর বঙ্গবন্ধু হাত দিলেন শিক্ষার মূলে; প্রাথমিক শিক্ষার সংস্কার আর উন্নয়নে। তিনি বুঝেছিলেন, তখনকার সময়ে আশি ভাগ নিরক্ষর মানুষ, শিক্ষাবঞ্চিত অর্ধেকের বেশি শিশুকে নিয়ে এ দেশের উন্নতিসাধন সম্ভব নয়। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করলেন। সাইত্রিশ হাজার প্রাথমিক স্কুল হল সরকারি স্কুল, সব শিক্ষক হলেন সরকারি শিক্ষক। প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি বন্ধুত্বের হাত তিনিই প্রথম বাড়ালেন। একইসঙ্গে স্থাপন করলেন এগারো হাজার নতুন প্রাথমিক স্কুল। ফলে সব শ্রেণির মানুষের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত হল বঙ্গবন্ধুর গণমুখী উদ্যোগে। আমরা এখন অন্যতম বিশ্বশ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুকন্যার হাতে শিক্ষার উন্নয়নের যে সুফল ভোগ করছি, তার ভিত্তিটা সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন ভিশনারি নেতৃত্বগুণে মঞ্জুরিত দূরদর্শী বঙ্গবন্ধুই।
উচ্চশিক্ষায় বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল অভাবনীয়। উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে আর মুক্তবুদ্ধিচর্চার প্রসারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের কোনো বিকল্প নেই- এ ভাবনা তার হৃদয়ের গহিনে ছিল সবসময়। এর প্রমাণ মেলে তার জেলখানায় থাকাকালে রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’র পাণ্ডুলিপির পাতায়, যেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করার জন্য আইয়ুব খানের অপপ্রয়াসের বিষয়টি তুলে ধরেন, যা প্রকাশিত হয়েছে তারই সুযোগ্যকন্যার উদ্যোগে ২০১২ সালে। তাই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিদ্যমান কালাকানুনের ছায়া থেকে সরিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন। আইয়ুব খান প্রণীত ১৯৬২ সালের কালাকানুন বাতিল করে জারি করা হল যুগান্তকারী ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ-আইন, যার মাধ্যমে তৎকালীন চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র আইন ও আদেশের কারণে পেয়েছিল স্বায়ত্তশাসনের অধিকার। সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে তিনি চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হোক মুক্ত জ্ঞানচর্চার সূতিকাগার, যা সম্ভব হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসন দেয়ার মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধুর জীবন-গঠনে তার শিক্ষকদের অবদান ছিল অসামান্য, যা তিনি কখনও ভোলেননি। তার চিন্তাচেতনা আর মানস গঠনে শিক্ষকদের ভূমিকা আর প্রভাবের কথা তিনি স্মরণে রেখেছেন সবসময়। সম্ভবত এ কারণেই সব পর্যায়ের শিক্ষকদের প্রতি ছিল তার অগাধ শ্রদ্ধা আর সমীহ, যার প্রমাণ পাই আমরা বঙ্গবন্ধু রচিত ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে। জাতির পিতা হওয়ার পরও তিনি ভুলেননি তাদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথিতযশা শিক্ষক যেমন: আবদুর রাজ্জাক, ড. আবদুল মতিন চৌধুরীকে যে রকম শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন, তেমনি একইভাবে দেখতেন তার প্রাথমিকের শিক্ষকদেরও। কোনো অচেনা ব্যক্তিও শিক্ষক পরিচয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে এলে তিনি সম্মানের সঙ্গে তাকে সাক্ষাৎ দিতেন। শিক্ষকদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে আজকের প্রজন্মের।
শিক্ষা আর শিক্ষকদের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় অবদান আমাদের চিরকাল তার কাছে ঋণী করে রাখবে। তিনি যে আদর্শ আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা কিছুটা হলেও তার ঋণ পরিশোধ করতে পারি। আগস্টের এ শোকাবহ দিবসে মহান স্রষ্টার কাছে কামনা করছি- বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সব শহীদের রুহের মাগফিরাত।
ড. এম এ মাননান : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post